ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব কমবে;###;শ্রমবাজার, বিনিয়োগ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে সহায়তা বৃদ্ধি

নতুন মাত্রার সূচনা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১১ জুন ২০১৬

নতুন মাত্রার সূচনা

তৌহিদুর রহমান ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের মধ্যদিয়ে সেদেশে বাংলাদেশের ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব কমবে। এই সফরের ফলে ঢাকা-রিয়াদের মধ্যে নতুন মাত্রার সূচনা হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিরোধী লড়াইয়ে একজোট হয়ে কাজ করার জন্য দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে দুই দেশ। এছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরালো হয়েছে বলে আশা প্রকাশ করেছেন কূটনীতিকরা। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩-৭ জুন পাঁচ দিনব্যাপী সৌদি আরব সফর করেন। সৌদি আরব সফরকালে বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে বাংলাদেশের শ্রমবাজার, বিনিয়োগ, সন্ত্রাস প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয় আলোচনা হয়েছে। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের মধ্যদিয়ে আরও গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সৌদি আরবের গভীর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে এই জামায়াতে ইসলামী সৌদি আরবকে ম্যানেজ করার জন্য ব্যাপক লবিং চালিয়েছিল। তবে সেই লবিংয়ে কোন কাজ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রিয়াদ সফরকালে সৌদি বাদশার সঙ্গে বৈঠকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে কোন আলোচনাই হয়নি। শেখ হাসিনার সৌদি সফরের সময় এ বিষয়ে আলোচনা না হওয়ায় যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে সৌদি আরবের সমর্থন রয়েছে বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। আশির দশক থেকেই বাংলাদেশের ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সৌদি আরবের সখ্য গড়ে ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সৌদি আরব অর্থ সহায়তা দিয়েও আসছে। বিশেষ করে ওয়াহাবী মতাদর্শের প্রতি অনুগত হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক গভীর হয়। এই সম্পর্কের কারণেই যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে সৌদি আরবে জোর তৎপরতা চালিয়ে আসছিল জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে চাপে রাখার জন্য সৌদি আরবের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে আসছিল দলটি। তবে এই সফরের মধ্যে দিয়ে আরও স্পষ্ট হলো যে, সৌদি আরবের প্রতি জামায়াতের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসছে। এছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর একচ্ছত্র প্রভাবও আর থাকছে না। উইকিলিকসের প্রকাশিত এক নথিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে একাধিকবার জামায়াতে ইসলামী সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ আশা করেছিল। এছাড়া রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে বিএনপিও সৌদির মধ্যস্থতা চেয়েছিল। তবে সৌদি আরব তাতে সাড়া দেয়নি। ঢাকার সৌদি দূতাবাস থেকে রিয়াদে পাঠানো একাধিক কূটনৈতিক বার্তায় এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমেই সুস্পষ্ট হয় যে, সৌদি আরবের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক গভীর ছিল। বাংলাদেশে যুদ্বাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে অপপ্রচার চালানো হয়, সৌদি আরব এই বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে বলেও অপপ্রচার চালানো হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের মধ্যে দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সেসব অপপ্রচার এখন মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেননা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাদরে গ্রহণ করেছে সৌদি আরব। সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলেছেন, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে এ মুহূর্তে গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভাল সম্পর্ক বিরাজ করছে। অতীতে কখনও আমরা এত ভাল সম্পর্ক দেখিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সৌদি বাদশাহর পক্ষ থেকে দেয়া সম্মানে আমরা অভিভূত। প্রধানমন্ত্রীকে সৌদি বাদশাহর ব্যক্তিগত জেট ৭৪৭ দিয়ে মদিনা শরিফে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটা একটা বিরল সম্মান বলেও তিনি জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ড. ওয়ালিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও জোরালো হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে দুই দেশই এখন নতুন শক্তি পাবে। সৌদি আরব সফরের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রভাবও বাড়বে। এছাড়া সৌদি আরবের মধ্যেই বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে, সেসব সমস্যা তারা এখন নিজেরাও বুঝতে পেরেছে। সে কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তারা এখন আর মাথা ঘামাতে চাইছে না। এছাড়া আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, সৌদি আরবের সঙ্গে এদেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আগের মতো আর একচ্ছত্র প্রভাব নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরকালে সেদেশে শ্রমবাজার উন্মুক্তের বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য দেয় বাংলাদেশ। কেননা সৌদি আরবে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশী কর্মী কাজ করছে। দেশটিতে শ্রম বাজারে আধা দক্ষ ও দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ সৌদিতে আরও বেশি হারে জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায়। দেশটির শ্রমমন্ত্রী মুফরেজ বিন সাদ আল হাকবানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে আরও ৫ লাখ জনশক্তি নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব। এছাড়া বাংলাদেশের কর্মীদের তিনি ব্যাপক প্রশংসাও করেছেন। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক ছাড়াও চিকিৎসক, শিক্ষক ও প্রকৌশলীদের নেয়ার বিষয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি। সৌদি আরব সফরকালে ৫ জুন সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। দুই দেশের শীর্ষ নেতার এই বৈঠকে সৌদিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সন্ত্রাস প্রতিরোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের বিষয়েও আলোচনা করেছেন দুই নেতা। এছাড়া ইসলাম ধর্মের নামে বিভিন্ন দেশে দেশে যারা সন্ত্রাসবাদ কায়েম করছে, তাদের প্রতিহত করারও ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ। সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ প্রভাবশালী দেশ হিসেবে বিবেচিত। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও অর্থনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব। তাদের পাশ কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোন দেশ সাধারণত কিছু করতে পারে না। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের গভীর সম্পর্কের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর ওপরও বাংলাদেশের প্রভাব বাড়বে বলে আশা করছেন কূটনীতিকরা। সৌদি আরবের নেতৃত্বে আইএস বিরোধী সামরিক জোটের বিষয়ে ইতোমধ্যেই সমর্থন দিয়েছে বাংলাদেশ। আইএসবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব একযোগে কাজ করবে। আইএসবিরোধী জোটে থেকে সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইনফরমেশন বিনিময়, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজে যুক্ত থাকবে বাংলাদেশ। তবে প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের আগ মুহূর্তেই পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, সৌদি আরবে পবিত্র মসজিদ রক্ষার জন্য অতীতের মতো ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে সৌদি জোটে বাংলাদেশ সৈন্য পাঠাবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এমন সুস্পষ্ট বার্তা দেয়ায় সৌদি আরব বাংলাদেশের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেছে। গত বছর শেখ হাসিনাকে সৌদি আরব সফরের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানান সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। ওই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েই সৌদি আরব সফরে যান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের মধ্য দিয়ে সেখানকার শ্রমবাজার, বাংলাদেশের শ্রমবাজার, বাংলাদেশে সৌদি আরবের বিনিয়োগ ও অন্যান্য সহযোগিতাও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে ঢাকা ও রিয়াদের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ ও শক্তিশালী হয়েছে। দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়েও সফর হয়েছে। এবারের সফরের সময়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক হওয়ার জন্য একটি চুক্তিও সই হয়েছে। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল বিন আল জুবায়েরের আমন্ত্রণে দেশটি সফর করেন মাহমুদ আলী। সে সময় দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে আলোচনা করেন তারা। সৌদি আরবে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর রিয়াদ সফরের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী গত ৩-৭ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরব সফর করেন। উল্লেখ্য, সালমান বিন আবদুল আজিজ সৌদি আরবের বাদশা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এটাই ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সৌদি আরব সফর। এর আগে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী সরকার গঠনের পর ওই বছরই এপ্রিল মাসে সৌদি আরবে সরকারী সফর করেন। সে সময় প্রয়াত বাদশা আব্দুল্লাহর সাথে ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হন। তারই ধারাবাহিকতায় সৌদি সরকার পরবর্তীতে সেদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের জন্য ইকামা পরিবর্তন ও অবৈধ শ্রমিকদের জন্য সাধারণ ক্ষমার লক্ষ্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এবার প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীসহ উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রতিনিধি দলে ছিলেন। এছাড়া ১০ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলও প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে সৌদি আরব সফর করেন।
×