ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীর হাতে নিহত পুলিশ পরিবারের সদস্যদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন নারী পুলিশরাও

অনুদানের ক্ষণটি হয়ে উঠল শোকাবহ এক মুহূর্ত

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ আগস্ট ২০১৬

অনুদানের ক্ষণটি হয়ে উঠল শোকাবহ এক মুহূর্ত

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আর্থিক অনুদানসহ নানান সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে, কিন্তু মানুষের জীবনের বাস্তবতা- এসব কখনই পরিবারের সদস্য হারানোর বেদনা দূর করতে পারে না। এখানেও পারেনি গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় নিহত চার পুলিশের পরিবারের সদস্যদের। তাই তো অনেক সহযোগিতা পাওয়ার পরও নীরবে চোখের জল ফেলছিলেন তাঁরা। অনুষ্ঠানে অনেক মানুষের সামনে তারা গুমরে গুমরে কেঁদেছেন। আড়ালে চোখের জল মুছছিলেন। অনুদান নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে তারা নীরবে বেরিয়ে যান। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা সরকার ও পুলিশকে সব ধরনের সহযোগিতা করার জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ রুখতে তারাও কাজ করবেন বলে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন। সেইসঙ্গে হত্যাকারী জঙ্গীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও করে গেছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। নিহত চার পুলিশের পরিবারকে ৯০ লাখ টাকার অনুদান দেয়া হয়েছে। নিহতদের স্মৃতি ধরে রাখতে চার পুলিশ সদস্যের নামে চারটি সড়কের নামকরণ করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। নিহত চার পুলিশের নামে পৃথক চারটি রেজিস্টার খোলা হচ্ছে। তাতে নিহতদের বীরত্বগাঁথার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার তথ্য থাকবে। এছাড়া নিহতদের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা ছাড়াও তাদের পরিবারের সদস্যদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা করার ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক। বুধবার পুলিশ সদর দফতরে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে এবং কিশোরগঞ্জে শোলাকিয়া জঙ্গী হামলায় নিহত চার পুলিশ সদস্যকে ৯০ লাখ টাকা অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ডায়াস থেকে যখন নিহতদের নাম উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক তখন তাদের পরিবারের সদস্যরা গুমরে কেঁদে উঠছিলেন। অনেকেই মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে চোখের জল সরাচ্ছিলেন। শুধু অনেক মানুষের উপস্থিতির কারণে লোকলজ্জার ভয়ে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা হাউমাউ করে কাঁদতে পারেননি। তাদের চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছিল। বার বারই মনে হচ্ছিল নিহতদের অনেক সুখ দুঃখের স্মৃতি। অনেকেরই মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। নারী পুলিশের সদস্যরা বিষয়টি বুঝতে পেরে তাৎক্ষণিকভাবে অনেককে অনুদান গ্রহণের পর পরই সভাস্থল থেকে বাইরে নিয়ে যান। সেখানে তাদের মুক্ত বাতাসে মন ভোলানো নানা কথা শুনিয়েছেন নারী পুলিশের সদস্যরা। নিহতদের অনেকেরই মা তার ছেলে আর স্ত্রী তার স্বামী হারানোর বেদনা সইতে না পেরে সাহায্যকারী নারী পুলিশ সদস্যদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হকের কথায় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের মনে বাড়তি মনোবল ফিরে আসে। পুলিশ প্রধান বলেন, বাংলাদেশ থেকে জঙ্গীবাদের মূল উৎপাটন করা হবে। যত বড় ষড়যন্ত্রই হোক না কেন বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ঘাঁটি গাড়তে দেয়া হবে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই দেশ থেকে জঙ্গীবাদ নির্মূল করা হবে। জঙ্গীবাদ চিরতরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পুলিশ প্রস্তুত। ইতোমধ্যেই গুলশান ও শোলাকিয়ায় তার প্রমাণ রেখেছে পুলিশ। জঙ্গী দমনে আরও কঠোর হতে হবে। বাংলাদেশ সব ধর্মের মানুষের সম্প্রীতির দেশ। যত বড় ষড়যন্ত্রই হোক না কেন, বাংলাদেশে কোনদিনই জঙ্গীবাদকে ঘাঁটি গাড়তে দেয়া হবে না। এজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে যা যা করণীয় সবই করা হচ্ছে। জঙ্গীবাদ ঠেকাতে পুলিশ সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। কঠোর হস্তে জঙ্গীবাদ দমন করতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সে অনুযায়ী কাজও করছে। শোলাকিয়ায় ঈদের দিনে জঙ্গীদের হামলা ঠেকাতে পুলিশ অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং দূরদর্শী ভূমিকা পালন করেছে। অন্যথায় দেশে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। নিহত চার পুলিশ সদস্যের নামে চারটি সড়কের নামকরণের মধ্য দিয়ে তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় নিহত কনস্টেবল জহিরুল ইসলামের নামে তাঁর জন্মস্থান ময়মনসিংহে একটি সড়কের নামকরণের বিষয়ে আলোচনা চলছে। পুলিশ প্রধান নিহতরা যেসব জেলায় জন্ম নিয়েছিলেন, সেসব জেলার পুলিশ সুপারদের নিহতদের সম্পর্কে একটি পৃথক রেজিস্টার চালু করার নির্দেশ দেন। সেই রেজিস্টারে নিহত পুলিশ কর্মকর্তার বীরত্বের কথার পাশাপাশি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য থাকবে। যাতে পুলিশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা দাওয়াত পান। পাশাপাশি পুলিশ সুপাররা নিহতদের পরিবারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন। কোন ধরনের অসুবিধায় পুলিশ সুপারদের নিহতদের পরিবারের ডাকে সাড়া দিতেও নির্দেশ দেন পুলিশ মহাপরিদর্শক। যোগ্যতা অনুযায়ী নিহতদের পরিবারের সদস্যদের চাকরির কথা বলেন অনুদান প্রদানকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক এবং মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল আজম। ইতোপূর্বে গত ২ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনেও পুলিশ প্রধান জঙ্গীবাদ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসা ব্যক্তিদের পুলিশের তরফ থেকে সহযোগিতা করা হবে বলে ঘোষণা দেন। ওইদিন বাংলাদেশে ব্লগার, প্রকাশক, লেখকসহ প্রগতিশীল ব্যক্তিদের হত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া ও গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীকে মোস্টওয়ান্টেড হিসেবে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা করে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন পুলিশ প্রধান। প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলায় বনানী থানার ওসি সালাহ উদ্দিন খান ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার রবিউল করিম এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের কাছে জঙ্গী হামলায় নিহত হন কনস্টেবল আনসারুল হক ও জহিরুল ইসলামের পরিবারকে মোট ৯০ লাখ টাকার অনুদান দেয়া হয়। অনুদানের টাকা নগদ ও সঞ্চয়পত্র হিসেবে দেয়া হয়। এর মধ্যে ৭০ লাখ পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং ২০ লাখ মধুমতি ব্যাংকের তরফ থেকে দেয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে রবিউল করিমের মা করিমন্নেছাকে ৫ লাখ ও স্ত্রী উম্মে সালমাকে ১৫ লাখ এবং সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী রেমকিমকে ২০ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়। আর আনসারুলের স্ত্রী নুরুন্নাহারকে ৫০ হাজার নগদসহ সাড়ে সাত লাখ ও মা রাবেয়া আক্তারকে ৫০ হাজার নগদসহ সাড়ে ৭ লাখ এবং জহিরুলের মা জোবায়দা খাতুনকে নগদ অর্থসহ ১৫ লাখ টাকার অনুদান দেয়া হয়। পাশাপাশি মধুমতি ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রত্যেক পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে মোট ২০ লাখ টাকার অনুদান দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, গুলশান হামলায় নিহতদের সহযোগিতায় এক কোটি ১০ লাখ টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। গুলশানে হলি আর্টিজানের ঘটনায় নিহত রবিউল করিম ১৯৮৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার সদরের কাটিগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ত্রিশতম বিএসএস পরীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। নিহতের ৮ বছর বয়সী এক ছেলে এবং ১২ দিন বয়সী এক মেয়ে রয়েছে। একই ঘটনায় নিহত বনানী থানার ওসি সালাহ উদ্দিন খান ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জ সদরের ব্যাংকপাড়া গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি পুলিশ বাহিনীতে উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে যোগদান করেন। নিহতের ১৪ বছর বয়সী এক কন্যা ও ৬ বছর বয়সী এক মেয়ে রয়েছে। শোলাকিয়ায় ঈদের দিন জঙ্গী হামলায় নিহত কনস্টেবল আনছারুল হক ১৯৮৭ সালে নেত্রকোনা জেলার মদন থানাধীন দৌলতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ২০০৬ সালে পুলিশে যোগ দেন। তিনি নতুন বিবাহিত ছিলেন। অপরজন কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম ১৯৯২ সালে ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানাধীন ভাটিপাড়া গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। কয়েক বছর আগেই তিনি পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। এরা সবাই পেনশনের সুবিধা পাবেন বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।
×