ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের ফড়িং

পাখাজুড়ে কারুকাজ, রঙের বর্ণচ্ছটা- মনে করিয়ে দেয় শৈশব

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১০ আগস্ট ২০১৬

পাখাজুড়ে কারুকাজ, রঙের বর্ণচ্ছটা- মনে করিয়ে দেয় শৈশব

মোরসালিন মিজান ॥ ফড়িংয়ের আলাদা সৌন্দর্য। দারুণ ওড়াউড়ি। বাংলার প্রকৃতিজুড়ে আনন্দের হিল্লোল তুলে উড়ে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ায়। শৈশবে কে পিছু নেননি ফড়িংয়ের? আহা, কত গল্প! এমনকি বুড়ো বয়সে মন ফড়িং হতে চায়। তবে সম্প্রতি গবেষণার মন নিয়ে একদল মানুষ দেশের বিভিন্ন বন জঙ্গল চষে বেড়িয়েছেন। ক্যামেরাবন্দী করেছেন নানা জাতের, প্রজাতির ফড়িং। সেগুলো এখন প্রদর্শিত হচ্ছে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। ছবিগুলো দেখতে দেখতে চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। পেছনে ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়ে যায়। ফড়িং ওডোনাটা বর্গের অন্তর্গত এপিপ্রেকটা উপ-বর্গের পতঙ্গ। বর্তমানে সারাবিশ্বে ১৪ পরিবারের প্রায় ৫ হাজার ৬৮০ প্রজাতির ফড়িং দৃশ্যমান হয়। বাংলাদেশেও এদের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। ফড়িংয়ের ছিল একশ’র অধিক প্রজাতি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততোই সংখ্যাটি কমছে। অনেক চেনা জানা ফড়িংও আর দেখা যায় না। গ্রামে তাও কিছু আছে। শহরে এদের অবস্থা করুণ। ফড়িং নিয়ে আলাদা করে ভাববার লোকের সংখ্যাও কম। এ অবস্থায় দায়িত্ব নিয়েই এগিয়ে আসে জীবন বিকাশ কার্যক্রম নামের একটি বেসরকারী সংস্থার। বন অধিদফতরের সহযোগিতায় সংস্থাটি ২০১৩ সালের নবেম্বর মাস থেকে ফড়িং নিয়ে কাজ শুরু করে। চলতি বছরের মে মাসে শেষ হয় প্রথম পর্যায়ের কাজ। ইনভেন্টরি দলে ছিলেন মীর্জা শামীম আহসান হাবীব, মনোয়ার হোসেন, তানিয়া খান, মনোয়ার মাহমুদ জুয়েল, শাহতাবুল ইসলাম, সাইফ উদ্দিন সাইফ ও কাজী ফরহাদ ইকবাল। দেশের ৩০টি জেলা ঘুরে ফড়িংয়ের তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তোলার কাজ করেন তারা। সেসব ছবির ৩২টি লা গ্যালারির দেয়ালজুড়ে আছে। আলোকচিত্রীরা ৯ পরিবারের ৬২ প্রজাতির মোট তিন লাখ ৯৭২টি ছবি প্রাথমিক পর্যায়ে নথিভুক্ত করেন। এগুলোর ৩৩টি লাইবিলুলিডি পরিবারভুক্ত। কোয়েনাগ্রিনিডি পরিবারভুক্ত ১১টি। এসনিডি, গম্ফেডিয়া, ক্যালোপটেরিজিডি, ইউফেডি, পেন্ডটাইকনিমিডিডি পরিবারের আছে ৩টি করে। ২টি ক্লোরসাইফিডি ও ১টি লেসটিডি পরিবারের। ফড়িং যখন কমছে, হারিয়ে যাচ্ছে তখন চারটি নতুন প্রজাতির সন্ধান পেয়েছে ইনভেন্টরি দল। দলের এটি বড় সাফল্য বটে। এই ছবিগুলোও রয়েছে গ্যালারিতে। বিশেষ কৌতূহল নিয়ে দেখছেন সবাই। প্রদর্শনীতে ফড়িং দেখার পাশাপাশি আছে সংশ্লিষ্ট নানা তথ্য। ফ্রেমবন্দী প্রায় সব ফড়িংয়ের দীর্ঘ শরীর। দুই জোড়া স্বচ্ছ পাখা। পাখার গঠন রং ও কারুকাজই একটি ফড়িংয়ের সঙ্গে অন্যটির মূল পার্থক্য গড়ে দেয়। ছোট্ট পাখায় কত কত রং! আঁকিবুকি! কাছে গিয়ে দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। একটি ফড়িংয়ের পাখার রং গাঢ় নীল। গায়ের রংও তা-ই। দেখে মনে হয়, রঙের কৌটোয় ডুব দিয়ে এসেছে! ছবিটি বান্দরবানের লামা থেকে তোলা। আরেকটির পুরো শরীরজুড়ে হলুদ রঙের ছড়াছড়ি। লাল রংটিও খুব চোখে পড়ে। লাল রঙের একটি ফড়িংয়ের পাখা আবার সাদা। এটির দেখা মেলে মৌলভীবাজারে। আকারের দিক থেকেও ভিন্নতা আছে। একটি ফড়িংয়ের শরীরের অগ্রভাগ অপেক্ষাকৃত মোটা। গায়ে ডোরাকাটা দাগ। এ কারণে অনেকে এটিকে বাঘফড়িং বলে ডাকেন। কোন কোন ফড়িংয়ের পাখনা দেখতে আবার প্রজাপতির মতো। নতুন আবিষ্কৃত চারটি প্রজাতির মধ্যে রয়েছে রায়োথেমিস ট্রাইএঙ্গলারিস, টেট্রথেমিস পেন্ডাটাইপটেরা, অনিকোথেমিস টেস্টাসিয়া ডিসফায়ই ওয়ালি। দুটোর ছবি মৌলভীবাজার থেকে তুলেছেন তানিয়া খান। একটিকে বান্দরবানের থানচি থেকে খুঁজে নিয়েছেন মীর্জা শামীম আহসান হাবীব। আরেকটি বান্দরবানের লামা থেকে পাওয়া। ছবি তুলেছেন সাইফ উদ্দিন সাইফ। প্রথম দফায় ছবি তোলা হয় ভোলা, বগুড়া, চাঁদপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, ঢাকা, গাইবান্ধা, গাজীপুর, হবিগঞ্জ, যশোর, জয়পুরহাট, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, লক্ষ্মীপুর, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, নড়াইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, নাটোর, নেত্রকোনা, পঞ্চগড়, রাঙ্গামাটি, রংপুর, সুনামগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল ও বান্দরবান এলাকা থেকে। বেশকিছু ফড়িংয়ের দেখা মেলে লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক, সাতছড়ি ন্যাশনাল পার্ক, রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট, কাপ্তাই ন্যাশনাল পার্ক, হিমছড়ি ন্যাশনাল পার্ক, ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্ক, চর কুকরি মুকরি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য, মাধবকু- ইকো পার্ক ও মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। সর্বত্রই ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়িয়েছেন আলোকচিত্রীরা। ছবি তুলেছেন। নির্বাচিত ছবিগুলো নিয়ে এই প্রদর্শনী। যাদের ফড়িং নিয়ে বিশেষ আগ্রহ তাদের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে একটি বইও। প্রতিটি প্রজাতির পৃথক ট্যাক্সনমি এই প্রকাশনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রজাপতির প্রচলিত নাম, আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য, বাসস্থান ও বাস্তুবিদ্যা, প্রাচুর্যতা, ভৌগোলিক অবস্থান, বিশ্বব্যাপী আইইউসি তালিকার অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের ফড়িং ইনভেন্টরি প্রথম পর্বের উপস্থাপনা আগামী ১৩ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যাবে প্রদর্শনী। শুক্র ও শনিবার দেখা যাবে সকাল ৯টা থেকে ১২টা ও বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে ব্যতিক্রমী প্রদর্শনীটি ঘুরে আসা আনন্দের হবে। উপভোগ্য হবে। সুযোগটি নিশ্চয়ই কাজে লাগাবেন ফড়িংপ্রেমীরা।
×