ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পশুর হাড় শিং চর্বির কোটি টাকার বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পশুর হাড় শিং চর্বির কোটি টাকার বাণিজ্য

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেয়া গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার হাড়, শিং, অ-কোষ, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রথলি, পাকস্থলী ও চর্বি মোটেও ফেলনা নয়। এগুলো থেকেই হচ্ছে কোটি টাকার বাণিজ্য। এসব সংগ্রহ করে অনেকেই বড় ব্যবসায়ী হয়েছেন। প্রতিবছর কোরবানি দেয়া পশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রক্রিয়াজাতের পর বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হারও কম নয়। তবে তা আলোচনায় আসছে না বলে এ খাতের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল এবং কোন কোন দেশে পশুর এসব অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ মানুষের প্রিয় খাবারের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। তবে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এর গুরুত্ব না থাকায় যতœসহকারে এগুলো সংরক্ষণ করা হয় না। ফেলে দেয়া হয়। পরবর্তীতে দ্বিগুণ পরিশ্রম করে তা পরিষ্কার করতে হয়। রাজধানীসহ সারাদেশের কসাই, পথশিশুসহ কয়েক পেশার মানুষ এগুলো সংগ্রহ করে ভাঙারির দোকানে বা হাড়ের মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। গত দুদিন ধরে পশুর এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহে ব্যস্ত ছিল অনেকেই। তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এগুলো সংগ্রহের পর তিন টাকা কেজি দরে হাড় এবং পশুর অ-কোষ ২০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা, পাকস্থলী ১২০ টাকা, শিং ১০০ টাকা, চোয়ালের হাড় তিন টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার পাশে বসে এসব অনেককেই কিনতে দেখা গেছে। কেউ কেউ আবার ভ্যানে করে হাজারীবাগে নিয়ে গিয়েও বিক্রি করেছেন। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এগুলো ওষুধের ক্যাপসুলের কভার, সুতা, সাবান, সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর গাবতলী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কলাবাগান, ধানম-ি, ফার্মগেট, উত্তরা, বনানী ও যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় পথশিশুদের এসব সংগ্রহ করে বিক্রি করতে দেখা গেছে। অনেকে রাজধানীর ডাস্টবিনের পাশে দাঁড়িয়েছিল এসব সংগ্রহের জন্য। তাদের ভাষায় এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিভিন্ন ধরনের নাম রয়েছে। পথশিশু মঈন উদ্দিন জানায়, ‘পাকস্থলীকে তারা সাতপর্দা, ষাঁড়ের অ-কোষসহ যৌনাঙ্গকে পইক্যা, রগ বা গোল্লা বলে।’ গাবতলী সংলগ্ন সøুইসগেট এলাকার মোঃ মিলনকে ডাস্টবিনের কাছ থেকে গরুর মাথার হাড়, শিং ও নাড়ি সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। সে জানায়, ‘আমি পরিচ্ছন্ন কর্মী। প্রতিবছরের মতো এবারও হাড় সংগ্রহ করছি। কেউ বিক্রি করলে তাও কিনি।’ আদাবর এলাকায় কিছু লোককে দিয়ে হাড় ও পশুর অ-কোষ, পাকস্থলী ও নাড়ি কেনাচ্ছেন বাবুল মিয়া। তিনি বলেন, ‘আগামী দুদিন এটা বেচাকেনা হবে। আমি কিছু ছেলেপেলেকে বলছি কেনার জন্য। তারা মাথার হাড় তিন টাকা কেজি দরে অর্থাৎ প্রতি মণ হাড়ের দাম ১২০ টাকা। এছাড়া প্রতিটি অ-কোষ ২০ থেকে ৩৫ টাকায় কেনার জন্য বলেছি। আমি ঘুরে ঘুরে দেখছি তারা কিনছে। তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে সøুইসগেট এলাকায় যাব। সেখানে পাইকাররা গাড়ি নিয়ে আসবে। তারা কিনে নিয়ে যাবে।’ এসব হাড় ও শিং দিয়ে কী হয়? জানতে চাইলে তিনি তেমন কোন উত্তর দিতে পারেননি। তবে বলেছেন, ‘বিদেশে রফতানি হয়। কিছু দেশের কারখানায় ব্যবহৃত হয়। শুনছি মেলামাইনের থালাবাটি বানানো হয়।’ তবে পচে গেলে এসবের কোন দাম নেই বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘রান্না করা মাংসের হাড়ও আমি কিনি। এবারও কিনব। এই হাড়ের আরও বেশি দাম পাওয়া যায়।’ রাজধানীর হাজারীবাগের গজমহল রোড ও কালুনগর রোড এলাকায় ৬০ থেকে ৭০টি হাড় কেনার মহাজনের দোকান বা আড়ৎ রয়েছে। যাকে ‘হাড্ডি পট্টি’ বলে সবাই। কোরবানি উপলক্ষে এসব হাড়ের আড়তে শিশুসহ নারী-পুরুষ হাড় বিক্রি করছে। সেখানে ট্রাকে ও পিকআপ ভ্যানে করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাড়, শিং ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আসতে দেখা গেছে। গজমহল রোডের মেসার্স আবিদ এঅ্যান্ড ব্রাদার্স আড়তের মালিক ভোলা মিয়া বলেন, ‘স্বাধীনের পরপরই আমি এই ব্যবসা শুরু করি। আমি হাড় ও শিং কিনি। অপসোনিন কোম্পানির সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা প্রতিবছর আমার কাছ থেকে হাড় নিয়ে যায়। সংগৃহীত হাড় গাড়িতে করে বরিশালে পাঠাব।’ ভোলা মিয়া আরও জানান, ‘রোদে দিয়ে হাড় শুকানো হবে। তারপর ট্রাকে করে পাঠাব। দেশে মোট প্রায় ২শ’টি ওষুধ কোম্পানি ও হারবাল প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য প্রতিমাসে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি ক্যাপসুল সেলের চাহিদা রয়েছে। অপসোনিনের গ্লোবাল ক্যাপসুল কোম্পানি গুঁড়া করা হাড় থেকে ক্যাপসুলের সেল তৈরি করে। এসব কাজে প্রতিমাসেই প্রয়োজন হয় কয়েক শ’ টন পশুর হাড়।’ তিনি বলেন, ‘আমি প্রতি কেজি হাড় ৮ টাকায় কিনছি। বিক্রি প্রক্রিয়াজাত ও পাঠানো পর্যন্ত প্রতি কেজিতে আমার ১৮ টাকা খরচ হবে। অপসোনিন আমার কাছ থেকে প্রতি কেজি ২৩ টাকা করে ক্রয় করবে ।’ ভোলা মিয়া বলেন, ‘পশুর হাড় দিয়ে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ক্যাপসুলের কভার, নাড়ি দিয়ে অপারেশনের সুতা, রক্ত দিয়ে পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে সাবান, পায়ের ক্ষুরা দিয়ে অডিওভিডিওর ক্লিপ। এছাড়া জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য সুসেড রুলসহ কয়েক ধরনের খাবার তৈরি হয় এই অ-কোষ দিয়ে।’তিনি বলেন, ‘সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও হাড় ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া জার্মানি ও ইতালিতে ব্যাপক চাহিদা থাকায় পশুর শিং সরবরাহ করা হয়ে থাকে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বিদেশে এসব পাঠান।’ নেপালী বাবু নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি প্রতিবছর এসব কিনি। এবারও কিনছি। সাতপর্দার (পাকস্থলী) অনেক দাম। কিন্তু আমরা পাই না। বিদেশে এগুলো অনেক দাম দিয়ে কেনা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাড় সাধারণত মুরগি ও মাছের খাবার, সার, চিরুনি ও পোশাকের বোতাম তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়।’ তিনি বলেন, ‘রগ (অ-কোষ) জাপান, চীন ও কোরিয়া, মিয়ানমার ও হংকংয়ে রফতানি করা হয়। এটা দিয়ে পাউডার বানায় বিদেশীরা। গরু ও মহিষের অ-কোষ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা টনে বিক্রি হয়ে থাকে।’ ভোলা ও বাবু জানান, ‘তারা একসপ্তাহে তিন থেকে চার লাখ টাকার মাল (অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ) ক্রয় করবেন। প্রতিবছরই তারা এগুলো কেনেন। এক সপ্তাহ শুকানোর পর এগুলো ওষুধ কোম্পানি ও রফতানিকারকদের কাছে বিক্রি করবেন। তারা জানান, পশু জবাইয়ের পর একটি মাঝারি আকারের গরুর ১৫ থেকে ২০ কেজি হাড় ফেলে দেয়া হয়। প্রতিদিন এই হাড় নিয়ে বাণিজ্য হয় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয় ১২ লাখ টাকার। শুধু কোরবানির ঈদ ও পরবর্তী ১ মাসে সারা দেশে প্রায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন পশুর হাড় সংগ্রহ করা হয়। গরুর শিংসহ হাড় বিক্রিতে প্রতিবছর ১০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, বরিশাল, রাজশাহীসহ বড় শহরগুলো থেকে কেনার পর এগুলো প্রক্রিয়াজাত করা হয়। রফতানিকারকরা এসে আড়তদারদের কাছ থেকে নিয়ে যায়।
×