ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বন্ধ ছিল সায়েদাবাদ থেকে আন্তঃজেলা ও গুলিস্তান পর্যন্ত সকল বাস;###;তিন মন্ত্রীর আশ্বাসে চলাচল শুরু

শ্রমিক নেতাদের কার্যালয় নিয়ে দ্বন্দ্ব, ১২ ঘণ্টার জনদুর্ভোগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২২ জুন ২০১৬

শ্রমিক নেতাদের কার্যালয় নিয়ে দ্বন্দ্ব, ১২ ঘণ্টার জনদুর্ভোগ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ টানা প্রায় ১২ ঘণ্টা দুর্ভোগের পর পরিবহন ধর্মঘট স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন। এর ফলে মঙ্গলবার বিকেল থেকে রাজধানীর সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা টার্মিনাল ও গুলিস্তান থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল শুরু হয়। সকাল থেকে বাস বন্ধের কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলগামী যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। গুলিস্তানের একটি কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে বিরোধে এই ধর্মঘট ডেকেছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি নং-৪৯৪)। সংগঠনটির সভাপতি আব্দুল ওদুদ নয়ন দুপুরেও বলেছিলেন, ওই কার্যালয়ের দখল তারা না পাওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন। বিকেলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তিন দিনের মধ্যে আমাদের কার্যালয় বুঝিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন সরকারের দুই মন্ত্রী। তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ও জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছে। এরপর থেকেই সায়েদাবাদ ও গুলিস্তান থেকে সকল রুটে বাস চলাচল শুরু হয়েছে। পুরো পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলেও জানান তিনি। তিনি আরও জানান, সংকট সমাধানে রাজধানীর ওয়ারী জোনের পুলিশ কমিশনার সৈয়দ নূরুল ইসলাম বিকেলে ধর্মঘট আহ্বানকারী শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে গোলাপবাগ কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম, সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন, শ্রমিক নেতা করম আলী, বিজন বর্ধন, মুকুল মৃধা, রেজাউল করিমসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে নয়ন জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট স্থগিত করেছেন তারা। ওদুদ নয়ন বলেন, আমাদের দাবি ছিল, আমাদের অফিস আমাদের বুঝিয়ে দেয়া এবং ইউনিয়ন হাইজ্যাকের যে চক্রান্ত চলছে তা বন্ধ করা। মন্ত্রীরা আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি মেনে নেয়া হবে। বুঝিয়ে দেয়া হবে কার্যালয়। এ কারণে এবং যাত্রী সাধারণের কথা বিবেচনা করে আমরা ধর্মঘট স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর আগে ঢাকা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে পুলিশের আরেক দফা বৈঠক হয়। এর পরপরই সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন জেলার বাস ছাড়া শুরু হয় বলে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আনিসুর রহমান জানান। তিনি বলেন, বিষয়টির একটি সুরাহা হয়েছে। টার্মিনালে আবার বাস চলাচল শুরু হয়েছে। ইউনিক পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক আব্দুল হক বলেন, আমরা টিকেট বিক্রি শুরু করে দিয়েছি। গুলিস্তানে বঙ্গভবনের পূর্ব পাশে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় রবিবার দখল করে ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে সোমবার জয়কালী মন্দির থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। তিন ঘণ্টা বন্ধ থাকে যান চলাচল। এরপর শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় দখলের প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকাল থেকে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন। পুরনো সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের (রেজি-৪৯৪) নিয়ন্ত্রণে ছিল গুলিস্তানে বঙ্গভবনের পূর্ব পাশের ইউনিয়ন কার্যালয়টি। রবিবার সফর আলী নেতৃত্বাধীন ঢাকার ইউনিয়ন ওই কার্যালয়টি দখলে নিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। সকাল থেকে ধর্মঘট শুরু হলে প্রতিপক্ষ বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে লাঠিসোটা নিয়ে সফর আলীর লোকজন সায়েদাবাদে এসে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করলে দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওদুদ নয়ন বলেন, ১৯৯২ সাল থেকে ওই কার্যালয়টি তারা ব্যবহার করে আসছেন। এখন হুট করে নতুন গজিয়ে ওঠা একটি সংগঠন তার দখল নিয়েছে। ফেডারেশন থেকে আমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করা হয়নি, কোন রকম নির্দেশনাও আসেনি। হঠাৎ করে একটি সংগঠনের নামধারী সন্ত্রাসীরা আমাদের অফিস দখল করল, ভাংচুর ও লুটপাট করল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন দুটোই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত সংগঠন। যার কার্যকরী সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ঢাকা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের জাতীয়ভিত্তিক কোন ইউনিয়ন থাকতে পারবে না। এর ফলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকারিতা ওখানেই শেষ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, যে অফিসটি নিয়ে বিরোধ, সেটি ঢাকা জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের। আদালতের মাধ্যমেই এটি মীমাংসিত। ঢাকা শ্রমিক ইউনিয়নের দাবির আইনী ভিত্তির বিষয়ে ওদুদ নয়ন বলেন, আদালত থেকে আমাদের কাছে কোন রকম নির্দেশনা আসেনি। যারা দখল করেছে, তারাও কোন কাগজপত্র দেখায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ সড়ক শ্রমিক পরিবহন ইউনিয়নের নেপথ্যে আছেন স্থানীয় সাংসদ হাবীবুর রহমান মোল্লা এবং ঢাকা জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের নেপথ্যে আছেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। ১৯৯৬ সালে ওই কার্যালয়টি নিয়ে রায় দিয়েছিল আদালত। তখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে থাকায় কার্যালয় দীর্ঘদিনেও ঢাকা জেলা শ্রমিক ইউনিয়ন দখলে যেতে পারেনি। তবে দুই সংগঠনই চাঁদাবাজির অর্থ ভাগ করে নিত। সম্প্রতি চাঁদাবাজির ভাগ ভাটোয়ারা নিয়ে আবারও দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এ নিয়ে দুইপক্ষই কঠোর অবস্থান নেয়। এর জের ধরেই মঙ্গলবার বন্ধ হয়ে যায় দূরপাল্লার বাস। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সৈয়দ নূরুল ইসলাম বিকেল পৌনে পাঁচটায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, দুই পক্ষের দাবি দাওয়া নিয়ে পরবর্তী সময়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হবে বলে জানানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সকালে সরেজমিন গুলিস্তানে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ঢাকা জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের শতাধিক শ্রমিক লাঠিসোটা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। কার্যালয়ের চাবি তাদের কাছে হস্তান্তর করার দাবি করছেন। চাবি না পাওয়া পর্যন্ত ওই দুই রুটে বাস চলাচল বন্ধ থাকবে বলে জানান। এদিকে বিষয়টি সমাধানের জন্য সংগঠনটির সঙ্গে পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সৈয়দ নূরুল ইসলাম তাঁর সায়েদাবাদ কার্যালয়ে দীর্ঘ সময় বৈঠক করেন। তবে ধর্মঘট আহ্বানকারী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের লোকজন বলছেন, তারা বাস চালানোর জন্য লাঠিসোটা নিয়ে উড়াল সড়কে অবস্থান নিয়েছিল। এদিকে ধর্মঘটের কারণে সকাল থেকে দিনভর যাত্রীরা এসে টার্মিনাল থেকে ফিরে যান। কাছাকাছি দূরত্বেও যাত্রীরা ভেন, রিক্সাসহ অটোরিক্সায় যাতায়াত করতে দেখা গেছে। মহানগরীর চার বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজির অভিযোগ ॥ বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি রুটে পরিবহন ধর্মঘট আহ্বানে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিকলীগের সভাপতি মোঃ রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকারকে জিম্মি করে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই একটি মহল অবৈধ পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়ে পরিবহন সেক্টরকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা থাকতে কোনভাবেই পরিবহন সেক্টরে গোলযোগ সৃষ্টি হতে দেব না। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিকলীগ আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। এ শ্রমিক নেতা বলেন, যারা ধর্মঘট আহ্বান করে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চান তারা দেশের শক্র, মানবতার শত্রু। আমরা কখনও চাই না পরিবহন সেক্টরে কোন রাজনীতি হোক। একজন চালক যখন গাড়ি না চালিয়ে ঘরে বসে থাকেন তখন তার পুরো পরিবার না খেয়ে থাকে। তখন কে এই পরিবারকে দেখে? তাই যারা এই অহেতুক ধর্মঘটের ডাক দেন তারা মনে রাখবেন, আপনি হয়ত ভালভাবে খেতে পারবেন কিন্তু একজন শ্রমিক কখনও ভালভাবে খেতে পারে না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক ইনসুর আলী বলেন, ঢাকা মহানগরীর চারটি টার্মিনালে ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে চাঁদাবাজির মহোৎসব শুরু হয়েছে। এছাড়া অনির্বাচিত পরিবহন শ্রমিক নেতারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে সরকার ও সাধারণ জনগণকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, এছাড়া নামধারী কিছু নেতাকর্মীরা অহেতুক পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিকলীগ। সভায় বক্তব্য রাখেন যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন, মোঃ আমির হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক আর এ জামান, প্রচার সম্পাদক মোঃ মোশাররফ হোসেন প্রমুখ।
×