ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

থাই গণভোটে সেনাশক্তিই সংহত হলো

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

থাই গণভোটে সেনাশক্তিই সংহত হলো

গত ৮০ বছরে থাইল্যান্ডে এক ডজনেরও বেশি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। তা থেকে অন্তত একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে দাঁড়ায় যে থাই জেনারেলরা গণতন্ত্রবান্ধব নন এবং কখনও ছিলেন না। তাই গত ৭ আগস্ট কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে অনুষ্ঠিত ‘গণভোটে’ সেনা সমর্থিত সংবিধান অনুমোদন করার জন্য দেশের শাসক জান্তা যখন দেশবাসীকে অভিনন্দন জানাল তখন সেটা শুধু বেসুরোই ঠেকেনি উপরন্তু তা গণতন্ত্রের চরম প্রহসন বলেও মনে হয়েছিল। থাইল্যান্ডে সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল ২০১৪ সালে। সে অভ্যুত্থানের পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসেন সাবেক সেনাপ্রধান প্রাইয়ুথ চানোচা। গণভোট হয়ে যাওয়ার পর চানোচা জোর দিয়ে বলেন, এতে যে নতুন সনদ পাওয়া গেল তাতে এক দশকের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অবসান হবে এবং আগামী বছর নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি হলো এতে থাই সমাজের গভীর বিভাজন জোড়া তো লাগবেই না বরং তা আরও বৃদ্ধি পাবে। থাইল্যান্ডের নতুন সংবিধানটি হলো দেশের ২০তম সংবিধান। এতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বছরের পর বছর ধরে সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নির্বাচনের যে নতুন বিধিমালা করা হয়েছে তাতে দুর্বল কোয়ালিশন সরকারই ক্ষমতায় আসবে এবং তার ওপর খবরদারি করে বেড়াবে জান্তার বন্ধুদের নিয়ে ঠাসা বিভিন্ন সংস্থা। জেনারেলরা আড়াই শ’ সদস্যের সিনেট নিজেরাই ঠিক করে দেবেন। কোন সরকারই যাতে ২০ বছরের সংস্কার কর্মসূচী থেকে বিচ্যুত না হতে পারে তা সুনিশ্চিত করার দায়িত্বে তারা থাকবে। নিজেদের পছন্দের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য তাদের জন্য পার্লামেন্টের নিম্ন পরিষদের এক-চতুর্থাংশ সদস্যকে রাজি করালেই চলবে। বলাবাহুল্য, থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য এমপি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সংবিধান সংশোধনে বাধা সৃষ্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থায় নাগরিক অধিকার সংগঠনসমূহ এবং গণতন্ত্রের অন্যান্য ধারক-বাহকরা হতবাক হয়ে গেছেন। তাদের ধারণা ছিল জান্তার এই পরিকল্পনা প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়বে। কিন্তু দেখা গেল ৬১ শতাংশ ভোট সংবিধান সংশোধনের পক্ষে পড়েছে। সেনা শাসনের বিরোধিতা সেখানে প্রবলতম সেই পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ ইসানে ভোটাররা বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। তবে দৃশ্যমান প্রত্যাখ্যানের নজির সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণের মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশগুলোতে যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই গণভোট স্মরণ করিয়ে দেয় যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেক থাই নাগরিক নিজেদের স্বার্থের অনুকূল দেখলে সামরিক শাসন দিব্যি হজম করতে পারে। শহরাঞ্চলের প্রচুর মানুষ সাবেক জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার রায়ে যাওয়া প্রভাব মুছে ফেলার ব্যাপারে জান্তার মতো অভিন্ন আকাক্সক্ষা পোষণ করে। স্মরণে রাখা ভাল যে, থাকসিন এখন প্রবাস জীবনযাপন করছেন। শহরের এলিট শ্রেণী বলে যে তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ চালাতেন। তবে এটা ঠিক যে থাকসিন গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে দারুণ জনপ্রিয়। তার দল ২০০১ সাল থেকে শুরু করে প্রতিটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। নতুন নির্বাচনী বিধিতে এই দলটি যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা অসুবিধায় পড়েছে অন্য আর কোন দল পড়েনি। জেনারেলদের বিরোধী পক্ষগুলোকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছিল যে গণভোটে না ভোট বেশি পড়লে সেনাবাহিনী এমন এক সনদ চাপিয়ে দেবে যা তাদের জন্য আরও খারাপ হবে। মোট ভোট পড়েছিল ৫৯ শতাংশ। তা থেকে বোঝা যায় অনেক থাইয়ের কাছে ভাল কিছু বেছে নেয়ার উপায় ছিল না। নয়া সংবিধানের তাৎপর্য কি বা কতখানি সে সম্পর্কে অনেক ভোটারেরই ধারণা অতিসীমিত। গণভোট যেমন প্রহসনমূলকভাবে পরিচালিত হয়েছে তাতে তাদের ইচ্ছাকৃতভাবেই অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। জান্তা সরকার বিরোধীদের সংবিধানের সমালোচনা করা নিষিদ্ধ করে দেয়। সমালোচনা করলেই দশ বছরের কারাদ-ের খড়গ। গ্রেফতার করা হয় সেই সব ছাত্রকে যারা এর ঘাটতি বা ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। এত কিছুর পরও জেনারেলরা তাদের কথিত বিজয়ের অন্তসারশূন্যতা এবং জনগণের মধ্যে এই প্রহসনমূলক গণভোট নিয়ে ধূমায়িত ক্ষোভের কথা বিস্মৃত হয়ে গেছে। থাইল্যান্ডের বড় রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান প্রত্যাখ্যান করেছে তবে গণভোটের ফল মেনে নিয়েছে। সম্ভবত আগামী বছরের নবেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে যদি না জেনারেলরা তা স্থগিত রাখার কোন অজুহাত খুঁজে পায়। গণভোটের মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের এমন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে দেশ অগ্রগতির পথে রয়েছে। এতে থাইল্যান্ডের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিতে অল্প সময়ের জন্য নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হতে পারে। তবে যে দেশে দুর্বল সরকার শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থের হাতে জিম্মি সে দেশে অর্থনীতিকে টেনে তোলার এটা কোন আদর্শ উপায় হতে পারে না।
×