ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা...

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা...

মোরসালিন মিজান ॥ ভাদ্র মাস। তালপাকা গরম। যখন তখন বৃষ্টি। কাদা। এর পরও শরতের যে সৌন্দর্য, অস্বীকার করার সাধ্য কার? হ্যাঁ, ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলাদেশে আবারও এসেছে শরত। এরই মাঝে বদলে গেছে প্রকৃতি। নীল আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ। উড়ে বেড়াচ্ছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর নদীর কূল ঘেঁষে কাশের গুচ্ছ। মৃদু মন্দ বাতাসে দোল খাচ্ছে। দেখে মন ভাল হয়ে যায়। প্রকৃতিপ্রেমীরা সময়টা দারুণ উপভোগ করছেন। প্রিয় ঋতুর রং রূপে নিজেকে খুঁজছেন, যেমন খুঁজেছেন কবিরা। শিল্পীরা। শত গান কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে শরত। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ১ ভাদ্র থেকে সূচনা হয়েছে শরতের। প্রিয় ঋতুকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালীমালা-/নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।/এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/এসো নির্মল নীলপথে...। কবিগুরুর বর্ণনার সঙ্গে এখন মিলে যায় সব। কাশফুল শেফালীমালা নবীন ধানের মঞ্জরি এখন দৃশ্যমান হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। গ্রামে তো বটেই, রাজধানী শহরের বিভিন্ন প্রান্তে মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে শুভ্র সুন্দর কাশের গুচ্ছ। ফুটেছে সুগন্ধী শিউলি। প্রেমের কবি নজরুলকে এই ফুল খুব আকৃষ্ট করেছিল। শরত দেখতে গিয়ে শিউলি আর শিউলি দেখতে গিয়ে শরত দেখেছেন কবি। মুগ্ধ হয়ে লিখেছেনÑ এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে।/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে...। অন্যত্র কবির উচ্চারণÑ শিউলিতলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।/শেফালি পুলকে ঝ’রে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা...। আকাশেও শরতের রং রূপ। একটু ঘার উঁচু করে উপরের দিকে তাকালে চোখ মুগ্ধ হয়, মন ভরে যায়। গ্রামের সবুজ বন চিরহরিত বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে কী সুন্দর আকাশ দেখা যাচ্ছে! শহুরে বহুতল ভবন অট্টালিকার ভিড়েও দিব্যি চোখে পরে নীল আকাশ। সাদা মেঘের ভেলা। কবিগুরুর ভাষায়Ñ আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলাÑ/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাইÑ লুকোচুরি খেলা...। শরতে শুধু প্রকৃতি বদলায় না, মানুষের মনে নানা পরিবর্তন আসে। সেসব পরিবর্তনের কথা জানিয়ে কবিগুরু লিখেন- শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে।/আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে...। তার মানে, আনন্দের উপলক্ষ হয়ে আসে শরত। মনকে ভরিয়ে রাখে। নাকি কিছু লুকোনো বেদনাও হৃদয় খুঁড়ে তুলে আনে শরত? তা না হলে নজরুল কেন লিখবেনÑ শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই...। একই রকম বিরহের প্রকাশ ঘটিয়ে অন্যত্র কবি লিখেনÑ দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...। আকুতি শোনা যায় কবিগুরুর কণ্ঠেও। তিনি লিখেনÑ আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়।/ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো...। সব মিলিয়ে দারুণ এক ঋতু। এই ঋতুর বন্দনায় শান্তিনিকেতনে বিশেষ উৎসবের আয়োজন করতেন কবিগুরু। এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। তবে শরত বন্দনা থেমে নেই। প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে শরৎ উৎসবের আয়োজন করা হয়। একই রকম আয়োজন থাকে চারুকলার বকুল তলায়। ঠিক এই মুহূর্তে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিল্পীরা যে গান গাইছেন, সেখানেও শরত। প্রিয় ঋতু ঘিরে কত কত আবেগ! নৃত্যশিল্পীরা সেই আবেগের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন মঞ্চে। প্রতিবছর শরত উৎসব আয়োজনের কারণ ব্যাখ্যা করে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজারুল চৌধুরী সুইট জনকণ্ঠকে বলেন, ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। কবিগুরুর চোখ দিয়ে যে শরত দেখা, তার কোন তুলনা হয় না। নতুন প্রজন্মকে আমরা সেই শরত দেখাতে চাই। বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা দিতে চাই। এ চিন্তা থেকে উৎসব আয়োজন করা। এটি বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসব। এমন উৎসব বেশি বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
×