ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী সুলতানা

দূর দেশের কিছু গল্পকথা

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দূর দেশের কিছু গল্পকথা

অস্ট্রেলিয়ায় ডিসেম্বর-জানুয়ারি এ দু’মাস পুরোপুরি গরম থাকে। এ সময়টা খুব উপভোগের। বাচ্চাদের স্কুল ছুটি থাকে। তাই বাবা-মা বা অভিভাবকরা সে সময় ছুটি ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। কেননা তা না হলে বাচ্চারা একা একা কেমন করে বাসায় থাকবে। ছুটি দিতে চাকরি প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন কোন ঝামেলা করে না এ সময়। সামার টাইমে আমরা সব সময় লং ড্রাইভে যাই। এবারও তাই করেছি। খ্রিস্টমাস সময়টা অর্থাৎ ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর গিয়েছিলাম সিডনি থেকে ৭ ঘণ্টা ড্রাইভ ইডেন নামক একটা জায়গায়। অবশ্য আমাদের থাকার জায়গাটা ছিল অন্যখানে মিরিম্বিনা বিগফোর রিসোর্টে। কোথাও যাওয়ার প্ল্যান থাকলে আমরা সব সময় ভোর ৫টার আগে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। এতে শহরের ভেতরকার হলিডে ট্র্যাফিক এড়ানো যায়। তাই বাচ্চাদের বলে রাখি ব্রেকফাস্ট হবে ম্যাকডোনাল্ডসে। বাচ্চারা সেই লোভে লোভে আমাদের আগেই উঠে পরে ঘুম থেকে। ওরাই বরঞ্চ আমাদের তাড়া দিতে থাকে জলদি রওনা দেয়ার জন্য। সেদিনও তাই হলে,া ভোরে উঠেই বেরিয়ে পড়লাম। পথে বেরিয়ে মনে পড়ল আরে ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টমাসের দিন তো সবকিছু বন্ধ থাকবে। বিশেষ করে এত ভোরে ম্যাকডোনাল্ডসও খোলা থাকবে না। এদিকে বাচ্চাদের কথা দিয়েছি পথে নাশতা করাব। কিন্তু কি আর করা! সঙ্গে যে হাল্কা কিছু খাবার নিয়ে বেরিয়েছিলাম সেটা দিয়েই নাশতা সারতে হলো। সারা পথ এবার নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া খাবারের ওপর নির্ভর করতে হলো। দোকানপাট খোলা না থাকায় পথে তেমন থামিনি। তাই বারোটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। এখানকার হলিডে রিসোর্টগুলো স্টার ভিত্তিতে মানদণ্ড নির্ধারণ হয়। ফাইভ স্টার, ফোর স্টার এভাবে ক্রমান্বয়ে সুবিধার ভিত্তিতে রেটিং করা হয়। যেমন ফাইভ স্টার হলে সর্বাধিক সুবিধাসম্পন্ন হয়ে থাকে। আমরা ইন্টারনেট থেকে রিসোর্ট বুকিং দিয়েছিলাম। আমাদের বলা আছে যেহেতু ২৫ তারিখ খ্রিস্টমাস ডে তাই অফিসে কোন লোক থাকবে না। বুকিং ডকুমেন্ট ও চাবি রাখা থাকবে নির্দিষ্ট লকারে, তার নম্বর ই-মেইলে দেয়া হয়েছে। যথারীতি আমরা পৌঁছেই সে লকারে সব পেয়ে গেলাম। রিসোর্ট দেখে আমার বাচ্চারা মহা খুশি। কারণ বাচ্চাদের সুইমিং পুল থেকে শুরু করে যাবতীয় আনন্দ আয়োজন এখানে আছে। সন্ধ্যায় আবার বড় প্রোজেক্টরে মুভিও দেখানো হবে সমুদ্রের বালির ওপর। গাড়ি থেকে নেমেই ওরা চলে গেল জাম্পিং ক্যাসেলে। আসলে অনেকক্ষণ গাড়িতে বসে থেকে ওরাও বিধ্বস্ত। তাই লাফালাফি করার জন্য আর তর সইছিল না। এখানে রিসোর্টগুলোতে ক্যাবিন বা ইউনিট ছাড়াও পাওয়ার ও নন-পাওয়ার ক্যাম্প সাইট থাকে। যে কেউ লং ড্রাইভে বেরুলে রাতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তখন ক্যাম্পে টেন্ট বা তাঁবু পেতে ঘুমিয়ে নেয়। এ সুবিধাটা যে কোন উন্নত দেশে ট্যুরিস্টদের কম খরচে ভ্রমণে উৎসাহিত করার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটা বিষয়। আমি যখন নিউজিল্যন্ড ছিলাম, সেখানেও এই সুবিধা দেখেছি। আমার কাছে অতি চমৎকার একটি পদক্ষেপ মনে হয়েছে। এখানে বাচ্চাদের ক্লাস ফাইভে উঠলে স্কুল থেকেই ক্যাম্পিংয়ে নিয়ে যায়। যাতে করে তারা যে কোন পরিস্থিতিতে এডজাস্ট করে নিতে পারে এবং স্বাবলম্বী হতে শেখে। রিসোর্ট ছাড়া এমনিতেও ক্যাম্পিংয়ের বিভিন্ন সুবিধা আছে অস্ট্রেলিয়াজুড়ে। লং ড্রাইভে বেরুলে ক্যারাভেন সাইন দেয়া থাকে পথে পথে। সেই সাইন ফলো করলেই ক্যাম্পিং সাইট খুঁজে পাওয়া যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ট্যুরিস্টরা কম খরচে বিশ্বভ্রমণে বেরুলে এই ক্যাম্পসাইটগুলোতে রাত কাটায়। অনেক দিন অনেক রিসোর্টে আমার কথা হয়েছে জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, আমেরিকা থেকে আসা ইয়ং ট্যুরিস্টদের সঙ্গে। এমনকি কয়েক জন মেয়েমিলেও মাসখানেকের জন্য বেরিয়ে যায় বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের উদ্দেশে। গামট্রি নামে একটা ওয়েবসাইট আছে যেটা পার্সোনালভাবেও ট্যুরিস্টদের নানা সাহায্য করে থাকে। এক বার হল্যান্ডে থেকে আসা ট্যুরিস্ট কাপল মিয়ান্ডার ও বিয়াট্রিসের সঙ্গে বেশ সখ্য হয়েছিল আমাদের। বলেছিল আবার অস্ট্রেলিয়া এলে ট্যুরিস্ট ক্যাম্পে নয়, আমার বাসায় উঠবে তারা। এখনও যোগাযোগ আছে তাদের সঙ্গে। ফুটফুটে দুটি ছেলে হয়েছে তাদের। থাক, সে গল্প না হয় আরেকদিন করব। আমাদের এই রিসোর্টেও ক্যাম্প সাইট আছে। তবে বেশিরভাগই দেখছি ইরান, আফগানিস্তান ও লেবানিজ ক্যাম্পার। মাথায় হিজাব পরা। এত দূর এই মফস্বল শহরে এরা ক্যাম্পিংয়ে এসেছে কেন, ঠিক বুঝতে পারছি না। পরে মনে হলো সম্ভবত আশপাশেই থাকে। রেসিড্যান্সি নেই। তাই হয়ত রিফুজি হিসেবে এই শহরতলিতে কোথাও কাজ করছে। ছুটির দিন তাই ক্যাম্পিং করছে। এই রিসোর্টে ক্যাম্প ফ্যাসিলিটি চমৎকার। তিনটা ঝকঝকে রান্নাঘর। মনে হচ্ছে নতুন বানানো নতুবা রেনুভেট করেছে। তাই মহিলাগুলো রান্নার ঘটিবাটিসহ সব সরঞ্জাম নিয়ে কেবল সারাক্ষণ রান্না আর ওয়াশিং নিয়েই ব্যস্ত। পুরুষলোক ও বাচ্চারা বসে বসে টিভি দেখছে। মহিলারা সারাক্ষণই কাজ করছে একেবারে বাড়িতে যা করে। বেড়াতে এসেও তাদের শান্তি নেই। আমি আবার ঠিক তার বিপরীত। বেড়ানো ব্যাপারটা আমার কাছে একটা বিড়ম্বনা মনে হয়। প্রতিবার বেড়াতে যাওয়ার আগে কন্ডিশন থাকে আমি কিছুই করতে পারব না নেয়ায়েত প্রয়োজন না পড়লে। যদি কেবল বই পড়ার সুযোগ দেয়া হয় তাহলেই যাব। ঘরে-বাইরে কাজ করার ঝক্কিঝামেলা আমি নিতে পারব না। তারচেয়ে বরং ঘরেই থাকি। ঘরে কাজ করব আমি, বেড়াতে গেলে বাচ্চা ও তাদের বাবা। এভাবেই লং ড্রাইভে যাওয়ার শর্ত থাকে। গাড়ি থেকে মালপত্র নামানোর আগে পুরো রিসোর্টটা দেখে নিতে ইচ্ছে হল। তাছাড়া একটু হাঁটাও দরকার। অনেকক্ষণ গাড়িতে বসায় শরীর থিতু হয়ে আছে। যে কোন হলিডে রিসোর্ট সাধারণত প্রাকৃতিক দৃশ্য, লেক কিংবা সমুদ্রের পাড়ে থাকে। এটা একেবারে সমুদ্রের পাড়ে। পাশাপাশি সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্য। দুয়ে মিলে এতটাই অপূর্ব যেন কোন ছবির ক্যানভাস। আমার হাতে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা উপন্যাস। দোতলা বারান্দায় সমুদ্রের হাওয়া খেতে খেতে এখনই বইটি পড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। এমন অসাধারণ পরিবেশ শুধু হাওয়া খেয়েও সময় কাটিয়ে দেয়া যায়। এমনি এমনি কিছুক্ষণ দোতলা বারান্দায় বসে রইলাম। সমুদ্রের হাওয়া আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। এমন উতলা হাওয়া অনেকদিন উপভোগ করি না। ইস্ জীবনটা বড় স্বপ্নিল। আমি চোখ বন্ধ করে মনের দরজা খুলে দিলাম। বাচ্চাদের হৈচৈ শুনে সম্বিত ফিরে এলো। অনেকক্ষণ লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করে ওরা এখন ক্ষুধার্ত। অগত্যা খাবারের হাল্কা আয়োজনে নামতে হলো। বললাম অল্প কিছু খেয়ে তোমরা সুইমিং পুলে যাও। আমি বসে থাকব তোমাদের সঙ্গে। এর মধ্যে তাদের বাবা বারবিকিউ করে ফেলবে। তিনি আবার বারবিকিউতে ভীষণ উৎসাহী। কোন ধরনের হেল্প ছাড়া একাই সব করতে পছন্দ করেন। মনে মনে বলি আউটিংয়ে আসা মন্দ নয়। ঘরে থাকলে তো শুধু কাজ আর কাজ। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা উপন্যাসটি নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে সুইমিং পুলের দিকে হাঁটা দিলাম। বারবিকিউ শেষ হলে আমাদের ডাকা হবে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...
×