ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেনাপোল স্থলবন্দর স্থবির প্রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৭ আগস্ট ২০১৬

বেনাপোল স্থলবন্দর স্থবির প্রায়

আবুল হোসেন, বেনাপোল ॥ বেনাপোল স্থলবন্দরের অধিকাংশ ক্রেন ও ফর্কলিফট অকেজো হওয়ায় হঠাৎ স্থবির হয়ে পড়েছে মালামাল খালাসের কাজ। আমদানিকারকরা সময়মতো পণ্য খালাস করতে না পারায় দেশের বৃহত্তম বন্দরটিতে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ পণ্যজট। বন্দরের গুদাম থেকে পণ্য বের করার পর নতুন পণ্য ঢোকাতে হচ্ছে। জায়গার এ সঙ্কটের কারণে পণ্য বোঝাই ট্রাক বন্দরের অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে থাকছে দিনের পর দিন। ট্রাক থেকে পণ্য নামানোর অনুমতি মিললেও ক্রেন মিলছে না। ফলে জায়গা ও ক্রেন সঙ্কটে বিপাকে পড়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। বন্দর ব্যবহারকারীদের মেশিনারিসহ ভারি মালামাল লোড-আনলোডের সময় দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থাকতে হয় সিরিয়াল দিয়ে। বন্দর-সংশ্লিষ্টরা জানান, শিল্প-কলকারখানা, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বেশিরভাগ মেশিনারিজ আমদানি হয় বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে। ক্রেন ও ফর্কলিফট ছাড়া এ জাতীয় পণ্য বন্দরে আনলোড ও বন্দর থেকে খালাস নেয়া সম্ভব না। মংলাবন্দর থেকে ২০০২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বেনাপোল বন্দরকে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সে সময় বহু পুরনো ক্রেন ও ফর্কলিফট মংলাবন্দর থেকে ভাড়া করে এনে এই বন্দরের কাজ চালানো হতো। ২০১০ সালের ২১ মার্চ বেনাপোল স্থলবন্দরের পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঢাকার মহাখালীর মেসার্স এসআইএস (সীস) লজিস্টিক্যাল সিস্টেমের (জেভি) পাঁচ বছর মেয়াদী চুক্তি হয়। ১ আগস্ট থেকে তারা বেনাপোল স্থলবন্দরে বেসরকারী কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পায়। তারা ১৬টি ফর্কলিফট ও পাঁচটি ক্রেন দিয়ে বন্দরের মালামাল ওঠানো-নামানোর কাজ শুরু করে। ওই বছরের ১০ নবেম্বর আরও ছয়টি নতুন ফর্কলিফট নিয়ে আসে কোম্পানিটি। কিছুদিন কাজ করার পর এসব ফর্কলিফট ও ক্রেন অকেজো হওয়া শুরু করে। কিন্তু এগুলো মেরামতের কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচটি ক্রেন দিয়ে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ করার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তিনটি ক্রেন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এ বিষয়ে এক মাস আগে চিঠি দেয়া হলেও কোন পদক্ষেপ নেননি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের ঢাকা অফিসের কর্তারা। বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) নিতাই চন্দ্র সেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বারবার তাগাদা দেয়া হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাড়া দিচ্ছে না। বিষয়টি জানিয়ে গত ২৫ মে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এ বন্দরে একটিমাত্র ২৫ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ফর্কলিফট রয়েছে। পাঁচ টনের ফর্কলিফট রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে তিনটি অচল। ৪০ টনের ক্রেন রয়েছে একটি। এছাড়া ৩৫ টনের একটি, দশ টনের দুটি ও ১৯ টনের একটি ক্রেন রয়েছে। এসব ক্রেন অধিকাংশ সময় অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় ২৫ টনের ফর্কলিফটি অকেজো থাকায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটছে মালামাল লোড-আনলোডে। বন্দর ব্যবহারকারী সিএ্যান্ডএফ এজেন্টরা অভিযোগ করেছেন, বন্দরের ড্রাইভার ও ইঞ্জিনিয়ারদের যোগসাজশে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব ফর্কলিফট ও ক্রেন ইচ্ছাকৃতভাবে অচল করে রাখেন দিনের পর দিন। মাঝে-মধ্যে মেরামতের জন্য যেসব যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয় তার অধিকাংশই পুরনো। ফলে মাস না ঘুরতেই ফের তা অচল হয়ে পড়ে। বন্দরে যেসব ক্রেন ও ফর্কলিফট ব্যবহার করা হচ্ছে তার অধিকাংশই ভাড়া করা ও পুরনো। এসব ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি দিয়ে বন্দরের মালামাল ওঠানো-নামানোর ফলে সময় ব্যয় হচ্ছে বেশি, সৃষ্টি হচ্ছে পণ্যজট। বন্দরের ১১ নম্বর গুদামের ইনচার্জ ফারুক হাসান জানান, পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে ব্যবহৃত পাঁচটি ক্রেনের মধ্যে দুটি সচল রয়েছে। ওই দুটি দিয়েই কোনরকমে কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। ক্রেন সঙ্কটের কারণে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সিএ্যান্ডএফ প্রতিনিধিরা ক্রেন পেলেও গুদামে আর জায়গা থাকছে না। তখন বসে থাকতে হচ্ছে ভেতরের পণ্য বের না হওয়া পর্যন্ত। এ ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বেনাপোল প্রতিনিধি হাফিজুর রহমান বলেন, ইঞ্জিনের বিষয় তো! মাঝে-মধ্যে সমস্যা হতেই পারে। আমরা সব ক্রেন ঠিক করে দিচ্ছি। বেনাপোল বন্দরে গুদাম রয়েছে ৩৬টি। এছাড়া ওপেন ইয়ার্ড পাঁচটি, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড একটি, ট্রাক টার্মিনাল আমদানি দুটি ও রফতানি একটি। এসব গুদামে পণ্য ধারণক্ষমতা ৪৭ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু সব সময়ই বন্দরে ৭০-৮০ হাজার টন পণ্য মজুদ থাকে। ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ মালামাল ঝুঁকি নিয়ে রাখা হচ্ছে ঠাসাঠাসি করে। এমনকী ট্রাক টার্মিনালসহ বিপজ্জনক দাহ্য গোডাউনেও মালামাল রাখা হচ্ছে। রাখার জায়গা না থাকায় প্রতিদিন কয়েক শ’ ট্রাক মালামাল নিয়ে বন্দরের পাশে সড়কের বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। পণ্যজটের কারণে বেনাপোল বন্দরের প্রবেশের অপেক্ষায় ভারতের পেট্রাপোল বন্দর ও বনগাঁ কালিতলা পার্কিংয়ে পণ্য নিয়ে শত শত ভারতীয় ট্রাক অপেক্ষা করছে। বন্দর ব্যবহারকারীরা জরুরীভিত্তিতে ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল রাখার জন্য একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গুদামসহ ১৫টি গুদাম নির্মাণের দাবি জানান। এছাড়া দুটি এক্সপোর্ট শেড ও একটি ছাউনিযুক্ত ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড নির্মাণের দাবিও করেন তারা। বন্দরে জায়গা সঙ্কটের কথা স্বীকার করে বেনাপোল স্থলবন্দরের উপপরিচালক (ট্রাফিক) আবদুল জলিল বলেন, আধুনিক দুটি শেড নির্মাণ করার জন্য ১২০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। শীঘ্রই দরপত্র আহ্বান করা হবে। শেডগুলো হলে জায়গার কোন সঙ্কট থাকবে না। তিনি বলেন, ক্রেন সঙ্কট মেটানোর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বারবার জানানো হচ্ছে। কিন্তু তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ বিষয়ে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। বেনাপোল সিএ্যান্ডএফ এজেন্টস এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক লতা জানান, ৩৬ হাজার টন ধারণক্ষমতার বন্দরে প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টন পণ্য ওঠানো-নামানো হয়। এসব পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য ন্যূনতম সাতটি ক্রেন প্রয়োজন। বিপরীতে সচল রয়েছে দুটি ক্রেন। প্রতিদিন পণ্য বোঝাই অন্তত ২০০ ট্রাক লোড-আনলোডের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি দ্রুত বন্দরের জায়গা ও ক্রেন সমস্যার সমাধানের দাবি জানান। বেনাপোল স্থলবন্দরের কর্মকর্তাদের এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা না থাকায় বেনাপোল বন্দরের সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে বলে অভিমত এই ব্যবসায়ী নেতার।
×