ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতকে ছাড়তে পারছে না বিএনপি, জাতীয় ঐক্যও হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৮ জুলাই ২০১৬

জামায়াতকে ছাড়তে পারছে না বিএনপি, জাতীয় ঐক্যও হচ্ছে না

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে প্রধান বাধা জামায়াত। দলটির রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে কিছুতেই জামায়াত ছাড়তে পারছে না। এ কারণে সরকার ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বিএনপির ঐক্যের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। তবে বাস্তবতার নিরিখে বিএনপির ডাকে ঐক্য হচ্ছে না এমনটি মাথায় রেখেই দলের বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি কাটিয়ে তুলতে এমন রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। গুলশানে জঙ্গী হামলার পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। তাই ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকায় ঘরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। বিশেষ করে সরকারী দলের পক্ষ থেকে বিএনপি ও জামায়াতকে নিয়ে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা হয়। এ পরিস্থিতিতে ৩ জুলাই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানান। কিন্তু আওয়ামী লীগসহ সরকার সমর্থিত বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে বলা হয় জামায়াতের সঙ্গ না ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে কোন ঐক্য হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা স্পষ্ট করেই বলেছেন বিএনপি জামায়াতকে না ছাড়লে তাদের সঙ্গে ঐক্য হবে না। ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকায় জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের কী হবে তা নিয়ে আলোচনা করতে ১২ জুলাই ২০ দলীয় জোট ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। ওই বৈঠকে কেউ কেউ জোটে জামায়াত থাকলে ঐক্য হবে না এমন অভিমত দিলেও অন্যরা আপাতত জামায়াত না ছাড়ার পক্ষে মত দেন। পরদিন ১৩ জুলাই পেশাজীবীদের নিয়ে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ওই বৈঠকে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার জন্য প্রস্তাব দেন ক’জন পেশাজীবী। তবে কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে বলেন, সরকার যদি জামায়াত নিষিদ্ধ করে তখন এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করলে বিএনপি কেন এ কাজ করতে যাবে। এ বৈঠকের পর এখন পর্যন্ত বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে কোন তৎপরতা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্রমতে, জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি বড় ধরনের চাপের মুখে পড়লেও আপাতত এ দলটির সঙ্গ ত্যাগ নয় বরং কৌশলে সাইড লাইনে রাখতে চায় তারা। সে ক্ষেত্রে ভেতরে ভেতরে সমঝোতা করে সব রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করলেও প্রকাশ্যে দূরত্ব বজায় রাখবে বিএনপি। আর জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির আরেকটি কৌশলের মধ্যে রয়েছে দলের বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগিয়ে জামায়াতের নতুন প্রজন্মের নেতাদের দিয়ে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য ক্ষমা প্রকাশের মধ্য দিয়ে এ দলটিকে রাজনীতিতে টিকিয়ে রাখা। বিএনপির আরও একটি কৌশলের মধ্যে রয়েছে জামায়াতকে দিয়ে ঘোষণা দিয়ে ২ দলের মধ্যে প্রকাশ্য দূরত্ব বজায় রেখে গোপনে সখ্য বজায় রাখা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জনকণ্ঠকে জানান, গুলশানে জঙ্গী হামলার পর বিএনপি আন্তরিকভাবেই জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে জোটে জামায়াত থাকা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করলেও রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে হঠাৎ করে জামায়াতকে বাদ দেয়া সম্ভব হবে না। তবে সরকার জামায়াত নিষিদ্ধ করলে তখন সম্ভব হতে পারে। আপাতত জামায়াতকে কৌশলে দূরে রাখার চেষ্টা চলছে। ১৩ জুলাই পেশাজীবীদের নিয়ে খালেদা জিয়ার বৈঠককালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী জামায়াতের রাজনীতির বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি জামায়াতের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে এ দলটিকে রাজনীতি করতে হলে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা নিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। এ ছাড়া এ দলের শীর্ষ নেতাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কবর জিয়ারত করতে হবে। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকও বক্তব্য রাখেন। ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে গণফোরাম সভাপতি ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা একটি দুরূহ কাজ। তবে জাতির এমন বিপদের দিনে সব মতভেদ ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। একই দিনে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘জঙ্গীবাদবিরোধী জাতীয় সংলাপ’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, খালেদা জিয়া সম্পর্ক না রাখলে অনেক আগেই জঙ্গী নির্মূল করতাম। জঙ্গীদের সঙ্গে সম্পর্ক পরিহার না করে খালেদা জিয়া বার বার পরীক্ষায় ফেল করছেন। জঙ্গীদের পক্ষ নিয়ে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে বেগম জিয়া এই ফেলের ধারা বজায় রেখেছেন। শেখ হাসিনার সরকার সমূলে জঙ্গী নির্মূল ও ধ্বংস করার নীতিতে বিশ্বাসী। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার সম্পর্ক নেই। ১১ জুলাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ১৪ দলের জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সমাবেশে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকলে ঐক্য হবে না। তাদের জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে কথা বলতে হবে। খালেদা জিয়া দেশে কোন গণতন্ত্র ও শান্তি চান না। তিনি দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ক্ষমতায় যেতে চান। কিন্তু দেশের মানুষ এটা করতে দেবে না। মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে, থাকবে। ঐক্যবদ্ধভাবে সব ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করা হবে। একই অনুষ্ঠানে তৃণমূল বিএনপির সভাপতি ও ৩১ দলীয় জোট বাংলাদেশ ন্যাশনাল এ্যালায়েন্সের প্রধান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বলেন, খালেদা জিয়ার ঐক্যের আহ্বানকে গুরুত্ব দেয়ার কী আছে? একদল সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে দেশে অরাজকতা করছে। এ জঙ্গীবাদী কর্মকা- প্রতিরোধ করতে হবে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর চারদলীয় জোটের শরিকদল বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি অংশ জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার দাবি করে। বিশেষ করে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা দলের পরাজয়ের জন্য জামায়াতকে দায়ী করে চারদলীয় জোট থেকে এ দলকে বাদ দেয়ার জোর দাবি জানান। কিন্তু ভোটব্যাংক ও মাঠের আন্দোলনের কথা চিন্তা করে জমায়াত ছাড়ার চিন্তাও করেনি বিএনপি হাইকমান্ড। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জামায়াতসহ চারদলীয় জোটের শরিকদের নিয়ে নির্বাচন করে বিএনপি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়লাভ করে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারে সোচ্চার হওয়ায় জামায়াত রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে।
×