ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ার নিভৃত গ্রামে বহু কোটি টাকার শ্বেতপাথরের প্রাসাদ

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বগুড়ার নিভৃত গ্রামে বহু কোটি টাকার শ্বেতপাথরের প্রাসাদ

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার একেবারে নিভৃত গ্রামে প্রায় দেড় একর জায়গার ওপর বহু কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সম্পূর্ণ শ্বেতপাথরের রাজপ্রাসাদ। ২০০৭ সালে এই প্রাসাদের কাজ শুরু হয়েছে। নয় বছরেও শেষ হয়নি। আরও অনেকটা সময় লাগবে। প্রাসাদটি ঘিরে কৌতূহলী প্রশ্নের জন্ম নিচ্ছে। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেও কোন সদুত্তর মিলছে না। বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে শিবগঞ্জ উপজেলার নিভৃত গ্রাম দেউলী। মহাস্থান মোকামতলা হয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে পাকুরতলা এলাকায় পৌঁছে ডান দিকে ঘুরে কয়েক কিলোমিটার এবড়ো থেবড়ো পথ পেরিয়ে দৃষ্টিতে আসবে এই প্রাসাদ। এলাকার লোকের কাছে বাড়িটি টুটুলের বাড়ি হিসেবে পরিচিত। মালিক টুটুল সপরিবারে ঢাকায় থাকেন। বাড়ির পুরো সীমানাসহ প্রতিটি অবকাঠামো দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা। দূর থেকে মনে হবে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। মূল ফটকটি নাটোরের উত্তরা গণভবনের নকশায় নির্মিত। ভেতরে চার তলা প্রাসাদের প্রথম ইউনিট ও দ্বিতীয় ইউনিটের ওপরে চৌকোনা চারটি গম্বুজ উত্তরা গণভবনের (একদা রানীর প্রাসাদ ছিল) মতো। মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পরই হাতের বাঁয়ে চোখে পড়বে শ্বেত পাথরের হংস ফোয়ারার চার ধারে পাথরের সান বাঁধানো পুকুর। প্রাসাদের প্রথম ইউনিটে বড় দরোজা দিয়ে প্রবেশের পর বিরাট হল রুম। দেয়ালের পরতে পরতে নকশা। দ্বিতীয় ইউনিটে প্রবেশের পর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় নজরে আসবে পোড়ামাটির ফলক (টেরাকোটা)। প্রতিটি ফলকে প্রাচীন ইতিহাসের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দোতলার ঘরগুলো সুপরিসর। এখানে ফাইভ স্টার হোটেলের লাউঞ্জ ও রিসেপসনিস্টদের মতো ডিজাইন করে রাখা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে চতুর্থ তলায় গিয়ে মনে হবে বিদেশী হোটেলগুলোর মতো যে কোন অনুষ্ঠান ও আয়োজন সেখানে করা সম্ভব। দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ তলার ভিতরের কাঠামো কেমন তা দেখার ও জানার উপায় নেই। বাড়ির কেয়ার টেকার মালিকের নির্দেশ ছাড়া এসব ঘর খোলে না। এমন কি মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। কেউ ভেতরের অংশটুকু দেখতে চাইলে প্রাসাদ প্রকল্পের কর্মকর্তা ঢাকায় মোবাইলে মালিকের বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি দেন। এই প্রাসাদের মালিক শাখাওয়াত হোসেন টুটুলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার কোন উপায় নেই। মাধ্যম হয়ে কথা বলতে হয়। তিনি নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কথা বলেন না। কেন এই লুকোচুরি তাও এক রহস্য! নিভৃত গ্রামে পুরোটাই শ্বেতপাথরে নির্মিত এত বিলাসবহুল বাড়ি দেশের আর কোথাও আছে এমনটি জানা নেই। এই প্রাসাদের নকশা মালিকেরই করা জানালেন প্রকল্প কর্মকর্তা। প্রাসাদটি একটি প্রকল্প। বাড়ি ও পুকুর ছাড়া একটি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। প্রাসাদ নির্মাণে বাইরের নাম করা রাজ মিস্ত্রিরা কাজ করছে। কাঠের জানালা দরোজাসহ প্রতিটি কাজই প্রাচীন নকশায় তৈরি। সবচেয়ে দামী কাঠ ব্যবহার হয়েছে এসব কাজে। শ্বেত পাথরও আনা হয়েছে বিদেশ থেকে। বাড়িতে বিদ্যুত সংযোগ আছে। প্রতিটি ঘরেই এয়ার কন্ডিশনার আছে। বাড়ির মালিক যখন আসেন তখন ঘরগুলো খুলে দেয়া হয়। তিনি মাঝে মধ্যে আসেন। তিনি যাওয়ার পর কেয়ারটেকার ছাড়া কেউ থাকে না। প্রাসাদের মালিকের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে। ঢাকায় ধানম-িতে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, গাজীপুরে টাটকা ফুড প্রডাকশন ফ্যাক্টরি, প্রাসাদের অল্প দূরে এএইচজেড কোল্ড স্টোরেজ, একটি ইটভাঁটি ও এএইচজেড ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। কোল্ড স্টোরেজের যন্ত্রপাতি ডেনমার্ক থেকে আনা। কোল্ড স্টোরেজের কর্মকর্তা শামসুল হক বললেন, মালিকের ইচ্ছা আছে প্রকল্পটিকে আরও সম্প্রসারণ করার। ভূমিটি তাদের পৈত্রিক। দিনে দিনে আশপাশের ভূমি কিনে প্রাসদটি নির্মিত হচ্ছে। এএইচজেড ওয়েলফেয়ারের কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র বর্মণ জানালেন, এই প্রাসাদ গড়ার পেছনে মালিকের যে ইচ্ছা কাজ করেছে তা হলো, গ্রামের বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে বড় হওয়ার আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তোলা। এলাকার মানুষের মন মানসিকতার পরিবর্তন হয়ে উন্নত হবে। ঘরগুলো এমনভাবে নির্মিত হয়েছে যে প্রতিটি ঘরেই টেরাকোটায় জানার ও শেখার অনেক উপাদান আছে। তিনি এই প্রাসাদের মালিককে একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে দাবি করেন। এই দেউড়ি গ্রামের বাসিন্দা ফখরে আলম বললেন, গ্রামের এই জায়গায় আগে কুঁড়েঘর ও টিনের চালা ছিল। টুটুল বাড়িগুলো কিনে নিয়েছেন। ভাল বাড়ি নির্মিত হওয়ার পর বাইরে থেকে লোকজন দেখার জন্য আসে। লোকজন আসে বলে বাড়ির কাছেই কয়েকটি দোকান হয়েছে। আছে খাবারের দোকানও। বাইরের লোকজন আসে ঠিকই তবে ভেতরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে। কথাটি বাইরে লেখা আছে। বিভিন্ন স্থান থেকে কৌতূহলীরা এসে বাইরে থেকে দেখেই ফিরে যায়। সোমবার দুপুরে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায় গাইবান্ধা থেকে কয়েকজন এসেছেন। ভেতরে দেখার অনুমতি চেয়ে পাননি। কেন দেখতে দেয়া হয় না প্রশ্নে প্রাসাদ প্রকল্পের কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি তো একটি বসত বাড়ি। বাড়ির ভেতরে কি কাউকে দেখতে দেয়া যায়!’ এই প্রাসাদ বাড়ি ঘিরে সাধারণের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সাধারণ চোখেই দেখা যায় শুধু শ্বেত পাথরেই লেগেছে বহু কোটি টাকা। তারপরও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ। বাড়ির মালিক এত কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রামে এই প্রাসাদ বানিয়েছেন কি শুধু থাকার জন্য! তাহলে ভেতেরে ঢুকতে এত রাখঢাক কেন! বলা হয় বাড়ির মালিক জমিদার পরিবারের ছেলে। তাই এই বিলাস। বিলাসের এত টাকার উৎসই বা কোথায়! যে কয়টি প্রতিষ্ঠান আছে তা দিয়ে কি এত বড় প্রাসাদ নির্মাণ সম্ভব! যদি সম্ভব হয় তাহলে সরকারকে কত টাকা আয়কর দেয়া হচ্ছে! এমন অনেক প্রশ্ন...।
×