ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাসকিনের রাজসিক প্রত্যাবর্তন

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

তাসকিনের রাজসিক প্রত্যাবর্তন

মোঃ মামুন রশীদ ॥ অবৈধ এ্যাকশন, তাই নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। তবু কেঁদেছিল বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষ। এমনকি কিংবদন্তি অনেক বিদেশী ক্রিকেটারও ওই নিষেধাজ্ঞা মানতে পারেননি। কারণ বিশ্বকাপ চলার সময় দলের অন্যতম পেসার তাসকিন আহমেদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ধাক্কাটা জোরেশোরে লেগেছিল উজ্জীবিত বাংলাদেশ দলে। মানসিকভাবে দারুণ মুষড়ে পড়েছিল টাইগাররা- এমনকি সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা আবেগে কেঁদে বলেছিলেন- আমাকে নিষিদ্ধ করা হোক, তাসকিন কেন? ওর তো ক্যারিয়ার অনেক পড়ে আছে। এতকিছুর পেছনে আসল কারণ ছিল- টুর্নামেন্টের মাঝপথে কখনও কোন দলের নির্ভরযোগ্য বোলারকে এভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি ত্রুটিমুক্ত এ্যাকশনের জন্য। তবে কোনকিছুতেই কাজ হয়নি। এ্যাকশনের পরীক্ষা দিয়েও উত্তীর্ণ হতে না পেরে বিশ্বকাপের মাঝপথে ফিরে ২১ বছর বয়সী এ পেসার ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই ঘটনা হয়তো আমাকে অনেক দূরে যেতে সাহায্য করবে, ঘটনাটা না ঘটলে অতটা দূরে আমি হয়তো যেতে পারতাম না। আমি আরও কঠিন হয়ে ফিরব।’ সেটাই হলো। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার দু’দিন পরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে ৪ উইকেট শিকার করে আফগানিস্তানের প্রায় নিশ্চিত জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। ফেরার ম্যাচেই এমন নৈপুণ্য পুরো বিশ্ব ক্রিকেটকে বার্তা দিয়েছে তাসকিন আগের মতোই আছেন- অথবা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছেন। বীরোচিত প্রত্যাবর্তনই ঘটেছে তরুণ এ গতি তারকার যা বিশ্বের সাবেক অনেক গতিতারকাই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি নিষিদ্ধ হওয়ার পর। বাংলাদেশ দীর্ঘ ৬ মাস কোন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেনি। মার্চে ভারতে অনুষ্ঠিত টি২০ বিশ্বকাপের সুপার টেন পর্বে খেলা হয়নি তাসকিনের। কারণ বোলিং এ্যাকশনে ত্রুটি থাকায় রিপোর্টেড হয়েছিলেন এবং চেন্নাইয়ে আইসিসি স্বীকৃত ল্যাবরেটরিতে বোলিং পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারেননি। ফলাফলটা ছিল ভয়াবহ- সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হন তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে। আর সেটা কেউ মানতে পারেননি, কারণ খুব বেশি ত্রুটি ছিল না দু’য়েকটি ডেলিভারি ছাড়া। এর আগে কোন বোলারের কোন ডেলিভারিতে সমস্যা থাকলে শুধু সেটা থেকেই তাকে বিরত করা হতো, পুরোপুরি বোলিং থেকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতো না। এ কারণেই শোয়েব আখতার, ইয়ান বোথামসহ অনেকেই এর প্রতিবাদ করেছিলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকেই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আপীল করা হয়েছিল। পুরো বাংলাদেশে আন্দোলন, প্রতিবাদ হয়েছে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। অবশেষে ৮ সেপ্টেম্বর ব্রিসবেন ক্রিকেট সেন্টারে পুনঃপরীক্ষা দেন তাসকিন। তার জন্য অপেক্ষায় ছিল বিসিবির নির্বাচকরা আফগানদের বিরুদ্ধে সিরিজে দল ঘোষণার আগে। তবে সেটা বিলম্ব হওয়াতে তাসকিনের জায়গা রেখেই দল ঘোষণা করা হয়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সুখবর পান তাসকিন, এ্যাকশন বৈধ। আর দু’দিন পরেই তিনি ২৫ সেপ্টেম্বর (রবিবার) প্রথম ম্যাচ খেলতে নামেন। টি২০ বিশ্বকাপে কয়েকটি ম্যাচ খেলতে পারেননি শুধু। এর মধ্যে বাংলাদেশ দলও কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেনি। তাই নেমে পড়েন তাসকিন। ভয়ঙ্কর হয়ে ফিরব এমন আত্মবিশ্বাসী প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন নিষেধাজ্ঞার পরই। কিন্তু সেটার ছাপ দেখা যায়নি আফগানদের বিরুদ্ধে প্রথম ওয়ানডেতে। তাকে তুলোধুনো করেছেন আফগানিস্তানের ক্রিকেটাররা। এছাড়া বলে কোন নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়নি তাসকিনের। অথচ টি২০ এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের প্রাথমিক রাউন্ডে দারুণ ইকোনমি নিয়ে বোলিং করে প্রতিপক্ষের জন্য ভীতিকর হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘ বিরতিই হয়তো তাসকিনকে নষ্ট করে দিয়েছে, তাসকিন আর আগের মতো নেই এমনটাই মনে করছিলেন সবাই। কারণ প্রথম ৬ ওভারেই তিনি ৪৯ রান দিয়ে ফেলেন এবং কোন উইকেট নিতে পারেননি। যদিও নিজের প্রথম আর ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে বল করতে এসেই ওপেনার মোহাম্মদ শাহজাদের উইকেট তুলে নিতে পারতেন। তখন শূন্য রানে থাকা শাহজাদ তাসকিনের আউটসুইংয়ে বিভ্রান্ত হয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন। নতুন করে জীবন ফিরে পাওয়া ক্যারিয়ারের শুরুটাই উইকেট দিয়ে হতো পারতো, কিন্তু ইমরুল কায়েস সহজ ক্যাচটা ফেলে দেন। এ কারণেই যেন আরও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েন তাসকিন। গতি স্বাভাবিক থাকলেও লাইন-লেন্থের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম চোখে পড়েছে তাসকিনের বোলিংয়ে। প্রথম দুটি ওভারে ১১ রান দেয়ার পর তৃতীয় ওভারে ১৭ রান দেন তাসকিন। পরপর তিনটি বাউন্ডারি মেরেছিলেন শাহজাদ। ৩-০-২৮-০ ছিল তার প্রথম স্পেলের পরিসংখ্যান। দ্বিতীয় স্পেল শেষে বিশ্লেষণটা ছিল ৫-০-৪০-০। ৪১তম ওভারে আবার এসে ৯ রান দেন। শেষদিকে আর তাসকিনের হাতে বল দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না যিনি নিয়ন্ত্রণহীন বোলিং করে ততোক্ষণে ৬ ওভারে ৪৯ রান দিয়েছেন ৫টি ওয়াইডসহ! তবে অধিনায়ক মাশরাফি নাকি বলেছিলেন, ‘আগের বাজে ওভারগুলোর কথা ভেবে বোলিং করলে এখান থেকে দলকে হারাতে পার। কিংবা ওসব ভুলে গিয়ে নতুন উদ্যমে বল করে পাপাভ দলকে জেতাতে। বাকিটা তোমার ওপর।’ এই কথাটি দারুণ অনুপ্রাণিত করেছিল তাসকিনকে। স্বরূপে ফিরলেন তিনি ৪৮তম ওভারে, যখন আফগানরা জয়ের স্বপ্নে বিভোর। মাত্র ৬ রান দিলেন, কিন্তু তুলে নিলেন ২ উইকেট। শেষ ওভারে তাসকিন গতির সঙ্গে ছড়ালেন ত্রাস- তখন আফগানদের প্রয়োজন ১৩ রান! মাত্র ৫ রান দিয়ে আরও দুটি উইকেট শিকার করে আফগানদের ইনিংস গুঁড়িয়ে দিলেন তাসকিন- জেতালেন বাংলাদেশকে। শেষ পর্যন্ত ৮ ওভারে ৫৯ রান দিয়ে তিনি নেন ৪ উইকেট। প্রায় পরাজয়ের ম্যাচে নায়ক হয়ে গেলেন তরুণ এ পেসার। বিশ্ব ক্রিকেটকে জানিয়ে দিলেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ফিরছেন তিনি। ক্যারিয়ারের অভিষেক ম্যাচেই ভারতের বিরুদ্ধে নিয়েছিলেন ২৮ রানে ৫ উইকেট, সেটাই ক্যারিয়ারসেরা। এবার দ্বিতীয় সেরা বোলিংটা করলেন প্রথম ওয়ানডেতে। সত্যিকারের নায়কের মতোই ফিরেছেন তিনি।
×