ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মনিবন্ধন- খোদ ঢাকাতেই মাত্র ১২ শতাংশ!

প্রকাশিত: ০৫:১২, ১৪ জুন ২০১৬

জন্মনিবন্ধন- খোদ ঢাকাতেই মাত্র ১২ শতাংশ!

আনোয়ার রোজেন ॥ মিরপুর নতুন কুর্মিটোলো ক্যাম্প এলাকার বাসিন্দা মোঃ জাবেদ। মেয়ে জান্নাতুল খাতুন সাকিনার জন্মের এক সপ্তাহ পরই নিবন্ধন করতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসে যান জাবেদ। সেখান থেকে ১০০ টাকার বিনিময়ে ফরম ‘কিনে’ পূরণ করে জমা দেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ২নং জোনাল অফিসে। এখানে তাকে দিতে হয় আরও ২০০ টাকা। সাকিনার জন্মনিবন্ধন সনদে দেখা যায়, তার জন্ম তারিখ ৩ জুন ২০১৫ এবং সনদ ইস্যুর তারিখ ২৯ জুন ২০১৫। এভাবে ৩০০ টাকার বিনিময়ে দুই সপ্তাহ পর মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদ হাতে পান জাবেদ। অথচ জন্মের তারিখ হতে দুই বছরের মধ্যে কোন ব্যক্তির জন্মনিবন্ধন বিনামূল্যে করে দেয়ার নিয়ম। আবার গত বছরের জুনে এক পরিপত্রের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাসরত কর্মজীবী শিশু ও পথশিশুদের জন্মনিবন্ধনের ফি মওকুফ করে সরকার। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ১০ আঞ্চলিক অফিসে বিভিন্ন প্রয়োজনে জন্মনিবন্ধন সনদ তুলে আনতে পথশিশু ও কর্মজীবী শিশুদের ৩শ’ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। শুধু ফি নেয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম নয়; নিজস্ব উদ্যোগ না থাকা, অসচেতনতা ও প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রেই সারাদেশের মধ্যে পিছিয়ে আছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৫ জেলায় শতভাগ ও ১৪ জেলায় ৯০ শতাংশ মানুষ জন্মনিবন্ধনের আওতায় এলেও ‘শিক্ষিতের’ শহর ঢাকায় এ হার মাত্র ১২ শতাংশ! সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে নির্বাচিত ওয়ার্র্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকেই নাগরিকদের বিভিন্ন সনদ দেয়া হতো। বিভক্ত সিটি কর্পোরেশনে দীর্ঘ চার বছর নির্বাচন না হওয়ায় এসব সনদ দেয়ার ক্ষমতা ন্যস্ত হয় ১০ আঞ্চলিক অফিসের নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে। বর্তমান নির্বাচিত দুই সিটি কর্পোরেশন পার করছে এক বছরেরও বেশি সময়। এর পরও নাগরিকদের সনদ দেয়ার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসেনি। রাজধানীর ৯২ ওয়ার্ডের এসব সেবা এখনও দুই সিটি কর্পোরেশনের ১০ আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে দেয়া হচ্ছে। ফলে ওসব অফিসে কাজের চাপ যেমন বাড়ছে, তেমনি সনদ নিতে আসা জাবেদের মতো নাগরিকরা শিকার হচ্ছেন হয়রানি ও ভোগান্তির। তবে বিনামূল্যের সনদে টাকা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে আঞ্চলিক অফিসের নির্বাহী কর্মকর্তা ও জন্মনিবন্ধনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বলেছেন, এসব শিশুর অভিভাবকদের বেশিরভাগই লেখাপড়া জানেন না। অনেকেই শিশুর প্রকৃত বয়স গোপন করতে চান। ফলে জন্মনিবন্ধনের আবেদন পূরণ, আবেদনের সঙ্গে কাউন্সিলরের সই, শিশুর বয়স প্রমাণের ডাক্তারি সনদ জমা দেয়া ইত্যাদি তাদের কাছে ঝামেলাপূর্ণ মনে হয়। এজন্য তারা স্বেচ্ছায় কর্পোরেশনের কিছু কর্মচারী ও বাইরের দালালকে টাকা দিয়ে কাজগুলো করিয়ে নেয়। অবশ্য নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলররা মনে করেন, জন্ম ও মৃত্যু সনদসহ বিভিন্ন ধরনের সনদ এককভাবে কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে দেয়া হলে এ সমস্যার সমাধান হবে। ফলে নাগরিকদের একবার কাউন্সিলর অফিস ও আরেকবার আঞ্চলিক অফিসে দৌড়াতে হবে না। জানা গেছে, সরকার বিদ্যালয়ে ভর্তি, বিবাহ নিবন্ধন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, পাসপোর্ট ইস্যু ও ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ ১৬ সেবা পেতে জন্মনিবন্ধন সনদের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। এজন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন প্রকল্পের আওতায় ২০০৫ সাল থেকে দেশজুড়ে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন এবং ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও অনলাইনের মাধ্যমে নাগরিকদের নিবন্ধন শুরু হয়। বর্তমানে প্রকল্পটির তৃতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম চলছে, যা চলতি মাসেই শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৮ জুন পর্যন্ত মোট ১৪ কোটি ৫৩ লাখ ২২ হাজার ৬৫৮ জন মানুষ জন্মনিবন্ধন করেছেন। ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৫ জেলা শতভাগ জন্মনিবন্ধনের আওতায় এসেছে। ১৪ জেলায় জন্মনিবন্ধনের হার ৯০ শতাংশের ওপরে। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নিবন্ধনের হার সবচেয়ে কম। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মাত্র ১২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ নিবন্ধনের আওতায় এসেছেন। ঢাকা দক্ষিণে এ হার ১২ দশমিক ২ শতাংশ। আর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। সামিগ্রকভাবে জন্মনিবন্ধনের হার সন্তোষজনক হলেও রাজধানীসহ গোটা দেশেই শিশুদের জন্মনিবন্ধনের পরিসংখ্যান হতাশাজনক। জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে সকল নবজাতকের জন্মনিবন্ধনের যে লক্ষ্য সরকার ঠিক করেছিল তা অর্জিত হয়নি। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধনের হার গত ১০ বছরে কখনই ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ অতিক্রম করেনি। আর জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রকল্পের হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের নবেম্বর সময়কালে জন্ম নেয়া এক কোটি ৪৮ লাখ নবজাতকের মধ্যে মাত্র এক লাখ ৯২ হাজার শিশু জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন প্রক্রিয়ার আওতায় এসেছে, শতকরা হিসাবে যা মাত্র ১ দশমিক ৩ ভাগ। এ প্রসঙ্গে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রকল্পের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন না হলে কিংবা নিবন্ধিত জন্মতথ্য সংশোধনের সুযোগ থাকলে শুদ্ধ জন্ম তারিখের সম্ভাবনা অনেকাংশে লোপ পাবে। সঠিক জন্ম তারিখ ছাড়া যদি অশুদ্ধ জন্ম তারিখ দিয়েই কার্য উদ্ধার হয় তাহলে জন্মনিবন্ধন করানোর কোন আবশ্যকতাই থাকে না। জন্মনিবন্ধনের মূল শর্তই হচ্ছে প্রকৃত জন্ম তারিখ দিয়ে নিবন্ধন, আর তা করতে হলে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। জন্মের পর জন্মনিবন্ধন শিশুর প্রথম রাষ্ট্র-স্বীকৃত দলিল হলেও শিশুর পিতামাতা প্রায় সবক্ষেত্রে শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর সময় অথবা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার সময় জন্মনিবন্ধন করিয়ে থাকেন। প্রকল্পের হিসাবমতে, ২০০৬ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্মনিবন্ধনের হার ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ১০ বছর ধরে এ হার বাড়তে থাকলেও তা কখনও ৫১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়নি। কর্মজীবী শিশু ও পথশিশুর জন্মনিবন্ধনের চিত্র ॥ গত বছরের ১৮ জুন এক পরিপত্রের মাধ্যমে দেশের ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাসরত কর্মজীবী শিশু ও পথশিশুদের জন্মনিবন্ধন ফি মওকুফ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে শর্ত দেয়া হয়, এসব শিশুর জন্মনিবন্ধনের আবেদনপত্রে তাদের নিয়োগকর্তা, আশ্রয়দাতা বা তত্ত্বাবধানকারী প্রত্যয়ন করবেন। এ ব্যবস্থায় গত এক বছরে কতসংখ্যক কর্মজীবী শিশু ও পথশিশু নিবন্ধনের আওতায় এসেছে সে হিসাব অবশ্য স্থানীয় সরকার বিভাগ বা সিটি কর্পোরেশনের কাছে নেই। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে এখন সাড়ে ৩৪ লাখ কর্মজীবী শিশু (১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী) রয়েছে। রাজধানীতে এসব শিশুর সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। পথশিশু ও কর্মজীবী শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সব এনজিও সংগঠনের কাছেও এসব শিশুর জন্মনিবন্ধনের বিষয়ের সঠিক কোন তথ্য নেই। ডিএনসিসির মিরপুর দুই নম্বর ওয়ার্ড এলাকার প্রায় নয় হাজার কর্মজীবী শিশুর ক্ষমতায়ন বিষয়ে কাজ করছে ওয়ার্ল্ড ভিশন। জানা গেছে, এসব শিশুর বেশিরভাগেরই জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। এ প্রতিষ্ঠানের চাইল্ড প্রটেকশন অফিসার সুরাইয়া জান্নাত জনকণ্ঠকে জানান, জন্মনিবন্ধন সনদের গুরুত্ব সম্পর্কে কর্মজীবী শিশু ও তাদের অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব রয়েছে। আবার এদের জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনও সব সময় সহযোগী নয়। তিনি অভিযোগ করেন, গত এপ্রিলে ১৫ কর্মজীবী শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য আবেদন করা হলে জোনাল অফিস থেকে মোটা অঙ্কের ফি দাবি করা হয়। অথচ এটা বিনামূল্যে হওয়ার কথা। তাই ওই ১৫ শিশুর জন্ম সনদের বিষয়টি এখনও ঝুলে আছে। অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডিএনসিসির দুই নম্বর জোনাল অফিসের নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নায়েব আলী জনকণ্ঠকে বলেন, জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে নির্বাহী কর্মকর্তার কোন ভূমিকা নেই। সম্পূর্ণ কাজটি করেন কর্পোরেশনের মেডিক্যাল অফিসার। তবে আমার জানামতে এসব শিশুর ক্ষেত্রে কোন ফি লাগার কথা নয়। জানতে চাইলে একই জোনের মেডিক্যাল অফিসার মাহমুদা আলী অভিযোগ অস্বীকার করে জনকণ্ঠকে বলেন, কেবল কর্মজীবী বা পথশিশু নয়, প্রতিবন্ধীদের জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রেও কোন ফি নেয়া হয় না। চূড়ান্ত জন্ম সনদ দেয় আঞ্চলিক অফিসের নিবন্ধকের কার্যালয়। সেখানে শিশুদের অভিভাবকদের অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু কর্মচারী ও বাইরের লোকের টাকা নেয়ার কথা তিনিও শুনেছেন বলে জানান। এদিকে নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলররা মনে করেন, জন্ম ও মৃত্যু সনদসহ বিভিন্ন ধরনের সনদ এককভাবে কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে দেয়া হলে নাগরিকদের ভোগান্তি অনেকাংশে লাঘব হবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) এক নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার ওয়াহিদুল হাসান মিল্টন বলেন, গ্রামে জন্মনিবন্ধনের যাবতীয় কাজ ইউনিয়ন পরিষদ থেকেই করা হয়। একই ভাবে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এ কাজ কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকেই করা যেতে পারে। ঢাকা দক্ষিণের ১৭, ১৮ ও উত্তরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলররাও এ বিষয়ে একই মত দেন।
×