ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ এখন অনেকটাই নিশ্চিত গুন্নু ও রবিন মিতুর খুনী

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৩ জুন ২০১৬

পুলিশ এখন অনেকটাই নিশ্চিত গুন্নু ও রবিন মিতুর খুনী

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে এসপিপত্নী মাহমুদা খানম মিতুর চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের ঘটনায় রবিবার পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোন ক্লু উদঘাটন করা যায়নি। সন্দেহজনকভাবে গ্রেফতারকৃত আবু নসর গুন্নু ও শাহ জামান রবিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে ১০ দিন করে রিমান্ডের প্রার্থনা করা হলে রবিবার আদালত এদের জন্য পৃথক পৃথকভাবে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। অপরদিকে, নৃশংস কায়দায় পুলিশ পরিবারের সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় আইজি একেএম শহীদুল হক রবিবার সকালে চট্টগ্রাম আসেন। তিনি একটি সুধী সমাবেশ ও আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। আইজির উপস্থিতিতে এ মামলার তদন্তে সহায়তার জন্য সিএমপির ১৬ থানার চার জোনের এসি ও ওসিদের সমন্বয়ে ৫টি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন সন্দেহজনক আরেক আসামিকে আটক করেছে। আজ তার রিমান্ড চাওয়া হতে পারে। এছাড়া তদন্ত সংস্থার হাতে আটক রয়েছে এক রিক্সাওয়ালাও। হত্যাকা-ের পর রবিন মোটরসাইকেল থেকে নেমে যে রিক্সাযোগে যায় তখন তার কাছে হত্যাকা- সম্পর্কিত কথোপকথন চলে, যা ওই রিক্সাওয়ালা শুনেছে। এ জন্য তদন্ত সংস্থা রিক্সাওয়লাকে তাদের জিম্মায় রেখেছে। তবে তার নাম পরিচয় কিছুই জানানো হয়নি। সবকিছু ছাপিয়ে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার তদন্তে কোন অগ্রগতি না আসায় তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন করে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মোঃ কামরুজ্জামানকে। পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত শাহ জামান রবিন কিলিং স্কোয়াডের সদস্য হিসেবে যে সন্দেহ রয়েছে তাতে পুলিশের মাঝে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। উর্ধতন কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপের মতে, রবিনই তিন হত্যাকারীর একজন। কিন্তু এসি ও ইন্সপেক্টর লেবেলের কর্মকর্তাদের মতে ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে রবিনের সম্পূর্ণ মিল পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া রবিন যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার কথা ছিল তা সে দেয়নি। ফলে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি হাটহাজারী থেকে গ্রেফতারকৃত সাবেক শিবির নেতা আবু নসর গুন্নুর রিমান্ডের শুনানি ছিল রবিবার। তাকেও সাত দিনের রিমান্ড দেয়া হয়েছে। এদিকে অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ অস্পষ্ট ভিডিও ফুটেজের ওপর নির্ভর করে সন্দেহভাজনদের ধরে এনে এ হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকা না থাকার বিষয়টি উদঘাটনের চেষ্টা চালাচ্ছে। মোবাইল কল লিস্ট কিংবা সিসি ক্যামেরার সুনির্দিষ্ট ফুটেজের ওপর ভিত্তি করে অভিযান না চালানোর কারণে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে। ফলে সন্দেহভাজনদের ধরে যেমন হয়রানি করা হচ্ছে, তেমনি অস্পষ্ট ফুটেজের ওপর ভিত্তি করায় প্রধান আসামি হিসেবে গত শনিবার গ্রেফতার হওয়া শাহ জামান রবিন থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায় করতে পারেনি। মূলত পুলিশের আত্মনির্ভরশীল তদন্তের অভাবে শেষ পর্যন্ত তদন্তকারী কর্মকর্তাকেও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আরেকটি সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে যে কর্মকর্তা দেয়া হয়েছে তিনিও তদন্তে তত চৌকস নন বলে গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে প্রশ্ন উঠেছে, এসপিপতœী মিতু হত্যার রহস্য আদৌ উদঘাটিত হবে কিনা। কারণ, এক সপ্তাহের ব্যবধানে যে তদন্তকারী কর্মকর্তার পরিবর্তন হওয়ায় তদন্তে কার্যকর ফলাফল না এসে উল্টো কালক্ষেপণ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশ বলে ধারণা দেয়া হচ্ছে। প্রসঙ্গত, রবিবার সিএমপির দামপাড়াস্থ শুটিং ক্লাবের সুধী সমাবেশে সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় সিএমপির পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত হত্যাকারীদের নিশ্চিত করতে না পারাটা দুঃখজনক। যা নিয়ে নগরবাসীর মনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে এবং সমাবেশে বক্তব্য দানকারীদের পক্ষ থেকেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকা-ের পর সচেতন মহলের আশা ছিল পুলিশ সহসা খুনী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করে মূল রহস্য উদঘাটন করবে। কিন্তু ঘটনার আটদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও এতে কোন অগ্রগতি আসেনি। ফলে নগরবাসীর মনে এক ধরনের উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। যার কারণে ঈদ মৌসুমের কেনাকাটায় অনেকে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে সাহস পাচ্ছে না। সূত্রমতে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুলিশের দায়িত্বহীনতা রয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থতার পরিচয় দিচেছ। পুলিশী কার্যকমের এসব ঘটনা অপরাধীদের উৎসাহী করে তুলছে বলে সুধী সমাবেশে বক্তাদের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়। তাদের মতে, পুলিশ জনগণের বন্ধু বলে যে উক্তি ছড়িয়ে আছে তা সাধারণ মানুষ বিশ্বাসে আনতে পারছে না। তারা এও বলেছেন, পুলিশ সদস্যরা একটু কঠোরভাবে তৎপর হলে অপরাধ যেমন দমন সম্ভব তেমনি নগরবাসীর নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যায়। সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ জুন সকালে এসপিপতœী মিতু হত্যার ঘটনার পর পুলিশ সন্দেহভাজনদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছে। আটককৃতদের মধ্যে গত মঙ্গলবার হাটহাজারীর পশ্চিম ফরহাদাবাদ এলাকার মুসাবিয়া দরবার শরীফ থেকে গ্রেফতারকৃত আবু নসর গুন্নুকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে। ফলে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত বৃহস্পতিবার গুন্নুকে চট্টগ্রাম আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। কিন্তু আদালতের বিজ্ঞ আদালত গুন্নুকে রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টি পুলিশের অনিশ্চিত তথ্যের কারণে রিমান্ড আবেদনের শুনানি করেননি। বরং তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর রাকিব উদ্দিনকে গুন্নুকে রিমান্ডে নেয়ার সঠিক তথ্য প্রদানের নির্দেশ দেন। এক্ষেত্রে গুন্নুর মোবাইল কললিস্টসহ রিমান্ড দাবি করার পেছনে সঠিক তথ্য জমাদানের নির্দেশ দিয়ে রিমান্ড শুনানি রবিবারের জন্য মুলতবি করেন। রবিবার গুন্নুর রিমান্ড শুনানি হয়েছে বিচারক হারুনুর রশীদের আদালতে। পুলিশের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আদালত গুন্নুকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অপরদিকে, শনিবার বায়েজিদ এলাকার শীতলঝর্না আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় শাহ জামান রবিনকে (২৮)। দুপুরে সিএমপি কমিশনার ও এডিশনাল কমিশনার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, ভিডিও ফুটেজে মোটরসাইকেল আরোহী তিনজনের মধ্যে রবিন একজন। কারণ, মোবাইল কল লিস্ট ও রবিনের চলাফেরা হত্যাকা-ের আগ থেকেই ওই স্থানে ছিল, যা ভিডিও ফুটেজে প্রমাণ মিলেছে। হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে রবিন মূল আসামি হতে পারে। ফলে রবিবার চট্টগ্রাম আদালতে সোপর্দের মধ্য দিয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেয়া হবে রবিনের। শনিবার বিকেল থেকে রাত অবদি পুলিশের পক্ষ থেকে রবিনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু রবিন ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করায় ও রবিবার চট্টগ্রাম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বায়েজিদ এলাকা থেকে জানা গেছে, রবিনের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। রবিন মূলত ৮ম শ্রেণী পাস। তার বাবা একজন ঠিকাদার। বাবার নাম মোঃ শাহজাহান। তবে বায়েজিদ এলাকার শীতলঝর্না আবাসিক এলাকার পক্ষ থেকে জানা গেছে, রবিন মূলত কোন পেশার সঙ্গে জড়িত নয়। তবে তার চালচলন ও দৌঁড়ঝাপ অনুযায়ী সে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। তবে এ অর্থ কোত্থেকে আসে সে বিষয়ে কোন সঠিক আয়ের উৎস জানা নেই রবিনেরও। এক্ষেত্রে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে, রবিন ছিনতাইসহ নানা অপরাধ কর্মকা-ে জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। রবিনের সঙ্গীরাও বখাটে টাইপের। মিতু হত্যার ঘটনায় রবিন ভাড়াটে খুনী হিসেবে কাজ করেছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মামলার তদন্ত নিয়ে নানা প্রশ্ন ॥ পুলিশ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কাজ করছে। অস্পষ্ট ভিডিও ফুটেজ নিয়ে পুলিশ তদন্তে দৃঢ়তা আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে অস্পষ্ট ভিডিও ফুটেজে অপরাধীদের শনাক্তকরণে যেমন স্পষ্টতা নেই, তেমনি তদন্তেও রয়েছে চরম গাফিলতি। গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে ইন্সপেক্টর রাকিব উদ্দিনকে মিতু হত্যার ঘটনার তদন্তের দায়িত্বভার দেয়া হলেও এ কর্মকর্তা কোন কার্যকর ফলপ্রসূতা দেখাতে পারেননি। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য বিভাগগুলো অনেকটা এগিয়ে গেছে তদন্তে। এক্ষেত্রে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতির বিষয়টি উঠে আসায় শনিবার রাতেই নতুন তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার (উত্তর) কামরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এদিকে, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকা-ের তদন্তে কামরুজ্জামানের অভিজ্ঞতা ও কৌশল নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, কামরুজ্জামান গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত অবস্থায় অপরাধীদের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে শাস্তিমূলক বদলি হয়েছিলেন বলে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। পুনরায় গোয়েন্দা বিভাগে যোগদান করা ও পুলিশ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ এবং চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তে কতটা তীক্ষèবুদ্ধির পরিচয় দেবেন তা নিয়ে সন্দিহান একাধিক কর্মকর্তা। পাঁচটি আলাদা কমিটি ॥ রবিবার আইজি চট্টগ্রামে আসার পর সিএমপির সদর দফতরে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠককালে চাঞ্চল্যকর এ মামলায় সহযোগিতার জন্য ৫টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অভিযান আসামিদের জেরা, কেস ডকেট পর্যালোচনা, ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ ও গোয়েন্দা তথ্য পর্যালোচনার জন্য এসব কমিটি গঠিত হয়েছে।
×