ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাবির ৭ ছাত্র বহিষ্কৃত ;###;অবশ্য জামিনে মুক্ত হিযবুত তাহীরের প্রতিষ্ঠাতা ঢাবি শিক্ষক আছেন বহাল তবিয়তে

উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে জঙ্গী শনাক্তকরণ

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে জঙ্গী  শনাক্তকরণ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পুরোদমে চলছে জঙ্গীবাদে জড়িতদের শনাক্ত করার কাজ। সম্প্রতি জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার দায়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত ছাত্রকে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বহিষ্কৃতদের মধ্যে পাঁচ জনই নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সদস্য বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। নিষিদ্ধ এই জঙ্গী সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হলেও জঙ্গী সংগঠনের মাধ্যমে দেশে জঙ্গীবাদের আধুনিক ধারা চালুর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে এখনও দায়িত্বরত রয়েছেন। অথচ তিনি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়েরকৃত মামলায় জেল খেটেছেন। পরবর্তীতে জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সুযোগ পান। যোগদানের পর বকেয়া যাবতীয় সুযোগ সুবিধাও পেয়েছেন তিনি। এমন ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাড়াও বিভিন্ন মহলে সমালোচনা চলছে। শিক্ষক গোলাম মাওলাসহ অনেকেই আগে জামিনে ছাড়া পেলেও সম্প্রতি জঙ্গীদের জামিন পাওয়ার রেকর্ড আগের তুলনায় কমে এসেছে। আপীল বিভাগ এক জঙ্গীর জামিন আবেদন বাতিল করায় জঙ্গীদের জামিন না পাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আপীল বিভাগের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরাও। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জঙ্গীবাদে জড়িত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি জঙ্গীবাদে জড়িতদের শনাক্তের কাজ করে যাচ্ছে। কমিটি প্রথমেই সন্দেহভাজন জঙ্গীদের একটি তালিকা তৈরি করছে। সেই তালিকা মোতাবেক তদন্ত চলছে। তদন্তে যাদের জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ মিলছে, শুধু তাদের বিষয়েই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাবি কর্তৃপক্ষ জঙ্গীবাদে জড়িত সন্দেহভাজনদের দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করে। তালিকা মোতাবেক তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যেই তদন্তে সাত শিক্ষার্থীর জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঢাবি সূত্রে জানা গেছে, বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীরা যাদের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে, তাদের বিষয়েও তদন্ত চলছে। ওই সাত শিক্ষার্থীর মধ্যে পাঁচ জনই নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত। বহিষ্কৃতরা নিজ নিজ বিভাগ, সহপাঠী, পরিচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করেছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী কিছুটা হলেও জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের পর পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জঙ্গীবাদ নির্মূল করা যায়নি। বৃহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সূত্র বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার আহ্বান জানিয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেছেন, কোন জঙ্গী যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, তাহলে তাদের কোন প্রকার হয়রানি করা হবে না। পুলিশ প্রধানের এ বক্তব্যের পর উত্তরাঞ্চলে হিযবুত তাহরীরের দুই নেতা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। যদিও এর পর আর কোন জঙ্গীর আত্মসমর্পণের তথ্য পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন আহ্বানে বহিষ্কৃতদের শুধু নাম প্রকাশ করা হয়েছে। বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। বহিষ্কৃতদের সামাজিক ও পারিবারিকসহ নানা বিষয়াদি চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কারণ বহিষ্কৃত ছাত্ররা স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদি না ফেরে সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নেবে। এজন্য বহিষ্কৃতদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে দেয়া আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের একটি বিভাগের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, শিকড় তুলে ফেলা সম্ভব না হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জঙ্গীবাদের বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়। কারণ নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে শিক্ষার্থীরা বহিষ্কৃত হয়েছে, অথচ নিষিদ্ধ এই জঙ্গী সংগঠনের মাধ্যমে দেশে আধুনিক জঙ্গীবাদের ধারা চালুকারী খোদ ঢাবি শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা শিক্ষক হিসেবে বহাল রয়েছেন। তিনি সন্ত্রাস দমন আইনে দায়ের করা গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন। সেই মামলার জামিনপ্রাপ্ত আসামি হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। জামিনে বের হওয়ার পর এমন একজন শিক্ষক কিভাবে আবার পেশায় বহাল হন, সেটি রীতিমতো ভাবনার বিষয়। যোগদানের পর জেলে থাকা অবস্থায় বকেয়া বেতন-ভাতাদিও পেয়েছেন। ব্যবস্থাপনা বিভাগের যে দুই ছাত্র হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ের বহিষ্কৃত হয়েছে, তাদের সঙ্গে অধ্যাপক গোলাম মাওলার যোগাযোগ ছিল কিনা সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা দরকার। ওই দুই ছাত্র গোলাম মাওলার হাত ধরে হিযবুত তাহরীরের প্রবেশ করেছিল কিনা তাও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। গাছের ডাল না ছেঁটে মূল উৎপাটন করা প্রয়োজন। অন্যথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গীবাদ নির্মূলকরণ প্রক্রিয়া ভেস্তে যাওয়া অসম্ভব নয়। জঙ্গী সংগঠনটি গঠনের নেপথ্যে ॥ গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৩ সালে পূর্ব জেরুজালেমের সাবেক বিচারক তাকিউদ্দিন আল-নাবানী হিযবুত তাহরীর নামের সংগঠনটি গঠন করেন। পরবর্তীতে জেরুজালেমের প্রধান মুফতি শেখ হাজী আমিন আল হোসাইনীর উগ্র মতবাদে সংগঠনটি প্রভাবিত হয়। মুফতী হোসাইনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের সহযোগী ছিলেন। পরবর্তীতে হিযবুত তাহরীর বিশ্বে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। ২০০২ সালে ডেনমার্কে ইহুদী দেখামাত্র হত্যার ঘোষণা দিয়ে লিফলেট বিতরণ করেছিল এই হিযবুত তাহরীর। এছাড়া ২০০৩ সালে তেলআবিবে একটি মদের দোকানে বোমা হামলা চালিয়ে ৩ জনকে হত্যা, ২০০৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর উজবেকিস্তানের মার্কিন ও ইসরাইলী দূতাবাসে আত্মঘাতী বোমা হামলা, ২০০৪ সালে তাজিকিস্তানের তাসখন্দে বোমা হামলা করে ৪৭ জনকে হত্যার জন্য হিযবুত তাহরীরকে দায়ী করা হয়। এছাড়া আল কায়েদা, তালেবান ও বৈশ্বিক জিহাদের জন্য কর্মী সংগ্রহের কাজের সঙ্গে হিযবুত তাহরীর জড়িত বলে আন্তর্জাতিকভাবে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালে পাকিস্তান সরকার সেদেশে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বাংলাদেশে বিস্তার ॥ গোয়েন্দা সূত্র মতে, এদেশে জঙ্গী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ঢাবি ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালীন নব্বই দশকের শেষ দিকে তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি লাভ করে লন্ডনে যান। সেখানে পড়াকালীন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে তিনি সংগঠনটির সাংগঠনিক কার্যক্রমেও সেখানে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ করেন। নাগরিকত্ব লাভের পর তিনি পুরোপুরি হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে জড়িত হন। কারণ ব্রিটেনে সংগঠনটি নিষিদ্ধ নয়। এজন্য তিনি অনেকটা খোলামেলাভাবেই সংগঠনটির কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে সেদেশের বেশ কিছু বির্তকিত লোকজনের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বিষয়টি ব্রিটিশ পুলিশ প্রথম আমলে নেয়নি। তার কাছে দিন দিন নানা পেশার লোকজনের যাতায়াত বেড়ে যাওয়ায় পুলিশের সন্দেহ বাড়ে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তার ওপর নজরদারি শুরু করে। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সৈয়দ গোলাম মাওলাকে আটকও করেছিল। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মুখেও ব্রিটিশ গোয়েন্দারা গোলাম মাওলার জঙ্গী কানেকশনের বিষয়টি প্রমাণে ব্যর্থ হয়। তার ওপর নজরদারি দিন দিন বাড়তে থাকে। গোয়েন্দা নজরদারির কারণে তার লন্ডন বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে। দেশে কার্যক্রম শুরু ॥ অধ্যাপক গোলাম মাওলা শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে পুরনো কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক হিসেবেই যোগাদান করেন। ২০০২ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হিযবুত তাহরীরের বাংলাদেশ শাখা গঠনের চেষ্টা করেন তিনি। যোগাযোগ করতে থাকেন সমমনা বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গেও কথা হয় তার। এ দুই শিক্ষক ও সমমনা ছাত্রদের নিয়ে সংগঠনটির কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা চালাতে থাকে। ওই সময় তারা দেশী-বিদেশী এনজিওসহ সমমনা সরকারী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে থাকেন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে জঙ্গী গোড়াপত্তন ॥ হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে পরিচালিত এনজিও এ্যাকশন এইডের পলিসি এনালিস্ট শেখ তৌফিকের সঙ্গে। পরবর্তীতে শেখ তৌফিক ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার হাত ধরেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তন হয়। পরবর্তীতে ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যার গুলশানে হলি আর্টিজানে ও শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতসহ অনেক হামলা এবং হত্যাকা- ছাড়াও বিদেশে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশ পায়। এর পর থেকেই জঙ্গী কর্মকা-ের কারণে ব্যাপক আলোচনায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। কমিটি গঠন ॥ সূত্র বলছে, শেখ তৌফিকের সহায়তায়ই ২০০২ সালে উত্তরায় ওই এনজিওটির অফিসে হিযবুত তাহরীরের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে আইবিএ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদকে প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র, কাজী মোরশেদুল হককে যুগ্ম সমন্বয়কারী, ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলাকে সিনিয়র উপদেষ্টা, বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. শেখ তৌফিককে রাজনৈতিক উপদেষ্টা, প্রিন্সিপাল মাওলানা মামুনুর রশীদকে গণসংযোগ সচিব, অধ্যাপক মুস্তফা মিনহাজকে মিডিয়া ও প্রচার সচিব, সাখাওয়াত হোসেন, মামুনুর রশীদ আনসারী, আহাম্মদ জামান, ডা. সাঈদ, মনির হোসেন, ডা. গোলাম মোস্তফা ও শাহজালাল মিয়াকে কার্যকরী পরিষদের সদস্য করা হয়। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েই কার্যক্রম শুরু ও ছাত্র শিবিরের সহযোগিতা ॥ ১৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি দিয়েই শুরু হয় হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম। বেশ কিছু দিন এনজিওটি হিযবুত তাহরীরের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর পরই সংগঠনটি বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে একটি গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশে দলটির আনুষ্ঠানিক কার্যকম চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। একমাস পর মার্চ থেকেই হিযবুত তাহরীর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের হাত ধরেই পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মাহবুবুল হক রিপন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি হিযবুত তাহরীরের গোপন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ফেলোশিপ দিয়ে থাইল্যান্ডে যান। সেখানে থাকার সময় তার সঙ্গেও দেশের রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশে ফিরে হিযবুত তাহরীরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকা- বাস্তবায়নে নেপথ্যে থেকে কাজ করতে থাকেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি হিযবুত তাহরীরের নীতি গবেষণা কেন্দ্রের অন্যতম ট্রাস্টি হন। রাজধানীতে তেরোটি গোপন আস্তানা ছিল সংগঠনটির। দলের কার্যক্রম শুরুর পর দলীয় কার্যালয় স্থাপন জরুরী হয়ে পড়ে। ওই সময় সংগঠনটিকে কার্যক্রম চালানোর জন্য ছাত্রশিবির তাদের নিজস্ব ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ২৩৪ নম্বর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের খায়রুন্নেসা ভবনে অফিস খোলার জায়গা দেয়। পরবর্তীতে পুরানা পল্টনের ৫৫/এ এএইচএম সিদ্দিক ম্যানশনের পঞ্চম তলায় হিযবুত তাহরীর প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করে। রাজধানীতে ঢাবি, বুয়েটসহ সব সরকারী বেসরকারী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম চলমান আছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংগঠনটির কমিটি রয়েছে। আস্তানার মধ্যে পাঁচটিতে নিয়মিত গোপন বৈঠক হতো। বাকি আট আস্তানার কার্যক্রম চলত পাঠচক্রের আড়ালে। ঢাবি, বুয়েট ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আস্তানার পাশাপাশি ঢাকাতেই অন্যান্য আস্তানা ছিল। ধানম-ি ২৭ নম্বর রোড়ের অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ধানম-ির এআইবিটিতে হিযবুত তাহরীরের মহিলা শাখার কার্যক্রম ছিল। এর নেতৃত্বে ছিলেন ফাহমিদা ফারহানা খানম। আস্তানাগুলোতে হাল্কা শারীরিক কসরত, মানসিকভাবে সাহসী করতে নানা বয়ান ও নতুন কর্মী সংগ্রহের পদ্ধতি সংক্রান্ত আলোচনা হতো। টার্গেট ছিল উচ্চ শিক্ষিত ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরা ॥ জঙ্গী সংগঠনটির টার্গেট ছিল উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এমন টার্গেটে পড়েই সংগঠনটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে পরবর্তীতে গ্রেফতার হয় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খানের ছেলে রিসাদ কামাল খান ও তার এক বন্ধুসহ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষার্থী। দেশী-বিদেশী জঙ্গী ও উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ॥ হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে পরবর্তীতে হুজি, জেএমবি, লস্কর-ই-তৈয়বা, জৈশ-ই-মোস্তফা, উলফা, কামতাপুর লিবারেশন ফ্রন্ট, আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্সসহ বহু দেশী-বিদেশী উগ্র ও জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। নিষিদ্ধের পর অভিযান ॥ ২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার দায়ে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৩ দেশে জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর সারাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়েরের পাশাপাশি সংগঠনটির নেতাকর্মীদের গ্রেফতারে অভিযান চলে আসছে। ওই সময়ই সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় থেকে বিপুল সংখ্যক জিহাদী বই, উগ্র ভাষায় লেখা লিফলেট, ট্রেনিং বেল্ট, বিভিন্ন দেশের জঙ্গী প্রশিক্ষণের ভিডিও ফুটেজসহ ৪০ প্রকারের আলামত উদ্ধার হয়েছিল পুলিশের অভিযানে। জঙ্গী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতাসহ গ্রেফতার ও জামিন ॥ নিষিদ্ধ হওয়ার পর ধারাবাহিক অভিযানে রাজধানীর উত্তরা মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার হয় অধ্যাপক গোলাম মাওলা। পিতার নাম তাজুল ইসলাম। বাড়ি কুমিল্লার সদর দক্ষিণ থানাধীন পূর্ব আশকামতাপুর গ্রামে। রিমান্ড শেষে ২০১০ সালের ১০ জুলাই তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায় আদালত। তার আগে গ্রেফতার হয় ঢাবি আইবিএর শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ। তার বিরুদ্ধে উত্তরা থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে তিনটি মামলা রয়েছে। তাকেও রিমান্ড শেষে আদালতের নির্দেশে ২০১০ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। ওই সময় সারাদেশ থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মীসহ অন্তত তিন শ’ সদস্য গ্রেফতার হয়েছিল। সূত্র বলছে, যাদের অধিকাংশই বর্তমানে জামিনে মুক্ত। জামিনপ্রাপ্তদেরই একজন অধ্যাপক গোলাম মাওলা। জামিনে থেকেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ঢাবি ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যানের বক্তব্য ॥ জঙ্গী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। বর্তমানে গোলাম মাওলা ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার দায়িত্ব পালনের বিষয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আলী আক্কাস জনকণ্ঠকে বলেন, অধ্যাপক মাওলা জামিনে রয়েছেন। তিনি শিক্ষক হিসেবে বহাল রয়েছেন। নিয়মানুযায়ী শিক্ষক হিসেবে যেসব কর্মকা- চালানোর কথা তা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। গোলাম মাওলার বক্তব্য ॥ অধ্যাপক গোলাম মাওলার কাছে বাংলাদেশ জঙ্গী সংগঠনটি চালুর করাসহ বহু বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি দীর্ঘ কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। হিযবুত তাহরীর গঠন করা তার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল কিনা সে প্রশ্নের জবাবেও তিনি নিরুত্তর থেকেছেন। বলেছেন, তিনি আর সংগঠনটি সম্পর্কে কোন খোঁজ খবর রাখেন না। এমনকি সংগঠনের কোন নেতাকর্মীর সঙ্গেও নয়। তবে সংগঠনের গ্রেফতার হওয়া অধিকাংশ নেতাকর্মীই জামিনে রয়েছেন বলে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমের বরাত দিয়ে মন্তব্য করেন। তিনি যে মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন, সেটি রাজনৈতিক মামলা ছিল বলে তিনি দাবি করেছেন। ওই মামলায় প্রতিমাসেই তিনি হাজিরা দেন। ঢাবি উপাচার্যের বক্তব্য ॥ এ ব্যাপারে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অধ্যাপক গোলাম মাওলা উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। জামিনে থেকেই তিনি শিক্ষকতা পেশায় বহাল রয়েছেন। জামিনে থেকে একটি জঙ্গী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় বহাল থাকতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, এটি আইনের বিষয়। তবে গোলাম মাওলা বার বারই তার সঙ্গে হিযবুত তাহরীরের কোন যোগাযোগ নেই বলে দাবি করে আসছেন। জঙ্গীবাদে জড়িত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিষ্কৃত ছাত্রদের মধ্যে ব্যবস্থাপনা বিভাগের দুই ছাত্র অধ্যাপক গোলাম মাওলার মাধ্যমে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। সার্বিক বিষয়টি সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও নজর রাখছে বলেও জানান উপাচার্য। হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ অপর নেতা ঢাবি আইবিএ’র শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ বাধ্যতামূলক অবসরে রয়েছেন। তবে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। চলমান মামলার রায় অনুযায়ী দুই শিক্ষকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জঙ্গীদের জামিন পাওয়ার সংখ্যা হ্রাস ॥ বর্তমানে জামিনে মুক্ত হয়ে প্রায় আট শ’ জঙ্গী লাপাত্তা হয়ে আছে। চলমান সাম্প্রতিক অভিযানে শতাধিক জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। তাদের মধ্যে পলাতক জঙ্গীও রয়েছে। জামিনের পর আত্মগোপনে চলে যাওয়া জঙ্গীদের অধিকাংশই গত কয়েক বছরে নানা কারণে জামিন পেয়েছে। তবে সম্প্রতি জঙ্গীদের জামিন পাওয়ার সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। বিশেষ করে গত ২২ আগস্ট আপীল বিভাগ কর্তৃক সন্দেহভাজন জঙ্গী সাবেক এক নৌবাহিনী কমান্ডারের ছেলে ফিদা মুনতাসির সাকেরের জামিন তিন মাসের জন্য স্থগিত হওয়ার বিষয়টি জঙ্গীদের জামিন না দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব ফেলছে। বিষয়টি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। গত ৬ জুন ফিদা মুনতাসিরকে হাইকোর্টের বিচারপতি ফরিদ আহমেদ ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ ছয় মাসের জামিন দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মোমতাজ উদ্দিন ফকির জামিনের ওই আদেশের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করেন। শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালত জামিন স্থগিত করে দেন। ফিদা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সমন্বয়ক ও আইএসের সদস্য সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করছিল বলে পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে। ২০১৫ সালের ৭ জুন বনানী ডিওএইচএস থেকে ফিদা আটক হয়। তার কাছ থেকে জঙ্গীবাদের নানা আলামত জব্দ হয়। ২০১৫ সালের ১৮ জুন উত্তরা পশ্চিম থানা এবং ১২ জুলাই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় দায়ের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের দুই মামলায় ফিদাকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। জঙ্গীদের জামিনের বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গীদের সবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। সে হিসেব মোতাবেক সম্প্রতি জঙ্গীদের জামিন পাওয়ার সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। আগের যেকোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে জঙ্গীদের জামিন কম হচ্ছে। সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক এক জঙ্গীর জামিন আদেশ বাতিল হয়েছে। যা জঙ্গীদের জামিন রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। প্রকৃত জঙ্গীরা জামিন না পেলে জঙ্গীবাদ দমন আরও সহজ হবে।
×