ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সন্দেহজনক মাইক্রোটি চালকসহ আটক

মিতু হত্যায় জড়িত সাবেক শিবির নেতা গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৯ জুন ২০১৬

মিতু হত্যায় জড়িত সাবেক শিবির নেতা গ্রেফতার

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকা-ের চতুর্থ দিন অতিবাহিত হয়েছে বুধবার। দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী পাঁচ সংস্থা পৃথক তদন্ত কাজ পরিচালনা শুরু করার পর প্রথমবারের মতো বুধবার গ্রেফতার হয়েছে মৌলবাদী ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক এক নেতা। তার নাম আবু নসুর গুন্নু (৪০)। হাটহাজারীর গ্রামের বাড়ি পশ্চিম ফরহাদাবাদ থেকে সকালে নসুরকে গ্রেফতার করা হয়। অপরদিকে, হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি উদ্ধার এবং এ মোটরসাইকেলের সাবেক দুই মালিক গ্রেফতার হলেও তৃতীয় মালিককে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। হত্যাকা- চলাকালে এটির নাম প্লেট ছিল ভুয়া এবং এর পাশাপাশি এটি চোরাই মোটরসাইকেল বলে ধারণা পেয়েছে পুলিশ। অপরদিকে, হত্যাকা-ের সময় কিলিং স্কোয়াডের সদস্যদের ব্যাকআপ দেয়ার কাজে থাকা কালো রঙের মাইক্রোবাসটিসহ এর চালককে সকালে বিশেষ অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। আটক মাইক্রোবাসটি শীর্ষস্থানীয় একটি শিল্প গ্রুপের বলে জানা গেছে। তবে চালক দাবি করেছে, এসপিপতœী হত্যাকা-ে তার বা মাইক্রোবাসটির কোন সংশ্লিষ্ট ছিল না। এর আগে মঙ্গলবার সিএমপি কর্তৃপক্ষ জানান, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে খুনীদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের পেছনে কালো রঙের যে মাইক্রোটি দেখা যায় সেটি খুনীদের সহযোগিতা করার জন্য এসেছিল বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন। পুলিশের ধারণা, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা সফল করার জন্য কিলিং মিশনের সঙ্গে জড়িতদের পরিকল্পনা ছিল বহুমুখী। সব পরিকল্পনাই তারা কাজে লাগিয়েছে। যে কারণে মিশন সফল হয়েছে। সিএমপি কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে জানানো হয়েছে তারা ৫টি সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন দিক নিয়ে তদন্ত পরিচালনা করছে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের তথ্য মিলেছে। সে অনুযায়ী অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে তদন্তে নিয়োজিত সদস্যদের দেয়া হচ্ছে। এমনই একটি প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে বুধবার সকালে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক কর্মী আবু নসুর গুন্নুকে গ্রেফতার করা হয়। সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, গ্রেফতারকৃত এই আবু নসুর এক সময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। পরে সে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। নসুর ১৯৯৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। এরপর সে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চলে যায়। বেশ কিছু দিন আগে দেশে ফিরে একটি মাজারের কর্মকা-ে নিজেকে নিয়োজিত করে। জঙ্গী সম্পৃক্ততায় তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া পুলিশের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, রবিবার মিতু হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত কিলিং স্কোয়াডের সদস্য এবং এ ঘটনার পূর্ব পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এ ধরনের নিশ্চিত তথ্য পাওয়ার পরও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। আজ বৃহস্পতিবার আদালতে সোপর্দ করার মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার রিমান্ড চাওয়া হবে বলে তদন্ত সংস্থা ডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। মিতু হত্যাকা-ের পর পুলিশ ও তদন্ত সংস্থাসহ দায়িত্বশীল মহলগুলোতেও নানা আলোচনার জন্ম দিলেও বুধবার পর্যন্ত হলফ করে কোন সংস্থা বলতে পারেনি কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তবে চট্টগ্রামে সম্প্রতি জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক তৎপরতা যে বৃদ্ধি পেয়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এ নেটওয়ার্ক দমনে বাবুল আক্তার কঠোর ভূমিকা রাখার কারণে তার স্ত্রীকে বলি হতে হয়েছে বলে ধারণায় উঠে আসছে। কিন্তু এসবই সন্দেহের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এসপি পতœী হত্যাকা- নিয়ে ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নও জিজ্ঞাসার উদ্রেক করেছে। হত্যার পরিকল্পনাকারীরা এ মিশন সফল করতে দীর্ঘ প্রস্তুতি নেয় বলে পুলিশের ধারণা। কারণ, ঘটনার আগের দিন ঐ ভবনে বসবাসরত বেশ কয়েক ছাত্রের অভিভাবকের মোবাইলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে স্কুলে যাওয়ার এসএমএস পাঠানো হয় বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য। এছাড়া হত্যার জন্য যে স্পটটি বেছে নেয়া হয় সেটি ওয়েল ফুড নামক একটি প্রতিষ্ঠান পেরিয়ে এবং প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির আগে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এছাড়া ঘটনাস্থল পেরিয়ে যে কালীবাড়ি রয়েছে এর সিসি ক্যামেরা চালু হয়েছে সকাল ৯টা থেকে। এর আগে এটি বন্ধ ছিল তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে হত্যাকারীদের অবয়ব গতিবিধি বা চেহারা যাতে সহজেই ধরা না পড়ে সে জন্যই তাদের এসব পরিকল্পনাগুলো পুলিশের ধারণা। চট্টগ্রামে জেএমবি, হরকাতুল জেহাদ, হিযবুত তাহরীরসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের সদস্যদের আন্ডারগ্রাউন্ড তৎপরতা রয়েছে। হিযবুত তাহরীর ইতোপূর্বে প্রকাশ্যে তাদের নীতি আদর্শ ও সরকার বিরোধিতায় লিফলেট প্রচার করত। এছাড়া বেনামে জঙ্গী সংগঠনের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের কয়েকজন গুণী ব্যক্তিকে হত্যার হুমকিও প্রদান করার ঘটনাও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে বলা হচ্ছে, ২০০৫ সালের পর থেকে জেএমবি’র তৎপরতা চট্টগ্রামের থমকে যায় বলে ধারণা করা হলেও পরবর্তীতে নীরবে এরা সংঘটিত হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন হত্যাকা-সহ অপকর্মে জড়াচ্ছে বলে পুলিশ মনে করছে। চট্টগ্রামে আমানবাজার, বাকলিয়ার খোয়াজনগরভিত্তিক জেএমবির দুই নেতা জাবেদ ও ফারদিন নিহত হওয়ার পর এদের আস্তানা থেকে যেসব গোপন তথ্য উদঘাটিত হয়েছে তা বাবুল আক্তারের অভিযানেরই সফলতা। জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে সোর্স লাগিয়ে বাবুল আক্তার এদের বহু গোপন কর্মকা- জেনে ফেলেছিলেন এবং সে অনুযায়ী হাটহাজারী, চট্টগ্রাম শহর এলাকা এমনকি বান্দরবান নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারে বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রসহ জঙ্গী ধরা পড়ার ঘটনা রয়েছে। বাবুল আক্তার জঙ্গীদের জন্য এক মূর্তমান আতঙ্ক। যে কারণে তিনি বহুবার বিভিন্নভাবে হুমকি পেয়েছেন। তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করার বিষয়টিও হুমকিতে রয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি সিএমপি সদর দফতর এবং পুলিশ সদর দফতরে উর্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিতও করেছেন। এরপরও নিজ এবং পরিবারের সদস্যদের নিñিদ্র নিরাপত্তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেননি। এসপি পদে পদোন্নতি পেলেও তিনি জঙ্গী দমন তৎপরতায় চট্টগ্রামে অবস্থানের পক্ষে ছিলেন। গত রবিবার স্ত্রী হত্যাকা-ের দিন ঢাকা পুলিশ সদর দফতরে তার যোগদানের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তার আগেই তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু দুর্বৃত্তদের নৃশংস কায়দায় হত্যাকা-ের বলি হন। এদিকে, দেশে বর্তমানে বিএনপি-জামায়াতের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দমনে সরকারের কঠোর ভূমিকার কারণে জামায়াত-শিবিরের অনেক ক্যাডার জঙ্গী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়েছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। চট্টগ্রামে জঙ্গী সংগঠন হামজা ব্রিগেডের অধিকাংশ নেতাই হচ্ছে শিবিরের সাবেক কর্মী। সংগঠনটি জন্ম দিয়ে এর তৎপরতা সম্প্রসারিত করার মুহূর্তে নগরীর ফয়স লেক এলাকার একটি হোটেলে বৈঠক চলাকালে পুলিশ অভিযান চালিয়ে এদের গ্রেফতার করে। এরপর থেকে এ সংগঠকদের কার্যক্রম লক্ষ্যণীয় নয়, তবে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে এটি আবার সংঘটিত হচ্ছে কিনা তা নিয়ে পুলিশের সন্দেহ রয়েছে। এর পাশাপাশি জেএমবি ও হুজির নেতাকর্মী ও সমর্থক বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। চট্টগ্রামে যে ল্যাংটা ফকিরকে হত্যা করা হয়েছে তা জেএমবি দ্বারা সংঘটিত বলে পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) তৎপরতাও অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জঙ্গী সংগঠনগুলোর তৎপরতা যে পর্যায়ে চলছে অনুরূপভাবে পুলিশী তৎপরতা নেই বলেও অভিযোগ এন্তার। মহানগরীতে পুলিশ বেড়েছে, থানা বেড়েছে। তদন্ত সংস্থাও বেড়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের দমনে সফলতার হার সন্তোষজনক নয়। এ ব্যাপারে সিএমপির কর্মকর্তা পর্যায়ের অনেকের অনভিজ্ঞতা, অবহেলা ও দলবাজির অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে নতুন নিয়োগকৃত কমিশনারের নেতৃত্বে সিএমপি পরিচালিত হচ্ছে। তার অধীনে কর্মকর্তাদের অনেকেই নতুন আসা। চট্টগ্রাম মহানগরীতে অপরাধ, সন্ত্রাস ও জঙ্গী তৎপরতা নিয়ে যাদের অভিজ্ঞতা অনেকাংশে কম বলেও পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হয়ে থাকে।
×