ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াত-শিবির ফাঁদে ফেলে ওদের জঙ্গী বানিয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৮ জুলাই ২০১৬

জামায়াত-শিবির ফাঁদে ফেলে ওদের জঙ্গী বানিয়েছে

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানা জাহাজ বিল্ডিং নামে পরিচিত তাজ মঞ্জিলে অপারেশন স্টর্ম-২৬ অভিযানে নিহত নয় জঙ্গীর অনেকেই জামায়াত-শিবিরের কোচিং সেন্টারে পড়তে গিয়ে জঙ্গী তৈরি হয়েছে। কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় আটক হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাকিুবল হাসান রিগ্যান হোসনি দালানে হামলার ঘটনায় জড়িত ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ পড়ুয়া উচ্চ শিক্ষিত এই যুবকদের মগজ ধোলাইয়ে জামায়াত-শিবিরের ফাঁদে ফেলে জঙ্গী করা হয়েছে। কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় নিহত জঙ্গীর মধ্যেও রয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অভিযানের পর যে ৪২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের ছেড়ে দিয়ে জাহাজ বিল্ডিংয়ের বাড়ির মালিকের স্ত্রী, পুত্রকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে দিয়েছে আদালত। কল্যাণপুরের আস্তানার জঙ্গী যে গুলশানের হামলাকারী জঙ্গীরা একই গ্রুপের তার আলামত পেয়েছে পুলিশ, ডিবি ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তদন্তকারী সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তকারী সূত্র জানায়, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী ৫ জঙ্গীর সঙ্গে গত মঙ্গলবার কল্যাণপুরের অভিযানে নিহত জঙ্গীদের কানেকশন ছিল বলে তদন্তে প্রতীয়মান হচ্ছে। কল্যাণপুরের জঙ্গীদের পোশাক, পাগড়ি, অস্ত্র, গ্রেনেডের সঙ্গে গুলশানে নিহত জঙ্গী গ্রুপের সদস্যদের হুবুহু মিল পাওয়া যাচ্ছে। গুলশানে নিহত জঙ্গী নিবরাসের বন্ধু শেহজাদের লাশ পাওয়া গেছে কল্যাণপুরে। দুই জনেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও ছিলেন। এতেই তদন্তকারীদের ধারণা দেয়, কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গীদের সঙ্গে গুলশানের জঙ্গীদের যোগাযোগ ছিল। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও এসব ছবির মিল পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় আটক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জঙ্গী রিগ্যানকে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুলশানের হামলার পর দায় স্বীকার করে সাইট ইন্টিলিজেন্সের মাধ্যমে হামলাকারীদের একজন নিবরাস ইসলামের যে ছবিটি দেখানো হয়, সেখানে নীল কাপড়ের ওপর আইএস-এর একটি পতাকা দিয়ে কালো পাঞ্জাবি ও স্কার্ফ পরিহিত হাসিমুখে নিবরাস একে-২২ রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কল্যাণপুরে নিহত শেহরাজও ছিল নিবরাসের সঙ্গে একই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এদিকে মঙ্গলবার কল্যাণপুরের বাসার জানালায় যে আইএস-এর পতাকা ঝুলানোর ছবি পুলিশ প্রকাশ করেছে, তার একপাশে ঝুলে আছে সেই একই রঙের নীল কাপড়, যা একই পুরুত্বেরও ছবি, যেটা ছবি তোলার সময় পতাকার ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে হাজির করা হয়েছিল নিবরাসসহ জঙ্গীর ছবিতে। তদন্তে বিশ্লেষণের মনে হয়, কোন না কোনভাবে একই সাথে ছিল এবং ছবি তোলার ক্ষেত্রে একই ব্যাকগ্রাউন্ড ও পোশাকই ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কল্যাণপুর থেকে আহত অবস্থায় আটক জঙ্গী রিগ্যানের বাড়ি বগুড়ায় এবং গুলশানে নিহত জঙ্গীদের মধ্যে দুই জনের বাড়ি ছিল বগুড়ায়। সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে বলে একই গ্রুপের সদস্য বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় ‘অপারেশন স্টর্ম-২৬’ অভিযান শেষে বলেছেন, নিহতরা সবাই বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গী দল জেএমবির সদস্য এবং গুলশানের হামলাকারীরাও ‘একই গ্রুপের’ বলে তাদের ধারণা। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, কল্যাণপুরের জঙ্গীরাও যদি গুলশানের মতো কোন ঘটনায় সফল হতো তাহলে তারাও আইএস-এর বলে দাবি করে ফেসবুকে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করত। কল্যাণপুরে নিহত হওয়া জঙ্গীরা এবং গুলশানের হলি আর্টিজানে নিহত হওয়া জঙ্গীরা কোন না কোনভাবে পরস্পরের সম্পৃক্ততায় থাকার বিষয়ে প্রমাণ দেয়। তবে কল্যাণপুরে জঙ্গীরা নিহত হওয়ায় আইএস তাদের বলে দাবি করা থেকে বিরত রয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে গুলশানের ও কল্যাণপুরে দুই গ্রুপের জঙ্গীরাই জেএমবির সদস্য বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি। হোসনি দালানে ঘটনায় জড়িত ॥ কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় আটক হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাকিবুল হাসান রিগ্যান (১৯) হোসনি দালানে হামলার ঘটনায় জড়িত ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। ওই ঘটনার পর হাসানকে তারা গ্রেফতারেরও চেষ্টা করেছিল। তবে তাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। সে এক বছর আগে বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলায় শিবির পরিচালিত রেটিনা কোচিং সেন্টারে যাওয়ার নামে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। হোসনি দালানে হামলার ঘটনায় সম্পৃক্ততা ছিল হাসানের। ওই ঘটনার পর সে গা-ঢাকা দেয়। তাকে গ্রেফতারে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। তবে সে দ্রুত জায়গা বদল করত। তাই তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। ২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর হোসনি দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় জঙ্গীরা গ্রেনেড দিয়ে হামলা চালায়। এতে সানজু ও জামাল নামে দুই ব্যক্তি নিহত হন। ওই হামলায় হাসানের সম্পৃক্ততা ছিল বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় পুলিশ ও সোয়াট বাহিনীর বিশেষ অভিযানের সময় ৫ তলা থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে হাসান ওরফে রিগ্যান। এ সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিজের পরিচয় দিলে তাকে নিয়ে বগুড়াজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়। ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ও কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোম ডিস্পোজাল টিমের প্রধান ছানোয়ার হোসেন বলেছেন, কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানা থেকে আটক হওয়া হাসান ওরফে রিগ্যানকে আমরা হোসনি দালানের ঘটনায় খুঁজতেছিলাম। সে সন্দেহভাজন হামলাকারী। জঙ্গীদের মিনি ক্যান্টনমেন্ট বগুড়া ॥ যেখানেই জঙ্গী হামলায় নিহত বা আহত অবস্থায় জঙ্গী ধরা পড়ছে সেখানেই বগুড়ার জঙ্গী পাওয়া যাচ্ছে। গুলশানের নিহত হওয়া জঙ্গীর পর কল্যাণপুরেও বগুড়ার জঙ্গী রিগ্যান গ্রেফতার হয়েছে। শুধু তাই নয়, বগুড়ায় জামায়াত-শিবির পরিচালিত কোচিং সেন্টারে পড়তে গিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররা জঙ্গী তৈরি হচ্ছে। শিবিরের কোচিং সেন্টারে গিয়ে জঙ্গী ॥ কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় নিহত জঙ্গী সাব্বিরের পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ পরিবারে সন্তান সাব্বির জামায়াত-শিবির পরিচালিত কোচিং সেন্টারে গিয়েই জঙ্গী তৈরি হয়েছে। কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের হাতে আটক বগুড়ার জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যানও শিবির নিয়ন্ত্রিত রেটিনা কোচিং সেন্টার বগুড়া শাখার ছাত্র ছিলেন। এই খবর প্রকাশের পর মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে শতাধিক লোক লাঠিসোটা নিয়ে শহরের রিয়াজ কাজী লেনে অবস্থিত রেটিনা ও ফোকাস কোচিং সেন্টারে হামলাও চালায়। তারা ওই ভবনের কলাপসিবল গেট ভাঙচুরের পর সেখানে অগ্নিসংযোগও করে। এরপর তারা আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠসংলগ্ন রেটিনা ও ফোকাস কোচিং সেন্টারের অপর অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। শিবির পরিচালিত রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার পরই জঙ্গী দলে যোগদান করে রিগ্যান এবং তাকে সহায়তা করে বন্ধু শিহাব ও মাসুদ রানা। নিখোঁজ তালিকায় ছিল রিগ্যানও ॥ র‌্যাব নিখোঁজের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে থাকা ২৬২ জনের মধ্যে একাধিকবার একটি নাম ছিল রিগ্যানের। ওই তালিকার ২৬ নম্বর ও ১৯৫ নম্বরে থাকা ব্যক্তির পাসপোর্ট নম্বর একই। তাদের বাবা নামও একই। তবে ওই ব্যক্তির নাম দুই জায়গায় সামান্য পার্থক্য ছিল। কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তান থেকে আহত অবস্থায় আটক জঙ্গী রিগ্যান। র‌্যাবের তালিকায় ২৬ নম্বর ব্যক্তির নাম লেখা হয়েছে মোঃ সাজাদ রউফ। মোঃ সাজাদ রউফ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ অধ্যয়নরত বলেও লেখা হয় এই ঘরে। এরপর র‌্যাবের ৬৮ জনের তালিকায় তার নামটি পুনরায় উল্লেখ করা হয়। এই ঠিকানা বসুন্ধরার ১০ নম্বর সড়কের ৩০৪ নম্বর বাসা লেখা রয়েছে। নিহত রউফও নিখোঁজ ছিলেন। ভাটারা থানায় নিখোঁজের একটি জিডিও করে তার পরিবার। জিডির নম্বর-৩৯২।
×