ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন আছে ছোটমণি নিবাসের ছোট্ট শিশুরা

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২৫ জুন ২০১৬

কেমন আছে ছোটমণি নিবাসের ছোট্ট শিশুরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে পরিত্যক্ত অবস্থায় কমবয়সী শিশুদের উদ্ধারের ঘটনা নতুন নয়। কখনও এরকম দু’একটি উদ্ধারের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে বড় বড় শিরোনাম হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ঘটনাই থেকে যায় অপ্রকাশ্য। পিতৃ-মাতৃহীন, পরিত্যক্ত এসব শিশুর ঠিকানা কোথায় হয়? কিভাবে তারা বেড়ে ওঠে? বড় হয়েই বা তারা কোথায় যায়? ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের একটি ওয়ার্ডের সারি সারি বিছানায় শুয়ে আছে কমবয়সী অসুস্থ শিশুরা। এদের মধ্যেই একজন রয়েছে ডাক্তারদের বিশেষ নজরদারিতে। ডক্টরস স্টেশনের পাশেই একটি বেবিকটে শুইয়ে রাখা হয়েছে শিশুটিকে। সে একটি কন্যাশিশু। মোটে দু’মাস বয়স তার। এরই মধ্যে তার শরীরে বড় ধরনের একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। জন্মের পরপরই তার পিতামাতা তাকে এ হাসপাতালেই ফেলে পালিয়ে গেছে। হাসপাতাল নিবন্ধন খাতায় উল্লেখিত ঠিকানায় গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি আর। বহু খুঁজেও আজও মেলেনি তাদের কোন খোঁজ। তবে নিবন্ধন খাতায় তার মায়ের নাম আসমা লেখা ছিল বলে তাকে ডাকা হচ্ছে ‘বেবি অব আসমা’ নামে। সাতান্ন দিন ধরে বেবি অব আসমাকে নিবিড়ভাবে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন শিশু বিভাগের অধ্যাপক কানিজ হাসিনা শিউলি আর তার সহকারীরা। আর শিশুটির অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছেন হাসপাতালেরই একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ওসমান গণি। বেবি অব আসমা সেরে উঠলে তার আইনগত অভিভাবকত্বও পেতে চান এই যুবক। এজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আবেদনও করে রেখেছেন মি. গনি। কিন্তু হাসপাতালে এরকম আরও অনেক শিশু আছে যাদের অভিভাবকত্ব নিতে এরকম কেউ আগ্রহ দেখায় না। ছোটমণি নিবাস ॥ গত বছরের (২০১৫) সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার পুরনো বিমানবন্দর এলাকায় একটি নবজাতককে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়, মৃত মনে করে কুকুরের একটি দল তাকে খেতে শুরু করেছিল। কিন্তু ভাগ্য শিশুটির পক্ষে ছিল। একদল মানুষ দৃশ্যটি দেখে কুকুরের দলটিকে তাড়িয়ে শিশুটিকে নিয়ে আসে হাসপাতালে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর শিশুটির এখন জায়গা হয়েছে আজিমপুরের ছোটমণি নিবাসে। কমবয়সী পরিত্যক্ত এবং দাবিদারহীন শিশুদের এনে রাখা হয় সরকারের এ প্রতিষ্ঠানে। ছোটমণি নিবাসে গিয়ে দেখা হয় শিশুটির সঙ্গে। তার নাম রাখা হয়েছে ফাইজা। ফাইজা অর্থ বিজয়িনী। নয় মাসের একটি ফুটফুটে হাস্যোজ্জ্বল কন্যাশিশু সে। তবে নাকে এবং হাতে এখনও সে বহন করছে কুকুরের কামড়ের ক্ষতচিহ্ন। ফাইজার মতো মোট ঊনিশটি শিশু রয়েছে ছোটমণি নিবাসে। এখানে একটি হলরুমের মতো বড় কামরায় শিশুদের থাকার ব্যবস্থা। সেখানে তাদের খেলার ব্যবস্থা আছে, বিনোদনের জন্য টিভি রয়েছে, রয়েছে নানা শিক্ষামূলক উপকরণ। হলরুমে গিয়ে দেখা যায়, লম্বা একটি খাটে সারি বেঁধে শুয়ে রয়েছে ছ’সাত মাস বয়সী ছয়-সাতটি শিশু। পাশেই রয়েছে এক সারি বেবিকট। সেখানেও রয়েছে দু’জন নবজাতক। দু’জনেরই বয়স এক মাসের কম। আর একটি বড় খাটে জড়ো হয়ে খেলছে ৪-৫ বছর বয়সী আরও জনাদশেক। এরা সবাই পিতৃ-মাতৃহীন, পরিত্যক্ত। কেউ জানে না এদের ঠিকানা কোথায়, আত্মীয়-পরিজন কারা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে এদের উদ্ধার করা হয়েছে। এখন রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে আছে তারা। কর্মকর্তারাই বলছেন, এরা যদি পারিবারিক আবহে থাকত তাহলে আরও ভালভাবে বেড়ে উঠতে পারত। এ নিবাসটিতে শিশুরা সাত বছর বয়স পর্যন্ত থাকতে পারে। এরই মধ্যে যদি আদালতের মাধ্যমে কেউ এদের অভিভাবকত্ব না নেয়, তাহলে তাদের জায়গা হয় সরকারেরই আরেক প্রতিষ্ঠান শিশু পরিবারে। সেখানে থাকতে পারে একটু বেশি বয়সী শিশুরা। দত্তকের কী ব্যবস্থা ॥ কর্মকর্তারা বলছেন, এই ছোটমণি নিবাস ও শিশু পরিবারগুলোতে থাকার চাইতে শিশুরা আরও ভালভাবে বেড়ে উঠতে পারত, যদি তারা থাকত পারিবারিক আবহে। কিন্তু সারাবিশ্বে দত্তক নেয়ার যে জনপ্রিয় ব্যবস্থা সে ব্যবস্থাটি বাংলাদেশের আইনে নেই। এ প্রসঙ্গে সমাজসেবা অধিদফতরের একজন পরিচালক জুলফিকার হায়দার বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধ-শিশুদের অভিভাবকত্ব দেয়ার জন্য ১৯৭২ সালে একটি দত্তক আইন করা হলেও পরবর্তীতে নানা অভিযোগের ভিত্তিতে ১৯৮২ সালে আইনটি বাতিল করা হয়। বিশেষ করে এই শিশুদের বিদেশে নিয়ে নানারকম অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত করার এবং তাদের ধর্মান্তরিত করার অভিযোগের বিষয়টিকে বাংলাদেশের সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। তবে কোন আইন না থাকলেও নানাভাবে বাংলাদেশের নিঃসন্তান দম্পতিরা শিশু দত্তক নিচ্ছেন। অনেকেই গোপনে নিচ্ছেন, কেউ কেউ যাচ্ছেন পারিবারিক আদালতে। অবশ্য কয়েকজন আগ্রহী নিঃসন্তান দম্পতি জানাচ্ছেন, পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে শিশুর অভিভাবকত্ব নেয়া গেলেও অনেক জটিলতার শিকার হতে হয় বলেও এ পথে তারা যেতে চান না। ভবিষ্যত কী এই শিশুদের ॥ আইনী জটিলতার কারণে অভিভাবকত্ব নেয়ায় অনাগ্রহ তৈরি হওয়ায় একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশুই রয়ে যাচ্ছে ছোটমণি নিবাসে। বয়স সাত বছর হলে তাদের জায়গা হচ্ছে শিশু পরিবারগুলোতে, যেখানে তারা থাকছে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর তারা ছড়িয়ে যাচ্ছে সমাজের মূলস্রোতে। সেখানে গিয়ে তারা কতটা টিকে থাকতে পারছে? মিরপুরে শিশুদের একটি কোচিং সেন্টার চালান নাজমুল হোসেন। গণিত নিয়ে তিনি অনার্স পড়ছেন, ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। যখন বুঝতে শুরু করেছেন তখনই নিজেকে আবিষ্কার করেছেন ছোটমণি নিবাসে। সেখান থেকে মিরপুরের শিশু পরিবার হয়ে এখন নিজের কোচিং সেন্টারের ভেতরেই থাকার একটি ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। তার জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে লেখা মিরপুরের শিশু পরিবার। পিতার নামের জায়গায় সেখানকারই এক কর্মকর্তার নাম। আর মায়ের নামটি কল্পিত। নাজমুলের ভবিষ্যত পরিকল্পনা গণিতে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করা। নাজমুলের সঙ্গে একই সাথে বেড়ে উঠেছে শিহান। শিশু পরিবারে থাকতেই নানা অপরাধের কারণে তাকে পাঠানো হয়েছিল ছোটদের কারাগার বলে খ্যাত গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে। এখন সে মিরপুরে বখাটে বলে পরিচিত। অভিযোগ আছে নানারকম ছোটখাটো অপরাধের সঙ্গেও সে জড়িত থাকে। একটি জীবনের অবসান ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ফিরে দেখা যাচ্ছে ‘বেবি অব আসমা’র শরীর বেশ খারাপ। ডাক্তারদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সবার চোখের সামনেই মারা গেল ‘বেবি অব আসমা’। অবসান হলো সাতান্ন দিনের যমে মানুষে টানাটানি। ওসমান গণি ডুকরে কাঁদছেন। কাঁদছেন ডাক্তাররাও। থমকে গেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০৫ নম্বর শিশু ওয়ার্ড। ‘বেবি অব আসমা’কে নুসরাত ফাহমিদা নামে ডাকতেন ওসমান গণি। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল মাত্র তেষট্টি দিন। সূত্র: বিবিসি।
×