ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

তাপস মজুমদার

সম্পূরক কৃষিভাবনা

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২২ জুন ২০১৬

সম্পূরক কৃষিভাবনা

এই লেখাটি গত সপ্তাহে প্রকাশিত লেখাটির পরিপূরক। ‘ধান-চালের কাহন’ শীর্ষক উপসম্পাদকীয়তে আমরা কৃষকদের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কথা বলার চেষ্টা করেছি। তবে শুধু ধান-চাল নয়, বরং অন্যান্য উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য বিক্রিতেও কৃষকের ন্যায্য দাম না পাওয়া তথা বঞ্চনার অভিযোগ আছে। শুধু বর্তমানে নয়, ভাগ্যবিড়ম্বিত বাংলার কৃষকের জন্য কেন যেন এই ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বঙ্কিমচন্দ্রের অত্যন্ত সুলিখিত প্রবন্ধ ‘বাংলার কৃষকে’ও এর সম্যক প্রমাণ মেলে। অর্থমন্ত্রীও প্রকারান্তরে তা স্বীকার করেছেন। বাজেটোত্তর কৃষি-অর্থনীতিবিদ সমিতি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এবং তারও আগে ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে তিনি তা আমলে নিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি ইতিবাচক লক্ষণ, অন্তত কৃষকের জন্য। তার মানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কৃষি ও কৃষকের সমস্যাদি অন্তত গুরুত্বসহকারে ভাবা হচ্ছে। অবশ্য তা না হয়েও উপায় নেই। কেননা মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষি খাতের অবদান এখনও উল্লেখযোগ্য। ১৬-১৭ কোটি লোককে তিন বেলা খাওয়ানো কম কথা নয়। এদিক থেকেও বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে অন্যতম রোল মডেল নিঃসন্দেহে। কেননা, এই দু’দিন আগ পর্যন্ত যে দেশটিকে খাদ্য চাহিদা মেটাতে হয়েছে চাল-গম আমদানি করে, সে দেশটি এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিতে বাংলাদেশকে ডেনমার্কের সঙ্গে তুলনা করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এই খাতে বিপ্লব ঘটে গেছে। ধান-সবজি, মাছ, ফলমূলও ভাল উৎপাদিত হচ্ছে। শুধু গবাদীপশু উৎপাদনে একই জায়গায় রয়ে গেছে। দুধের চাহিদাও মেটাতে হচ্ছে আমদানি করে। তবে সমস্যা প্রধানত উৎপাদক পর্যায়ে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ। এটা তো যে কেউ একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, কৃষক যদি তার শ্রমসমেত কৃষিজাত পণ্যের ন্যূনতম দাম তথা লাভের মুখ না দেখতে পারে, তাহলে সে স্বভাবতই কৃষি কাজে অনীহা দেখাবে। সম্ভবত এ কারণেই অনেকে এখন পরিশ্রমসাধ্য কৃষিকাজ থেকে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেদের। অন্তত ছেলেমেয়েদের এ কাজে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করছে। ধারদেনা করে হলেও, সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পাঠাচ্ছে শহরে। নিজেরা জীবনযাপন করছে কষ্টেশিষ্টে। অন্যদিকে কৃষি শ্রমিক পাওয়াও দুরূহ হয়ে উঠছে দিন দিন। ভূমিহীন ছিন্নমূল কৃষি শ্রমিকরা বেছে নিচ্ছে কম কষ্টের বিকল্প পেশা। ধান-চালের দাম বাজারে কম বিধায় কৃষিমন্ত্রী এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ধান সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কেনা হবে। তাতে অন্তত কৃষকের কিছু সুবিধা হলেও হতে পারে। এজন্য কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে। তবে অর্থমন্ত্রী আবার এই পদ্ধতির সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল কেনা অসুবিধাজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, সার-বীজ ইত্যাদিতে তাদের সুবিধা দেয়া হবে। তবে সরকারী ধান-চাল কেনা হবে মিল মালিকদের কাছ থেকেই। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, প্রকৃত অর্থে কৃষকের স্বার্থ দেখতে হলে সরকারের এই দ্বৈত অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে সমস্যা-সঙ্কট থেকেই যাবে। দেশে গত ক’বছরে শাক-সবজি, ফলমূল উৎপাদন বেড়েছে বহু গুণ। তবে বাজার ব্যবস্থা এবং সংরক্ষণের অবস্থা আদৌ ভাল না থাকায় এর একটা বড় অংশ অপচয়িত হয়ে থাকে প্রতিবছর। অর্থাৎ পচে যায়। এতেও কৃষক বা চাষীরা সমূহ লোকসান গোনে। দাম না পাওয়া এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। রাজধানীতে প্রতিদিন কাঁচামরিচ যোগান দেয়ার জন্য খ্যাত মানিকগঞ্জের বরঙ্গাইল বাজারে বর্তমানে প্রতিকেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ৬ থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা প্রতিকেজি। কাঁচামরিচ বস্তায় ভরে গাড়ি ভাড়া ও আড়তের কমিশন দিয়ে ব্যবসায়ী পর্যায়ে কারওয়ান বাজারে এনে বিক্রিও করতে হয়েছে প্রায় একই দামে। কেননা, মৌসুম বিধায় কাঁচামরিচের পাইকারি দাম পাওয়া যায়নি লাভের পর্যায়ে। অথচ খুচরা বাজারে কিনতে গেলে ১ কেজি কাঁচামরিচ নিম্নতম ৬০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। রোজার শুরুতে এর দাম উঠেছিল ৮০-১০০ টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৪ সালের উৎপাদনশীলতার জরিপ অনুযায়ী, এক কেজি শুকনা মরিচের উৎপাদন খরচ প্রায় ৫১ টাকা। চার কেজি কাঁচামরিচে এক কেজি শুকনা মরিচ হয়। সে হিসেবে এক কেজি কাঁচামরিচ উৎপাদনে ব্যয় হয় প্রায় ১৩ টাকা। ক্ষেত থেকে ১ কেজি মরিচ তুলতে কৃষকের ব্যয় হয় ২ টাকা। অথচ তাকে বিক্রি করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ টাকা প্রতিকেজি দরে। বাজারে প্রতিকেজি শুকনা মরিচ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা। সেক্ষেত্রে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা যদি ভাল থাকত, তাহলে কৃষককে অথবা ব্যবসায়ীকে লোকসান গুনতে হতো না। এরকম অবস্থা শুধু কৃষিপণ্যেই নয়, বরং ফলমূলসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। আমের ক্ষেত্রে অন-ইয়ার, অফ-ইয়ার প্রচলিত থাকলেও, আমের উৎপাদন এবার বেশ ভালই হয়েছে। মানুষ এখন গাছ-গাছালি ও বাগানের যতœ-আত্তি করে। রমজানে এবার বিদেশী আমদানিকৃত ফলের পাশাপাশি দেশীয় ফলের অফুরন্ত সমারোহ। আমের বৈচিত্র্যও লক্ষ্য করার মতো। দামও সহনশীল। এবার অন্তত একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, গাছপাকার মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতের আম গাছ থেকে সংগ্রহ ও বাজারজাত করা হবে। তবে বাস্তবে মনে হয় না, সেটা সর্বত্র মানা হয়েছে। অন্তত রাজধানীর বাজারে প্রায় সব রকম জাতের আমই পাওয়া যাচ্ছে, চোসা ও ফজলি বাদে। হাঁড়িভাঙ্গা, হিমসাগর, ল্যাংড়া, লক্ষণভোগ, গোপালভোগ ও অন্যান্য জাতও পর্যাপ্ত। গুটিআমও কম নয়। আমে ফরমালিন ব্যবহারেরও অভিযোগ এবার কম। মানুষ সচেতন হয়ে উঠেছে যথেষ্ট। তবে এই আমও অদিনে অর্থাৎ মৌসুম চলে গেলে তেমন পাওয়া যায় না। পেলেও দাম খুব বেশি। আবার ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানিকৃত আম পাওয়া যায় যথেষ্ট চড়া দামে। অথচ দেশীয় প্রজাতির ভাল আম সংরক্ষণ করা গেলে আমদানির প্রয়োজন হয় না। আম চাষীর স্বার্থও সংরক্ষিত হয়। এটা এমন কোন ব্যয়বহুল শিল্প-কারখানা নয়। দেশে এত বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি আছেন, কেউ এ নিয়ে কেন যে ভাবছেন না কে জানে? প্রাণসহ কেউ কেউ কিছু পরিমাণ জুস করে থাকে বটে। তবে তার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। জুসের বাইরেও আম অন্যবিধ উপায়ে সংরক্ষণ করা যায়। অনুরূপ করা যায় আনারস ও অন্যান্য ফল। বহু ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট চট্টগ্রামে আনারস প্রক্রিয়াজাতকরণের একটি কারখানা খুলেছিল। তবে মাথাভারি প্রশাসনের জন্য সেটির লালবাতি জ্বলতে সময় লাগেনি তেমন। আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, জাম, কলা ইত্যাদির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল একটি অফুরন্ত সাংবার্ষিক উৎস হতে পারে। দারুচিনি, এলাচি, গোলমরিচ, তেজপাতা, আদা, হলুদ, রসুনের জন্য পার্বত্য অঞ্চল ও সিলেট উপযুক্ত। কেন যেন অদ্যাবধি তা হলো না। অথচ রাজধানীর বাজারে অল্প বিস্তর সব পাওয়া যায়। ডেওয়া, করমচা, জামরুল, অড়বড়ই, রোয়াইল, কাঠলিচু, আঁশটেগোটা কী নয়। বাংলাদেশ তার অত্যন্ত উর্বর মাটি ও মিঠা পানি নিয়ে রীতিমতো গর্ববোধ করতে পারে সারা বিশ্বে। এখানে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে শুধু একটু ডাল ফেলে রাখলেই তাতে পত্রপল্লব গজিয়ে গাছ হয়ে যায়। আর বিদেশে মানুষ, মরুভূমিতে অথবা শীতপ্রধান দেশে কত কষ্ট করে শস্য ফলায়, ফলফলাদি জন্মায়। আমরা তার খবরও রাখি না, হায়! দেশে আখ চাষ ও চিনি শিল্প কারখানা নিয়ে অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন, তাও বুঝি সর্বাংশে ঠিক নয়। রমজানে এবার এক শ্রেণীর শিল্পপতি, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী চিনি ও ছোলা নিয়ে প্রকৃত অর্থেই ছিনিমিনি খেলেছেন। টিসিবি সীমিত সময়ের জন্য হলেও দ্রুতই পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। অন্তত গ্রাহকস্তরে হাহাকার ওঠেনি এ দুটো পণ্যের অপ্রাপ্তি নিয়ে। দু’চার জন ব্যবসায়ীর আর্থিক জরিমানাও হয়েছে। সত্য বটে, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত চিনির দাম কম। অন্যদিকে দেশীয় ১৫টি চিনি কলে লাখ লাখ টন চিনি অবিক্রীত পড়ে আছে। দেশে আখ চাষে লাগে ৮ মাস। এ সময় চিনি কলগুলো বসে বসে লোকসান গোনে। আখ চাষীদের অনেক টাকা বকেয়া পড়ে যায়। অর্থমন্ত্রীর হিসাবে শুধু আখ চাষের জন্য বছরে কয়েকশ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয় সরকারের। এও সত্যি। তাই বলে দেশীয় চিনির বাজারের পুরোটা বিদেশ থেকে আমদানিকৃত চিনির হাতে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই ভোজ্য তেলসহ কিছু খাদ্যপণ্যের আমদানি ও বাজারজাতকরণ মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। একসময় তারা চাল নিয়েও বাজার গরম করতে ছাড়েনি। সেক্ষেত্রে চিনির ক্ষেত্রেও মনোপলি ব্যবসা সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না কখনোই। তবে আখ চাষের জমি সীমিত করা যেতে পারে। উদ্বৃত্ত জমিতে ডাল, সয়াবিন জাতীয় ফসলের অবাদ করা যেতে পারে। দেশে গত কয়েক বছরে সরষের আবাদ বাড়া সত্ত্বেও ভোজ্য তেলে প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। সয়াবিন চাষ তেলের একটি ভাল উৎস হতে পারে, বর্তমানে যা আনা হয় বিদেশ থেকে। চিনি কলগুলো অন্যবিধ উপায়েও লাভজনক করা যেতে পারে। চিনির উপজাত হিসেবে প্রাপ্ত ইথানল, মিথানল হতে পারে জ্বালানির ভাল বিকল্প উৎস, যা পরিবেশবান্ধব। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও ব্রাজিলে জ্বালানির একটি বড় অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বায়োফুয়েল বা ইথানল। তাছাড়াও আখের ছোবড়া ভাল গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। দুগ্ধ খামার গড়ে তুলতে এটা হতে পারে প্রভূত সহায়ক। তবে এবার সব কথার শেষ কথা ও সারকথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, কৃষকদের আয় বেড়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে তাদেরও কর দিতে হবে। এখন যেমন তাদের কর অব্যাহতি রয়েছে আগামী দুই বছর পর অন্তত এই সুযোগটা থাকবে না। সত্যিই তো কৃষকরা কর দেবেন না কেন? তবে তার আগে তাদের আয় বাড়ানোর সুযোগ দিতে হবে। ডেনমার্কের সঙ্গে তুলনা করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কৃষিতে বিপ্লব ঘটে গেছে। প্রকৃত অর্থে কোন বিপ্লব ঘটেনি। বরং কৃষকের প্রাণান্তকর নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে গত কয়েক বছরে ধান-চালের উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। সাধারণ মানুষের প্রধান খাদ্য ভাতের সমস্যা মিটেছে অনেকটা। যদিও শতভাগ বলাটা একটু কঠিন বৈকি। তবে ধান-চাল বিক্রি করে লাভের অংশ না হোক, অন্তত উৎপাদন খরচ না তুলতে পারলে কৃষক কর দেবে কোত্থেকে? ধানের আবাদ করে তো কৃষকের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। তদুপরি দু’দিন আগে হোক পরে হোক সরকার যদি সার, বীজ, ডিজেল, সেচ ইত্যাদি থেকে ভর্তুকি সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয় অথবা কমিয়ে দেয় তাহলে কি হবে? সে অবস্থায় কৃষকের ওপর কর বসানোর আগে সরকারকে এসব বিষয়েও ভাবতে হবে বৈকি। কৃষিতে আদ্যপান্ত সংস্কারের কথা এ জন্যই বলা হয়েছে। বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থানের চাহিদাসহ শিল্প কারখানার অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য দেশে দিন দিন কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। ছোট-বড় গ্রামগুলো ক্রমশ ছোট-বড় শহরে পরিণত হতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে জমির ব্যবহারের একটি নীতি ও পরিসীমা নিয়ে ভাবা উচিত নীতিনির্ধারক মহলে। প্রধান খাদ্য চাহিদা সর্বদাই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহ করা ভাল। খাদ্য পণ্যের বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজার আপাতত নিম্নমুখী ও স্থিতিশীল থাকলেও বিশ্বব্যাপী জঙ্গীসন্ত্রাস ও যুদ্ধবিগ্রহের ডামাডোলে যে কোন সময় পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠতে পারে। একথাটি সর্বদাই মাথায় রাখা বাঞ্ছনীয়। শুরুতেই তো বলা হয়েছে, ‘পেট ঠা-া তো জগৎ ঠা-া’। এর পর আসে অনিবার্য পুষ্টির প্রসঙ্গটি। সার্বিক পুষ্টিমানে আমাদের ঘাটতি আছে এখনও। দেশে ৩৬ দশমিক এক শতাংশ শিশু খর্বকায়। জার্মানিতে এই হার ১ দশমিক ৩। খর্বকায় শিশুর ব্যাপকতা বিষয়ক তালিকায় (কম থেকে বেশি) শীর্ষে রয়েছে জার্মানি। আর বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭। সবচেয়ে নিচে আছে তিমুর লেসতে। আন্তর্জাতিক পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের একটি নিরপেক্ষ দল প্রস্তুত করেছে এই তালিকা। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট ‘ফ্রম প্রমিজ টু ইমপ্যাক্ট : এনডিং ম্যালনিউট্রেশন বাই ২০৩০’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে মঙ্গলবার (১৪ জুন ২০১৬)। এটি তৈরিতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিল গেটস ফাউন্ডেশন, কানাডা সরকার, ইউএসএআইডিসহ ৪০টির বেশি প্রতিষ্ঠান আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে। বৈশ্বিক পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে এই ধরনের তালিকা এটাই প্রথম। খর্বকায়ের পাশাপাশি কৃশতাও (ওয়াস্টিং) অপুষ্টির একটি সূচক। বিশেষজ্ঞদের মতে হঠাৎ অপুষ্টির শিকার হলে শিশু কৃশকায় হয়ে পড়ে। এই তালিকার শীর্ষে আছে অস্ট্রেলিয়া। অর্থাৎ সেখানে কোন কৃশকায় শিশু নেই। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৭। সর্বনিম্ন অবস্থান দক্ষিণ সুদানের। তবে আশার কথা এই যে বাংলাদেশের সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সরকার খর্বকায় শিশুর হার ২০১১ সালের ৪১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০১৬ সালের মধ্যে ৩৮ শতাংশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তা রক্ষিত হয়েছে। ইতোমধ্যে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য আইন, জাতীয় পুষ্টিনীতি ও অনপুষ্টিকণার স্বল্পতা নিয়ন্ত্রণ কর্মকৌশল প্রস্তুত করেছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অপুষ্টি দূর করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি পুষ্টিখাতে বরাদ্দ কম থাকারও সমালোচনা করা হয়েছে। সত্য বটে, দেশে ধান, সবজি, মাছ, ফল-মূল উৎপাদন বেড়েছে। তবে গবাদি পশু, পোল্ট্রি, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদনে অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। এর জন্য কৃষিকে একই সঙ্গে বহুমুখী, সমন্বিত, আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, বাণিজ্যিক ও রফতানিমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। দেশে অনেক ভাল ভাল কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষি অর্থনীতিবিদ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগার আছে। তাদের সম্মিলিত মেধার প্রয়োগ, উদ্যোগ ও বিনিয়োগে শেষ পর্যন্ত বিকশিত ও পুরিপুষ্ট হয়ে উঠতে পারে সার্বিক কৃষি খাতটি।
×