ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবেগাপ্লুত শ্রাবণ মেঘের দিন, প্রিয় লেখকের জন্য ভালবাসা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২০ জুলাই ২০১৬

আবেগাপ্লুত শ্রাবণ মেঘের দিন, প্রিয় লেখকের জন্য ভালবাসা

মোরসালিন মিজান ॥ সে দিনটি ভুলবার নয়। সত্যি। শ্রাবণ মেঘের দিন ছিল। অঝর ধারায় কাঁদছিল আকাশ। বৃষ্টিবিলাসী হুমায়ূন আহমেদ চলে যাচ্ছেন। এই চলে যাওয়া, বিচ্ছিন্নতার কষ্ট মানতে পারছিল না প্রকৃতি। যেন মানতে পারছিল না নুহাশপল্লীর সবুজ বৃক্ষ। পুকুরের শান্ত জল এদিন শোক করেছে। চারদিকে তাকিয়ে দিব্যি পাঠ করা গেছে শোকবার্তা! আর ভক্ত পাঠক? চোখের যত জল, বুকের যে ভালবাসা সব নিংড়ে দেন প্রিয় লেখককে। সব বুঝে নিয়ে চলে যান হুমায়ূন আহমেদ। বেদনাবিধুর চলে যাওয়ার চতুর্থ বার্ষিকী ছিল ১৯ জুলাই মঙ্গলবার। চলে যাওয়ার দিন হলেও, এদিন প্রিয় লেখককে সবচেয়ে বেশি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ভক্ত পাঠক! সারাদিন তার সৃষ্টির বিশাল ভা-ারে ডুব দিয়ে ছিলেন। উপন্যাস, টিভি নাটক, সিনেমা থেকে খুঁজে নেয়া হুমায়ূন আহমেদকে তুলে ধরা হয় দিনভর। লেখকের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছিল যাদের, তারা স্মৃতিকথা লিখেছেন। সব মিলিয়ে চমৎকার ফিরে দেখা। প্রয়াণ দিবসে তেমন কোন আনুষ্ঠানিকতা থাকে না। ছিল না এবারও। তবে সারাদিন হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করেছেন পাঠক। নানাভাবে তারা তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। ভালবাসার কথা জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক এই শ্রদ্ধা ভালবাসার খবর দিয়েছে প্রতি মুহূর্তে। আগের রাত থেকেই শুরু হয়ে যায় স্মরণ করার কাজ। অসংখ্য ভক্ত হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি থেকে পছন্দের অংশটুকু নিয়ে তা স্ট্যটাস আকারে তুলে ধরেন। কেউ অত্যন্ত জনপ্রিয় নাট্যকারের নাটকের ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করেন। লেখকের পছন্দের উক্তি বা গান তার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়। অনেকে ফেসবুকের প্রোফাইল বা কাভার পিকচার শোকের রং কালো দিয়ে ঢেকে দেন। এভাবে সারা দিন। শ্রাবণের দিন বলেই হয়ত হুমায়ূন আহমেদের বর্ষাপ্রীতির কথা বার বার উঠে আসে। ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লেখক ও নাট্যকার শাকুর মজিদ ফেসবুক স্ট্যটাসে লিখেছেনÑ আমার চেনা জানা লোকদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদকে বৃষ্টি নিয়ে আকুত প্রকাশ করতে দেখেছি। নুহাশ পল্লীর একটা ঘরই আছে ‘বৃষ্টি বিলাস’ নাম। এটা তিনি বানিয়েছিলেন টিনের চাল দিয়ে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনার জন্য। আগের দিনের রাজা বাদশাহদের যেমন ঋতুভিত্তিক আবাস থাকত, হুমায়ূনও বর্ষাকালে এ বাড়িতে থাকার জন্য ঘরটি বানিয়েছিলেন। প্রিয় লেখককে চির বিদায় দেয়ার সময়টির কথা উল্লেখ করে আবেগাপ্লুত শাকুর লেখেনÑ সেদিনও দুপুর পর্যন্ত ফকফকা রোদ ছিল আকাশে। কিন্তু হঠাৎ করে শ্রাবণ মেঘের দিনে পরিণত হয়ে গেল নুহাশ পল্লী। হুমায়ূন আহমেদকে যখন কবরে শোয়ালাম, তখন বৃষ্টি ঝরছে গাজীপুরের আকাশ থেকে। জোসনার জন্যও প্রতিক্ষা করে থাকতেন হুমায়ূন। তিনি জোসনার সৌন্দর্য পাঠকের সামনে দারুণভাবে তুলে ধরেছিলেন। হুমায়ূনের কাছ থেকে জোসনা দেখা শেখার কথা জানিয়ে সুপ্রীতি ধর তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেনÑ সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এই বিশ্বে জোছনা ছিল, আমাদের ছোটবেলায়, কিশোরীবেলায়, তারুণ্যে, ভালবাসার কালেও জোছনা ছিল। কিন্তু হুমায়ূনকালের মতোন এমন মায়াবী জোছনার দুপুর কখনও ছিল কীনা আমার জানা নেই। মনটাকে এমন ভাসিয়ে নিয়ে যেত একজনই, তাই তাঁর চলে যাওয়ার খবরে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। সেই রাতটি চাঁদনি পসর না হলেও হাহাকার ছিল খুব। ব্লগার আজম খান হুমায়ূন আহমেদের রাজাকার বিরোধী অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় টেলিভিশন নাটক ‘বহুব্রীহি’ থেকে উদ্ধৃত করেন তিনি। সরাসরি হুমায়ূন আহমেদ থেকে নেয়া উদ্ধৃতিটি এরকমÑ ফরিদ এখন তার আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেছে। মহানন্দে আছে। তার মাথায় অন্য একটা পরিকল্পনা এসেছে। সে পাঁচটা টিয়া পাখি জোগাড় করে তাদের কথা শেখাচ্ছে। কথাটা হচ্ছে ‘তুই রাজাকার’। এইসব পাখি পুরাপুরি কথা শিখে গেলে এদের উপহার হিসেবে বিশেষ বিশেষ মানুষদের কাছে পাঠানো হবে। তারাই পাবেন যারা এক সময় রাজাকার ছিলেন। আজ দেশের হর্তাকর্তাদের একজন হয়ে বসে আছেন। এক মঙ্গলবার ভোরে প্রচ- চিৎকার এবং হৈ চৈ-এ নিরিবিলি বাড়ির সমস্ত নীরবতা ভঙ্গ হল। ফরিদ পাগলের মত চেঁচাচ্ছে, চেঁচানোর কারণ একটি পাখি কথা শিখেছে। পরিষ্কার বলছে- ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার। ব্যক্তিগত স্মৃতিও ফেসবুকে তুলে ধরেছেন অনেকে। অন্য প্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম লিখেছেনÑ শ্রাবণের এক বর্ষণমুখর দিনে আকাশের কান্না আর অগণিত ভক্ত, পাঠক এবং প্রিয়জনের চোখের জলে একাকার শাল-গজারির বন। হুমায়ূন আহমেদ এখন এক অদেখা ভুবনের বাসিন্দা। সেখানে ইহজাগতিক কোনো প্রিয়জনের প্রবেশাধিকার নেই। তাই বলে তিনি নিঃসঙ্গ নন। তাঁর চারপাশে পত্রপুষ্পশোভিত বৃক্ষরাজি। তাদের সঙ্গেই তাঁর জম্পেশ আড্ডা, বৃষ্টিযাপন তাদেরই সঙ্গে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। যে চাঁদের ছায়া পড়েছে ময়ূরাক্ষী নদীতে। সেই নদীর স্বচ্ছ জলে সারাক্ষণ খেলা করে জোছনার ফুল। দূরের বন থেকে ভেসে আসে অপার্থিব সংগীত। আর আমরা, এই ভুবনে তার সহচরেরা, মস্তিষ্কের নিউরনে শত-সহস্র স্মৃতি নিয়ে নিঃসঙ্গতার তীব্র এক হাহাকারে কেবলই খুঁজে ফিরি তাকে। হুমায়ূন আহমেদ গান ভালবাসতেন। অনন্য সাধারণ লোকগান তিনি সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তার পছন্দের সেসব গান প্রয়াণ দিবসে ঘুরে ফিরে এসেছে ফেসবুকে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হুমায়ূন আহমেদের আগ্রহে খালি গলায় গান করছেন সেলিম চৌধুরী। তার গাওয়া ‘বন্ধু তোর লাইগা রে’ শুনছেন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, কথাসাহিত্যিক মইনুল আহসান সাবেরসহ অন্যরা। এভাবে সারা দিন হুমায়ূনকে স্মরণ করা হয়েছে। প্রয়াণ দিবসে গাজীপুরও ছুটে যান ভক্ত অনুরাগীরা। নুহাশপল্লীতে চিরশয্যা নেয়া হুমায়ূনের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানান তারা। আগের দিনই ছোট দুই সন্তানসহ সেখানে চলে গিয়েছিলেন লেখক পতœী মেহের আফরোজ শাওন। পরে উপস্থিত হন ছোট ভাই জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও কাটুর্নিস্ট আহসান হাবীবসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। প্রকাশকরা যান। ভিড় লেগেছিল ভক্ত পাঠকের। দেখতে দেখতে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে সমাধি। কোন না কোন সময় উপস্থিত সকলেরই চোখ জলে ভরে ওঠে। শেষ করা যাক হুমায়ূন আহমেদের ভালবাসার ধন নুহাশ হুমায়ূনের ফেসবুক স্ট্যটাস দিয়ে। প্রোফাইল পিকচারে বাবার ছবি যুক্ত করে তিনি লিখেছেনÑ ইউ আর উইথ মি এভরি সেকেন্ড অফ এভরি ডে, ইউ নো দ্যাট? ডিড ইউ এভার?
×