ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মো. জাভেদ হাকিম

ঘোর লাগা এ্যাডভেঞ্চার

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৫ জুলাই ২০১৬

ঘোর লাগা এ্যাডভেঞ্চার

না সমুদ্র না সমতল/হবে অরণ্য/নাহ্ তাওনা/তাহলে কোন পুরাকীর্তি হবে হয়ত/তাও না/তবে কি? পাহাড়! প্রতিদিনও যদি নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াই তবুও তৃপ্তি মিটে না ভ্রমণ পিপাসার, যতক্ষণ না পর্যন্ত কোন পাহাড়ের সান্নিধ্যে না যাই। যতবারই পাহাড়ে যাই ততবারই আপন মনে বলে উঠি কতদিন পরে দেখিলাম তোমায়। দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় পাহাড় রয়েছে তবে আমার প্রথম পছন্দ বাংলার স্বর্গ বান্দরবান জেলার পাহাড়গুলো। সেখানে গেলে মনে হয় এই পাহাড়, পাথর, মাটি, ঝিরি, ঝর্ণা ক্ষরস্রোতা সাঙ্গু নদী এসবই যেন আমার অতি আপন। আর আপন মনে হবেই বা না কেন? বান্দরবানে বাস করে মোট ১২টি সম্প্রদায়। বম, বাঙালী, মারমা, খিয়াং, মুড়ং, ত্রিপুরা, চাকমা, লুসাই, চাক, পাংখোয়া, তঞ্চঙগ্যা ও খেয়াং। এর মধ্যে একটি বাদে আর বাকি সব সম্প্রদায়ের আতিথ্য রয়েছে বেশ। আর বম সম্প্রদায়ের তুলনা তারা নিজেরাই। তাদের ভালবাসা আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ। আমার মতো আমাদের প্রিয় সংগঠন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরাও পাহাড়ের সঙ্গে মেলবন্ধনে নিজেদের জড়িয়েছে বেশ আগেই। সবার ভাললাগা, সেই ভালবাসার টানেই হঠাৎ সিন্ধান্তে এক ঝটিকা ট্যুর দিয়ে এলাম গত কয়েকদিন আগে। ঢাকা থেকে প্রথমে চকরিয়া- চকরিয়া হতে আলির গুহা, আলীর গুহা হতে সদ্য উদ্বোধন হওয়া দেশের দ্বিতীয় উচ্চতম সড়ক পথে ডিম পাহাড়ের পাশ দিয়ে থানচিবাজার। থানচি বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে, ট্রলারে চড়ে তিন্দু। ওয়াও তিন্দুপতার রূপের বর্ণনা আমি কি লিখে পাঠকদের বুঝানোর ক্ষমতা রাখি? চেষ্টা না হয় করি। এবার ঝটিকা ভ্রমণের ফিরিস্তি দেই- দুই ঘণ্টা লেট করে গাড়ি পৌঁছাল। সকাল দশটায় চকরিয়াতে দেরি হওয়াতে পকেটের টাকা অতিরিক্ত যা খসার খসল আমাদেরই। আলী কদমের লোকাল বাসের বদলে একেবারে থানচিবাজার পর্যন্ত ঝিপচান্দের গাড়ি রিজার্ভ হলো। ভ্রমণ সার্থক ও সফল করার জন্য দে-ছুট কখনই টাকার চিন্তা করে না। এবারও ঠিক তাই। কথায় আছে না আল্লাহ যা করে মঙ্গলের জন্যই করে। কারণ চান্দের গাড়ির ড্রাইভার নুরুল ইসলাম ছিল আমাদের জন্য সাক্ষাৎ একজন দূত। অত্যন্ত ভদ্র নুরুল একজন দক্ষ গাইড হিসেবেও আমাদের সঙ্গ দিয়েছে। আলির গুহার বর্ণনা দিয়ে শুরু করি- চকরিয়া হতে ফাঁসিয়াখালী হয়ে দক্ষিণে আলী কদম সড়ক চলে গেছে এঁকেবেঁকে। এ্যাডভেঞ্জারের নেশায় রোমাঞ্চকর যাত্রা। তার ওপর শাহেনশাহ্র মতো জিপে চড়া। সব মিলিয়ে আমাদের ভাবখানাই আলাদা। মনের মধ্যে অন্যরকম থ্রিল অনুভব করছি। ঢাকা থেকে যাবার শেষ মুহূর্তেও ট্রাভেলার রুহেল ভয় দেখিয়েছে। কোথাও যাবার আগে এমন সব সাবধান বাণী আমাকে বরাবরই আরও বেশি উৎসাহী করে তোলে। শিবাতলী বাজারে গাড়ি ব্রেক, টুকটাক সদাইপাতি। অতঃপর লামাকে পেছনে ফেলে আর্মি ক্যাম্প পাশ পকটে পৌঁছে যাই আলি কদম উপজেলার পানবাজার। চকরিয়া হতে পানবাজার ৫০ কি. মিটার কিন্তু মায়াবি প্রকৃতির বুকচিরে পাহাড়ী পথে মনে হলো গাড়ি স্ট্রাট নিতেই যেন পথের শেষ। এবার পায়ে হাঁটা-কিছুদূর হাঁটতেই পেয়ে যাই মাতামুহুরী নদীর পানি গড়িয়ে আসা তৈন খাল। বেশ চমৎকার প্রকৃতি ও পরিবেশ সুন্দর খালের আশপাশ। হাঁটু সমান স্বচ্ছ টলটলে পানিতে হেঁটেই পার হই। বুনো পরিবেশে এখন কিছুটা চড়াই-উৎরাই। এবার শুরু স্যাঁতসেতে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে সরু পথে চলা। কখনও হাঁটু কখনও কোমর সমান পানিতে কখনও বা দুই পা দুই পাহাড়ের খাঁজে রেখে এগিয়ে যাওয়া, মনের মাঝে ভিন্নরকম অনুভূতির শিহরণ। এ পথে সূর্যের আলোও ঠিকমতো পড়ে না। এ রকমভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর পেয়ে যাই আলীর গুহায় প্রবেশের সিড়ি। লোহাড় সিড়ি খাড়া হয়ে ওপর দিকে উঠে গেছে, খুবই পিছিল। পা পিছলে পড়লে পুরাই আলুরদম। তবুও মনের মাঝে জয়ের নেশা চোখে রয়েছে দেখার আশা সঙ্গীদের সহযোগিতায় তরতর করে উঠে যাই ওপরে। সিড়ি শেষে মূল সুরঙ্গে ঠুকতে কিছুটা ঝুঁকি। তবুও ঠুকে যাই। ঘুটঘুটে অন্ধকারÑ জ্বলে উঠে টর্চ। কিছুদূর আগাই একেই বলে প্রকৃতির আপন খেয়ালের নিদর্শন। আমরা প্রায় ৭০-৮০ মিটার পর্যন্ত ঠুকেছি। এর ব্যাপ্তি প্রায় ৭০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃৃত। আদিবাসীরা সুরঙ্গের ২০০ মিটার পর্যন্ত গিয়েছে। শুনেছি এখানে অনেক বাদুড়ের বসবাস। বন্যজন্তুর বিষ্ঠার উটকো গন্ধ। বিষধর সাপও থাকতে পারে কিন্তু দুঃখের বিষয় এসব কিছুই আমাদের দৃষ্টিগোচরে আসেনি। তাই কানকথায় বিশ্বাস না করে টুঁ মেরে আসুন নির্ভয়ে। এবার ছুটছি থানচির পথে। আলী কদম হতে থানচির দুরুত্ব ৩৩ কি. মি.। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে উদ্বোধন হওয়া দেশের দ্বিতীয় উচ্চতম সড়ক পথ এটি। ডিম পাহাড় লাগোয়া এই সড়ক পথে ভ্রমণের আনন্দই আলাদা। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে সড়কের উচ্চতা ৮১৩ মিটার। থ্যিংকনপাড়া আর্মি ক্যাম্প চেক পোস্ট পার হওয়ার পর আপনার দৃষ্টি হয়ে থাকবে অপলক। গাড়ি যতই এগিয়ে যাবে ততই চোখে ধরা পড়বে প্রকৃতির নানান রূপ। বন্য গয়াল আপন মনে ঘুরে বেড়ায় হরেক রঙের পাখি উড়ে বেড়ায়। কিছু কিছু বাঁক পড়বে যা সত্যিই আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে। নৈসর্গিক প্রকৃতির মায়ায় আছন্ন হয়ে কখন যে থানচি ব্রিজে চলে এলাম টেরই পাইনি। থানচিবাজারে খেয়ে দেয়ে যাই এবার তিন্দুর পথে। কষ্ট পাই গণ-শৌচাগার না থাকাতে। পর্যটকদের পকেট কাটতে যাদের নেই জুড়ি তাদের মনে একবারও কি দেয় না উঁকি, দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজনদের জন্য একটা ওয়াশরুমের ব্যবস্থা করি। ধিক্কার জানাই থানচিবাজারের ব্যবসায়ীদের প্রতি। সেই সঙ্গে দাবি জানাই থানচির দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের প্রতি। অন্তত টাকার বিনিময়ে হলেও পাবলিক টয়লেট অতি জরুরী। বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে ট্রলার ভাসে সাঙ্গুর জলে। পানি কমে যাওয়ার নদীর তলদেশ দেখা যায়, স্ফটিক স্বচ্ছ জলে চেহারা দেখে নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করি তুমি কি হতে পার না নদীর পানির মতো স্বচ্ছ? উত্তরে জানাই প্রতি নিয়ত চেষ্টা করি। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই পৌঁছাই তিন্দু। আমি বারে বার আসি/তিন্দুর বুকে/তবুও তিন্দুর রূপ লাবণ্য/আমার রয়ে যায় অদেখা। সত্যিই তিন্দুর প্রকৃতি এমনি যতবারই যাবেন কেন এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রহস্য ভেদ করা কখনই সম্ভব নয়। সব কথার এক কথা বান্দরবান যদি বাংলার স্বর্গ হয় তাহলে সেই স্বর্গের রাজধানী হলো তিন্দু। ভাবছেন লিখতে গিয়ে বেশি বাড়িয়ে লিখছি, মোটেও না। স্বচক্ষে দেখার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে যান মাত্র দুই দিনের জন্য আহ-হা তখনই বুঝবেন, কি দেখেন নাই এতদিন এই সোনার দেশে জন্ম নিয়ে। আমাদের ঠাঁই হয় কাঠ দিয়ে তৈরি তিনতলার কটেজে। কটেজ বলতে অন্যসব গতানুগতির কটেজের মতো নয়, এক্কেবারে সোজা বাংলায় যাকে বলে মাদুর বিছানো চিৎকাইৎ বেডিং। তবে মজা অন্য জায়গায়- গ্রীলছাড়া ছোট কাঠের জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই মেঘ ছুঁয়ে যাবে হাতের নরম তালু। আপনারা ভাবতে থাকুন। আর এই ফাঁকে দে-ছুটের দামালরা আধো জোছনার আলোতে হিমেল হাওয়ার দোলে পাথরে সাঙ্গুর শিতল পানিতে গোসল সেরে নেই মনভরে। নদীতে নামার পর মন চাইছিল না যে উঠি তবু উঠি, সেই সুযোগে থানচি থেকে আনা মুরগি, নৌকার মাঝি হোসেন রান্না করে রেখেছে। আদিবাসীদের ঘরে ভাত, আলুভর্তা, ডিম হোসেনের রান্না করা মোরগভুনা আহ্ খেতে কি স্বাদই না। দুনিয়াটা মস্তবড়/খাও দাও ফুর্তি কর/আগামীকাল বাঁচবে কিনা বলতে পার। এবার চল পাড়াটা ঘুরে দেখি, পাড়ার নাম তিন্দু। মোট ৬৪টি আদিবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায় পরিবারের বসবাস। মারমা ও ত্রিপুরা পরিবার বেশি, মাত্র একটি পরিবার হলো খুমি। এবার যাই ঘুমাই। দুই রুম বুকিং থাকলেও এক রুমেই গাদাগাদি। ডনের খাজুরা প্যাচাল আরাফাতের নাক দিয়া বাঁশির সুর, ঘুমকাতুরে ইউশার এলোমেলো ভাব আর কাইউম ভাই ভাবে কাগো লগে আইলামরে বাপ। এদেখি ২৪ ঘণ্টাই ওপেন হার্ট। এত কিছুর পরও সামান্য ঘুমানোর চেষ্টা করি। ওঠতে হবে ফজরের সময়। মরিচপোড়া ঘুম দিয়ে ফজরের নামাজ পড়েই উঠি গিয়ে পাহাড়ের চূড়ায়। অসম্ভব ভাললাগা সূর্যোদয়ের সুখ স্মৃতি নিয়ে এবার ছুটি বড় পাথর। বিশ্বাস করুন তিন্দুর বড় পাথর আর বাঘি সাং যদি কেউ না দেখেন তাহলে এ ভুবনে জন্মা নেয়াটাই যেন তার বিফল। তিন্দুপাড়া হতে মাত্র ৩০ মিটিটের মধ্যেই নৌযোগে যাওয়া যাবে। সেখানে গেলে দেখবেন পাথর আর পাথর- হরেক সাইজের পাথর ওর মধ্যে সব চাইতে বড় যে পাথরটা ওটাকে রাজা পাথর হিসেবে সবাই চিনে। আদিবাসীরা সেখানে পুজো করে বলি দিয়ে থাকে। তাদের জন্য তীর্র্থস্থান আমরা তাই করি সম্মাান। নানান আকৃতির পাথরের ফাঁক গলে নৌকা এগিয়ে চলে। কিছুদূর গিয়েই বাঘি সাং এ থেমে মেতে উঠি উল্লাসে। দুইপাশে পাহাড় উঁচু হয়ে যেন দিগন্ত ছুঁয়েছে। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো গাছগুলো দেখে মনের মাঝে ভিন্ন রকমের অনুভূতির দোলা দেয়। আর পায়ের নিচে পাথুরে চিক চিক সাদা বালির লুটোপুুটি, হাত বাড়ালেই শংখর পানি সবকিছু মিলিয়ে এপাশটায় ভর করেছে প্রকৃতির উজার করে দেয়া সব রূপে তেলেসমাতি- কি বিশ্বাস হয় না? ঠিক আছে তাহলে স্বচক্ষেই দেখে আসুন না কি দেখেন নাই এতটা বয়স পার হওয়ার পরেও। যাবেন কিভাবে : ঢাকা হতে বিভিন্ন পরিবহনের বাস চলে চকরিয়া। চকরিয়া বাসস্ট্যান্ড হতে আলী কদম/চাঁন্দের গাড়িতে পানবাজার নেমে আলীর সুরঙ্গ ঘুরে আবারও চাঁন্দের গাড়ি/বাইকে ডিম পাহাড়ের পাদ দেশের পথ ধরে থানচিবাজার, থানা ও বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে ট্রলারে করে তিন্দু। খাবেন কি থাকবেন কোথায় : আদিবাসীদের দোকান-বসত রয়েছে। মাথাপিছু ১৫০ টাকার বিনিময়ে খেতে ও থাকতে পারবেন অর্থাৎ ১৫০+১৫০ =৩০০/-টাকা। স্পেশাল খাবার খেতে চাইলে থানচি হতে নিয়ে আসতে হবে। খরচ পাতি : দুই দিনের ভ্রমণে মাথা পিছু খরচ হবে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা তবে একটু কষ্ট করে ভ্রমণ করলে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার মধ্যেও সম্ভব। আপডেট তথ্য পেতে ঢুঁ মারুন গুগোল সার্চে। টিপস : সঙ্গে চটের ব্যাগ নিন, সেখানে বর্জ্য রাখুন। যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলে প্রকৃতির বিনষ্ট করা হতে বিরত থাকুন, অন্যদেরও উৎসাহীত করুন। আদিবাসী বা স্থানীয়দের প্রতি অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ না হয়ে তাদের নির্ধারিত মজুরি পরিশোধ করুন যদি তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে হয় তাহলে আলাদাভাবে করুন। অন্যথায় আপনার গুলিয়ে ফেলা সহানুভূতি পরবর্তী পর্যটকদের জন্য মহাবিড়ম্বনার কারণ হবে।
×