হঠাৎ করে আবারও রাজনীতির হাটে হাঁড়ি ভাঙতে শুরু করলেন ড. ইউনূস স্যার! গত ১৭ সেপ্টেম্বর, দেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় খুব সাদামাটা ক’টা বাক্য উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু তার দাবিগুলো ততটা সহজ বা সরল নয়। দেশের মানুষ লক্ষ্য করে আসছে, রাজনীতি নিয়ে মাঝে-মধ্যে ড. ইউনূসের এমন সব বাক্যবাণ সর্বজনীন আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না।
বিগত ২০০৭ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে আচমকা দেশের বিবদমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করতে চাইলেন আর্বিটারের ভূমিকায়! বলি... ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ হতে গেলে কি হয় তা কি তিনি জানতেন না? শান্তির জন্য সর্বোচ্চ পদকধারী আমাদের এ নোবেল লোরিয়েট তখন বলেছিলেন... দেশে আর কোন বিভেদ-বিদ্বেষ নয়, এবার একটা সন্ধি হবে আর সকল পক্ষকে এতে সম্মত হতে হবে। সাধারণভাবে তার ওই দাবিটা মনে হচ্ছিল সহজ-সরলীকরণের এক আবেগ আশ্রিত প্রয়াস। তবে তখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় তা ছিল যেন তেল-জলের মিশ্রণ ঘটানোর মতো একটা অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য অপচেষ্টা মাত্র। আর তার ফল হয়েছিল কি?
দেখা গেল, প্রায় দু’যুগ ধরে চেপে বসা সামরিক শাসন তিরোহিত হওয়ার পরে, পর পর তিন টার্ম ধরে চলে আসা (ভাল হোক মন্দ হোক) দেশে সাধারণ নির্বাচনের ধারাবাহিকতাকে টুঁটি চেপে ধরে নতুন আঙ্গিকে সামরিকায়নের পুনর্যাত্রা শুরু হয়। রাজনীতিতে টু-মাইনাস ফর্মুলা ডালপালা গজাতে শুরু করে। ড. ইউনূস নোবেল লোরিয়েটর উচ্চাসন থেকে নেমে এসে সরাসরি রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী হলেন। দেশটাকে তার কাছে মনে হলো গ্রামীণ ব্যাংকের মতো... যেন তিনিই হয়ে উঠবেন এর সর্বেসর্বা! কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কি ভেবেছিল তখন? তিনি কি মেসেজ পেয়েছিলেন জাতির অন্তর্নিহিত মনোজগত থেকে?
২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় তিনি তাই তেমন কোন উচ্চবাচ্য করেননি। এছাড়া এ সময় মস্তবড় একটা আপদও সামনে ছিল। এ নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছিল, তাদের অন্যতম এক নির্বাচনী ইস্যু ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টা। হয়ত এ কারণে তিনি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন! তবে পরে পদ্মা সেতু নিয়ে তিনি যে কা--কারখানা করলেন তা জাতির মানসপট থেকে কোনদিন মোছা যাবে কি? ২০১৪ সালের নির্বাচনে তার কিছুই যেন বলার ছিল না... কেবল যেন চেয়ে চেয়েই দেখলেন!
পদ্মা সেতু হচ্ছে! বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সারা দুনিয়া বলছে ভাল। ইউনূস স্যার বলছেন ‘খারাপ’! কথিত ‘সুহৃদ-চট্টগ্রাম’-এর আয়োজনে ছোট্ট এক মহিলা আসরে সেদিন বললেন, ‘দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। সবাই আতঙ্কিত। ঘর থেকে বের হতে পারবে কিনা, নির্বাচন হবে কিনা, তা নিয়ে সবাই চিন্তিত।’ তিনি প্রশ্ন তুলেছেন... দেশে আজ এত অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক কেন?
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জরিপে যে চিত্রগুলো উঠে এসেছে তা হলো... বাংলাদেশের শতকরা ৭৩ জনই মনে করে দেশ সঠিক পথেই রয়েছে। বিশ্বের দু’শতাধিক দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের উপযোগী দেশ হিসেবে ১৬ কোটি মানুষের এ ঘনবসতিপূর্ণ ছোট্ট দেশটা রয়েছে অষ্টম অবস্থানে। আর্থ-সামাজিক অন্য সব প্যারামিটারের উল্লেখ না করেই একটা বাক্যে বলা যায়, বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশগুলোর তালিকাভুক্ত করে নিয়েছে।
একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে এ বিষয়টার দিকে তার নজর নেই। তার নজর কিভাবে বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণ ঠেকানো যায়! তার চিন্তার জগত একাগ্র হয়ে আছে গ্রামীণ ব্যাংকের দিকে। ব্যাংকটা তার একচ্ছত্র আধিপত্যে থাকলেই ভাল। তার কাছে সরকারী হস্তক্ষেপ একেবারেই অসহ্য। প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কতিপয় মাদ্রাসা শিক্ষাবিদ যেমন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক তথ্যাবলীর ব্যাপারে যেভাবে সরকারের সঙ্গে কোন কিছু শেয়ার করতে চান না, সরকারী সহযোগিতা কিংবা নিয়ন্ত্রণ কোনটাই তারা মানতে নারাজ। তেমনি ড. ইউনূসও গ্রামীণ ব্যাংককে দেশ-সরকারের অগোচরে রাখার পক্ষপাতী। কিন্তু এটা বোধগম্য হয় না যে... দেশের প্রচলিত আইন, আর্থিক নীতিমালা, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় কিংবা নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য ব্যাংকের মতো গ্রামীণ ব্যাংকও থাকলে অসুবিধা কোথায়? এ কথাটা তো তিনি পরিষ্কার করে বলছেন না।
ওই সমাবেশে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রসঙ্গ টেনে তিনি সেদিন সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, সরকার তাকে বলছে তিনি নাকি সুদখোর, ঘুষখোর, রক্তচোষা। তিনি সাবধান করে বলেছেন, ‘খবরদার! গ্রামীণ ব্যাংকে হাত দেবেন না। যে হাত দেবে তার হাত ভেঙ্গে দেয়া হবে। উপস্থিত নারী সদস্যদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন... ‘আমি দেখতে চাই আপনাদের গলার জোর বেশি, না ওই একজনের বেশি। ইত্যাদি, ইত্যাদি...
মূল কথা হচ্ছে, তিনি ভাল একটা বাজার জুড়েছেন। এ দেশের লাখো কোটি মানুষকে কর্মক্ষম করে তোলার পেছনে গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকাকে অস্বীকার করার কিছু নেই। কিন্তু অবাক করার মতো কথা হলো, এ সহায়-সম্বলহীন মানুষগুলোর কর্মদক্ষতার শতকরা ৮০ ভাগ ফলই চলে যাচ্ছে এক সিন্ডিকেশনের পেটের ভেতর। মানুষগুলো উঠে দাঁড়িয়েছে ঠিকই, তবে কোনদিনই এরা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে না। ইউনূস এদের বানিয়েছেন টবের গাছ... তাদের বাড়তেও দেবেন না, আবার মরতেও দেবেন না। জানি না কোন্ মুখে তিনি এসব গরিব মানুষের বেলায় ২৭%-এর বদলে ২০% সুদ নিচ্ছেন বলে সাফাই গেয়ে তৃপ্তি পান। তার এমন কথায় অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা নিয়ে নিঃস্ব হওয়ার মতো কত শত উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে ইতোমধ্যে! ঋণের দায় মেটাতে কত মানুষের ভিটেমাটি গেছে, চালের টিন খুলে দিতে হয়েছে, কাউকে কাউকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে, অমানুষিক ঘাম-শ্রম দিয়ে গড়ে তোলা সহায়-সম্পদ কেড়ে নিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজন। নিরুপায় হয়ে নিজের কিডনি বিক্রি করে পর্যন্ত দায় মেটাচ্ছে গরিব মানুষরা। আর এসবই তো সুদখুরী, ঘোষখুরী ও রক্তচোষার নির্লজ্জ প্রমাণ! ড. ইউনূস এভাবেই খেটে খাওয়া মানুষদের পুঁজি তৈরির উপকরণ বানিয়ে অনেক দূর এগিয়েছেন... নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। প্রশ্ন তো উঠতেই পারে! আর্থ-সামাজিক খাতে পুরোপুরি অর্থনীতিভিত্তিক কাজ করে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন ড. ইউনূস? ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যেমন শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী হন! পুঁজিবাদী এ বিশ্ব নেতাদের কাছে তাদের তাঁবেদারদের কদরই ভিন্ন! শান্তি কিংবা রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথে বিজয়ী বীরদের সম্মান দেখাতে নোবেল নির্বাচকরা বড় বেশি যে ভয় পায়! মালালা কিংবা আউং সান সুচিদের মাঝে-মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার কাজগুলো তো অন্যরকম চমক!
আর অমন চমকপ্রদ নোবেল বিজয়ীদের একজন আমাদের ইউনূস স্যার কি আবারও রাজনীতির মাঠে নামার পাঁয়তারা করছেন আগামী নির্বাচনকে উপলক্ষ করে? নিশ্চয়ই এর পেছনে বড় কোন বার্তা আছে। বার বার ধাক্কা খাওয়ার পরেও জীবন সায়াহ্নে এসে কেন তিনি এমনটা করতে যাবেন? হয়ত তিনি আবারও খাল কেটে কুমির আনার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে হয়ত আশা করছেন, আমেরিকায় হিলারি বিজয়ী হলে তার দরজা খুলে যাবে, তার প্রতাপ-প্রতিপত্তির প্রসার ঘটবে। এক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশের সহজ-সরল মানুষ যে কোন ধরনের দৌরাত্ম্যকে ভালভাবেই এখন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে ফেলেছে। এর প্রমাণ তো অনেক আছে। পরের কথা হলো, এখন একজন বোকাসোকা মানুষও বোঝে, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকাসহ সকল পরাশক্তিই আর আগের অবস্থানে নেই। বাংলাদেশ নিয়ে খেলতে হলে সবাই এখন অন্তত দু’বার চিন্তা করে। বাংলাদেশ এখন অনেকের কাছেই ‘অনুকরণীয়’ এবং কৌশলগত মিত্র হিসেবেই তারা এখন বাংলাদেশকে কাছে পেতে আগ্রহী। ইউনূস স্যার তাহলে জানি না কোন্ দিবাস্বপ্ন দেখছেন!
বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, ড. ইউনূস অনেকটা অন্ধভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবস্থান করছেন। যখনই দেখা যায় তার আশীর্বাদপুষ্টদের হাঁটু কাঁপছে তখনই তিনি উচ্চকিত হয়ে ওঠেন। এতে তার কি লাভ হয় জানি না। কিন্তু এটা দেদীপ্যমান সত্য যে, তার আশীর্বাদপুষ্ট বলয়ে এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল বিরোধিতাকারী অবস্থান করছে। বিপরীতে দেশের স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির দৃঢ় অবস্থান থাকায় এদের বিরোধিতার পথ খুঁজতে গিয়ে তাদের কেবলই উল্টো পথে হাঁটতে হচ্ছে।
আবশ্যিকভাবেই প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবতে হলে, এ দেশের রাজনীতি করতে হলে, এমনকি এদেশে থাকতে হলেও প্রো-বাংলাদেশী না হওয়ার কোন বিকল্প আছে কি? উল্টোরথযাত্রীদের স্বার্থে কেন তিনি মাঝে মাঝে নিজেকে এত নিচে টেনে আনেন তা কে বলবে?
প্রায়ই বলতে শুনি, আমরা নিজেদের লোককে সম্মান দিতে জানি না। এক্ষেত্রে কেউ কেউ আরও একটু এগিয়ে ব্যক্তি বিদ্বেষের প্রসঙ্গটাও যোগ করেন। বলব, এসবই ঠুনকো অজুহাত। ড. ইউনূসের জন্য কোন সমান্তরাল রেখা অঙ্কনের প্রয়োজন ছিল কি? পৃথিবীর অন্য কোন নোবেল লোরিয়েটের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই।
আমি নিজে ড. ইউনূসের একজন স্নেহভাজন ছাত্র ছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যয়নকালে তিনি আমার ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসর ছিলেন। পরে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকা-ে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। আমি সব সময়ই তার অর্জনগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করি। তবে সর্বদা তাকে যে উচ্চতায় দেখতে চাই তা যে কেন হয়ে ওঠে না, এটাই আক্ষেপ... যা আমাকে বড় বেশি পীড়িত করে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সুনামগঞ্জ
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: