ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল প্রজেক্টর থেকে সিনেপ্লেক্স

হলে গিয়ে ছবি দেখা যেন স্মৃতির পাতা মেলে ধরা...

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

হলে গিয়ে ছবি দেখা যেন স্মৃতির পাতা মেলে ধরা...

সমুদ্র হক ॥ সিনেমা হল এখনও কিছু দেখা যায়। তবে সেই হলে গিয়ে সিনেমা দেখার লোক (দর্শক) আছে ক’জন! বলুন তো গত এক বছরে সিনেমা হলে গিয়ে কটি ছবি আপনি নিজে দেখেছেন! অথবা কতদিন আগে সিনেমা হলে গিয়ে শেষ কোন্ ছবিটি দেখেছেন। এর উত্তর খুঁজতে স্মৃতির পাতা মেলে ধরার পরও ধোঁয়াটে দেখা যাবে। সহজে মনে করা যাবে কি! সেদিনের কার্বন প্রজেক্টরের ৩৫ মিলিমিটার ফিল্মের রিল দিয়ে ছবি প্রদর্শন আজকাল উঠে যাচ্ছে। সিনেমা হলগুলোতে অনেকটা ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রজেক্টর দিয়ে ইদানিং বড় পর্দায় ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। তারপরও বর্তমানে ছায়াছবির সেই দর্শক এখন কোথায়! এবার নিকট অতীতের এক দৃশ্য- শহরের সিনেমা হলে ভাল বাংলা ছবি এসেছে। সকল শ্রেণীর দর্শক সেই ছবি দেখে চিত্ত-সুখ পেয়ে প্রশংসা করেছে। পরিবারের সদস্যরা সেই ছবি দেখে সুস্থ বিনোদনে আবেগ আপ্লুত। অন্যের কাছে ছবির গল্প বলে তাদেরও উৎসাহিত করছে। আরও একটু পিছনের এক দৃশ্য-ষাটের দশকের প্রথম ভাগ। সিনেমা হলে ছবি দেখার জন্য দর্শকদের ভিড় লেগেই থাকে। ভাল ছবি মুক্তি পেলে টিকেট পাওয়া সহজ ছিল না। কখনও ব্ল্যাকে কাটতে হতো টিকেট। সেই সব দিনে নায়ক-নায়িকা আর পরিচালকের নাম দেখে দর্শকের ভিড় বাড়ত। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে থেকে পরবর্তী সময়ে বাংলা ছবির কিংবদন্তি জুটি সুচিত্রা সেন-উত্তম কুমারের গগনচুম্বি জনপ্রিয়তা। বগুড়ার উত্তরা সিনেমা হলে সুচিত্রা-উত্তমের সাগরিকা ছবির পোস্টারে লিখা ‘প্রনয় মধুর ভূমিকায় আমাদের যুগল অভিনয়ের পথে সাগরিকা স্মরণীয় হয়ে রইল।’ তার নিচে যুগল স্বাক্ষর। পোস্টার দেখেই সেদিনের তরুণ-তরুণী ও মধ্যবয়সীদের হৃদকম্পন শুরু হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা এক সঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখে। সেদিনের কত ছবির কত সংলাপ ও গান দর্শকদের মুখে মুখে ফেরে। আজ এসব শুধুই স্মৃতির অধ্যায়। সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখা এখন এতটাই কমেছে যে অনেক জেলায় এখন আর সিনেমা হলই নেই। আশির দশকের শেষে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩শ’ ৯০টি। বর্তমানে সারাদেশে এই সংখ্যা মাত্র প্রায় ৩শ’। দিনে দিনে আরও কমছে। খোদ রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে সিনেমা হল কমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৩টিতে। ঐতিহ্যের গুলিস্তান সিনেমা হল ভেঙ্গে এখন গড়ে উঠেছে বিশাল কমপ্লেক্স। শ্যামলী ভেঙ্গে হয়েছে শপিং মল। জানা যায়, মতিঝিলের মধুমিতা, নিউমার্কেটের সমানে বলাকা, ফার্মগেটের সামনে আনন্দ সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ আর রাখতে চাইছেন না হলগুলো। উত্তরাঞ্চলের মধ্য নগরী বগুড়ার বড় সিনেমা হল উত্তরা, মেরিনা, মাধু মেট্রো ভেঙ্গে ইতোমধ্যে শপিং মল/মার্কেট কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। এক সিনেমা হলের প্রবীণ মালিক বললেন, এখন দর্শক টানবার মতো সিনেমা নির্মিত হয় না। কালে ভদ্রে দুই একটি ভাল ছবি নির্মিত হয় তবে তার দর্শক সবাই ড্রেস সার্কেল (ডিসি) বা রিয়ার স্টলের। বর্তমানে আগের দিনের মতো কার্বন প্রজেক্টরে ৩৫ মিলিমিটারের ফিল্ম রিল দিয়ে ছবি প্রদর্শিত হয় না। দেশীয় ছবি প্রদর্শনের জন্য প্রজেক্টর অনেকটা ডিজিটাল প্রযুক্তির। এই প্রজেক্টরে পেন ড্রাইভে ছবি চালানো হয়। যা প্রদর্শিত হয় বড় পর্দায়। আমদানিকারকগণ যে ছবি আনে তা প্রদর্শিত হয় আরেক ধরনের প্রজেক্টরে। ই-প্রজেক্টর ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযোগ থাকে। এই প্রজেক্টরে নেটের মাধ্যমে তাদের আমদানি করা ছবি প্রদর্শন করা যায়। এ জন্য একটি পাসওয়ার্ড আছে। যা আমদানিকারক নেটের সঙ্গে সংযোগ করে দেয়। তারপরও সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার দর্শক বাড়েনি। এর অন্যতম কারণ ভাল ছবির অভাব। আগে ফিল্ম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন (এফডিসি) থেকে বছরে শতাধিক ছবি নির্মিত হয়ে মুক্তি পেত। গত বছর ছবি মুক্তি পেয়েছে মাত্র ৩৮টি। ভাল ছবি নির্মাণের দক্ষ পরিচালকেরও অভাব। প্রতিভাবান অভিনেতা অভিনেত্রী এখন তেমন আসছে না। অনেক ছবি নির্মিত হচ্ছে নাটকের দৃশ্যায়ন ও মুভমেন্টের মতো। আর ছবির গল্পও উন্নত নয়। সিনেমা যদি নাটকের মতো হয় তাহলে দর্শক তা দেখবে কেন। এ জন্য তো টিভি চ্যানেলগুলোই আছে। অবশ্য টিভি চ্যানেলও যে ভাল নাটক দেখাচ্ছে তাও নয়। তারপরও বলতে হয়, নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভাল। বর্তমানে দেশের বড় শহরগুলোতে মাল্টিকমপ্লেক্স থিয়েটার ও সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা মহানগরীতে এ ধরনের সিনেপ্লেক্সে বিশ্বের নানা দেশের ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। এই সিনেপ্লেক্সের পরিবেশ উন্নত থাকায় বর্তমানের তরুণ-তরুণীরা সেখানে মুভি দেখতে যাচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত মুভি রিলিজ হচ্ছে। সেখানে এ দেশের বর্তমানের দু’য়েকটি বাংলা ছবি ছাড়া বাকিগুলো টিকতে পারছে না। এই সিনেপ্লেক্সগুলোর দর্শক তরুণ-তরুণীদের একটি বড় অংশ। আগেকার দিনের মতো সপরিবারে ছবি দেখার মতো অবস্থা এখনও সৃষ্টি করা যায়নি। এদিকে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের প্রতিটি জেলায় সিনেপ্লেক্স নির্মিত হবে। আধুনিক শপিং কমপ্লেক্সে একটি করে সিনেপ্লেক্স থাকবে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ। এই বিষয়ে কয়েকজন দর্শক বললেন, ভাল ছবির দর্শক এখনও আছে। বর্তমান প্রজন্ম নেটে ট্যাবে অতীত দিনের অনেক ছবি দেখে। বর্তমানের ছবি দেখে মেলাবার চেষ্টা করে কোনটি ভাল। সুস্থ বিনোদনের শিল্পসম্মত ভাল ছবি নির্মিত হলে তার দর্শক অবশ্যই থাকবে।
×