ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার ‘কমান্ড সেন্টার’ খোঁজা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১২ জুলাই ২০১৬

হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার ‘কমান্ড সেন্টার’ খোঁজা হচ্ছে

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলাকারীদের ‘কমান্ড সেন্টারটির’ খোঁজ করছে গোয়েন্দারা। কমান্ড সেন্টারটি থেকেই গোটা জঙ্গী হামলাকারীদের নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের মাস্টারমাইন্ড। জঙ্গীদের সঙ্গে নতুন নামের কোন জঙ্গী সংগঠনের লিংকআপ ঘটেছে কিনা- যারা অত্যাধুনিক উন্নত প্রযুক্তির পারদর্শী, তারও খোঁজ করছে গোয়েন্দারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞ সাহায্য ও গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের সহায়তা চাওয়া হবে। এ ধরনের সহায়তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত সাইট ইন্টেলিজেন্স নামের জঙ্গীগোষ্ঠীর ওয়েবসাইটে পাঁচ জঙ্গী হাসিমুখে একে-২২ রাইফেল হাতে নিয়ে আইএসের কালো পোশাকে মাথায় রুমাল আবৃত পোশাকের ছবির দৃশ্যটি কখন, কোথায়, কিভাবে, কার মাধ্যমে তোলা হয়েছে- সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হবে। নিহত পাঁচ জঙ্গীর অস্থি-মজ্জা, রক্তমাখা জামাকাপড় জব্দ করা আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সোমবার আদালতে আবেদন করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, সেই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় নিহত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ছবি বাংলাদেশ পুলিশ প্রকাশ করার আগেই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএস কয়েকটি ছবি প্রকাশ করে, যাদের হামলাকারী বলে জানায় তারা। পুলিশের এক ঘণ্টা আগেই হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিতর্কিত’ ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’। এরপরই একটি ছবির সঙ্গে ঢাকার এক যুবকের চেহারার মিল পায় তারই ফেসবুকের বন্ধুরা। আইএস প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে হাস্যোজ্জ্বল ওই তরুণ। পেছনে আইএসের পতাকা। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় সেই রাতে কতজনকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে- তাও পাঁচ জঙ্গীর মাধ্যমেই জেনেছে বলে মনে করা হচ্ছে। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার পেছনে রেখে যাওয়া অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জঙ্গীগোষ্ঠীর মাস্টারমাইন্ডের ব্যবহৃত কমান্ড সেন্টারটির খোঁজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুুক্তিগত বিশেষজ্ঞ ও গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের সহায়তা ও সাহায্য নেয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যেই আলোচনা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলাকারী পাঁচ জঙ্গী জীবদ্দশায় আইএসের পোশাক পরে যে ছবি তুলেছে এবং তারা নিহত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেছে- তাতে বুঝা যায়, মরতে তারা আগেভাগেই প্রস্তুত ছিল। আইএসের পোশাক পরে তোলা ছবিটি বাংলাদেশে তোলা হয়েছে নাকি অন্য কোন দেশে তোলা হয়েছে- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে গোয়েন্দারা। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার সময় যাদের নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের বীভৎস ছবি সংবলিত তথ্যই বা এত ত্বরিতগতিতে আইএসের হাতে গেল কিভাবে? নিশ্চয়ই জঙ্গীগোষ্ঠীর একটি কমান্ড সেন্টার আছে এবং কমান্ড সেন্টারের মাস্টারমাইন্ড থাকার যে অস্তিত্বটি আছে তার খোঁজ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় রাত প্রায় নয়টার সময় হামলা চালানোর পর রাত দশটার দিকেই সাইট ইন্টেলিজেন্সের টুইটার এ্যাকাউন্টে পাঁচ জঙ্গীর ছবিগুলো প্রকাশ করা হয়। অত্যাধুনিক একে-২২ রাইফেল হাতে হাসিমুখে আইএসের পোশাক পরিহিত জঙ্গীদের ছবিগুলো কখন কোথায় তোলা, তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। এটা স্পষ্ট যে, তারা যে মরতে প্রস্তুত এবং মারা যাওয়ার পর তাদের ছবিগুলো প্রচার করা হবে তারা জীবদ্দশায়ই তা জানত। সাইটের টেররিজম মনিটরের টুইটার এ্যাকাউন্টে এই জঙ্গীদের ছবি দিয়ে তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে- আবু উমর, আবু সালমা, আবু রহিম, আবু মুসলিম ও আবু মুহারিব। আইএসের প্রচার করা নামের সঙ্গে নিহত হওয়ার পর যে নাম পাওয়া যায় তার সঙ্গে মিল না থাকলেও চেহারা ও পরিচয়ে মিল পাওয়া যায়। গুলশানে নিহত হওয়ার পর তাদের নাম পাওয়া যায়- মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও সফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল। অথচ পুলিশ বলেছে, নিহত জঙ্গীদের নাম হচ্ছে- আকাশ, বিকাশ, ডন, বাঁধন ও রিপন। গোয়েন্দা সংস্থার সংগ্রহ করা তথ্যে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত জঙ্গী হুমকি পর্যবেক্ষণকারী ওয়েসসাইটটির পরিচালক রিটা কাটজ তার টুইটার এ্যাকাউন্টে বলেন, ‘বাংলাদেশ হামলায় পাঁচ হামলাকারীকে চিহ্নিত এবং ছবি প্রকাশ করেছে আইএস।’ সকালে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ওই খাবার দোকানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ২০টি লাশ পাওয়া যায়, যাদের গলা কেটে হত্যা করা হয়। নিহতদের অধিকাংশই বিদেশী নাগরিক। সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের ওয়েবসাইটে কয়েকজনের রক্তাক্ত ছবিও প্রকাশ করে বলা হয়, এরা গুলশানের ক্যাফেতে নিহত হয়েছেন। ঢাকা থেকে কারা কিভাবে এ ধরনের সংবাদ বা তথ্য প্রচারে সাহায্য করেছে তা এখনও রহস্যে ঢাকাই রয়ে গেছে। রহস্য উদ্ঘাটনে ও অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি, বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে জঙ্গী তৎপরতার প্রচার বন্ধের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে করছে গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, যে নামেই জঙ্গীগোষ্ঠীর তৎপরতা চালানো হোক না কেন এবং যত জঙ্গীই মারা পড়ুক না কেন, জঙ্গীগোষ্ঠীর মাস্টারমাইন্ড ও কমান্ড সেন্টারের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত জঙ্গী তৎপরতা নির্মূল করা যে অসম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। হামলাকারী জঙ্গীগোষ্ঠী যে ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে এবং তাদের যারা এ প্রযুক্তি ব্যবহারে সাহায্য করছে অর্থাৎ আশ্রয়দাতা, অর্থদাতা, মদদদাতা, নির্দেশদাতা হিসেবে পেছনে কারা কাজ করছে তার অকাট্য প্রমাণসহ খুঁজে বের করতে অত্যাধুনিক উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করার অপরিহার্য তা অনস্বীকার্য। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশী বন্ধুরাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই এটা করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার ঘটনায় নিহত পাঁচ জঙ্গীর ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। তদন্তকারী এ সংস্থাটি পাঁচ জঙ্গীর অস্থি-মজ্জা, রক্তমাখা জামাকাপড় আলামত হিসেবে জব্দ করেছে, যার ডিএনএ টেস্ট পরীক্ষা করার জন্য আবেদন করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম এ মামলাটির তদন্ত করছে। তদন্ত সংস্থার পুলিশ পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর সোমবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করে। এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত ও তথ্য প্রসিকিউশন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার আমিনুর রহমান বলেন, মামলার তদন্তের স্বার্থে মৃত পাঁচ জঙ্গীর পরিচয় নিশ্চিত হতে তাদের দেহের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য অস্থি-মজ্জা সংরক্ষণের আবেদন করা হয়েছে। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহের আবেদন করা হয়েছে। রক্ত, চুল ও জামাকাপড় আলামত হিসেবে জব্দ করার আবেদন করা হয়েছে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গীরা ১ জুলাই রাতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা, তিন বাংলাদেশীসহ ২০ জন জিম্মিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশী নাগরিক। পরদিন সকালে অপারেশন থান্ডারবোল্ড চালানো হয়। এ সময় পাঁচ জঙ্গী নিহত হয়। অভিযানে একজন জাপানী, দুইজন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ৪ জুলাই গুলশান থানায় হত্যা মামলা করে পুলিশ।
×