ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেট বাস্তবায়নে সংশয় সিপিডির

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৪ জুন ২০১৬

বাজেট বাস্তবায়নে সংশয় সিপিডির

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ও লক্ষ্যমাত্রা ঠিক বললেও বাজেট বাস্তবায়নে সংশয় প্রকাশ করেছে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। আয়-ব্যয়ের কাঠামো দুর্বল উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, ঘাটতি অর্থায়নে বিশাল লক্ষ্যভেদ করার মতো শক্তি প্রস্তাবিত বাজেটে নেই। প্রতিবছর বাজেটে ‘বাড়তি’ প্রাক্কলন এবং অর্থবছর শেষে তা অর্জন করতে না পারার মধ্য দিয়ে ‘আস্থার সঙ্কট’ তৈরি হচ্ছে বলেও মনে করছে সিপিডি। এছাড়া বাজেটে প্রাক্কলিত মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) ৭ দশমিক ২ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে বাজেট বাস্তবায়নের নিয়মিত অগ্রগতি সংসদের মাধ্যমে জনগণকে জানানো উচিত বলে মত দিয়েছে গবেষণা সংস্থাটি। শুক্রবার জাতীয় বাজেট ২০১৬-১৭ সিপিডির পর্যালোচনা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় বলেন, টাকার অঙ্কে বাজেটকে বিশাল বড় ও উচ্চবিলাসী বলা হচ্ছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতির তুলনায় এটি বড় নয়। অর্থবছর শেষে দেশের মোট জিডিপি হবে ১৯ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসেবে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বাজেটে মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটে মোট ব্যয় ছিল এর কাছাকাছি। ধারাবাহিকভাবে বাজেটের আকার জিডিপির ১২ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) বরাদ্দ ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বিগত বছরগুলোতেও এর কাছাকাছি ছিল। জিডিপিতে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ২০১২ সালের ১০ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে কমে চলতি বছরে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ রয়েছে। জিডিপিতে বিনিয়োগের অংশ ক্রমশ কমছে। সুতরাং অর্থনীতির আকার যেভাবে বেড়েছে বাজেটের আকার সেই ভাবে বাড়েনি। তাই উচ্চবিশালী বিশাল এসব বলে বাজেট নিয়ে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। সিপিডি বলছে, বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি, জনসেবা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন, কর ও শুল্ক কাঠামোতে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য। কিন্তু সেই সঙ্গে বিদেশী সাহায্য ব্যবহার, এডিপি বাস্তবায়ন, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর আহরণের কৌশল নিয়ে বাজেটে স্পষ্ট কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়নি জানিয়ে অতি প্রাক্কলনের প্রবণতার সমালোচনা করা হয়েছে। দেবপ্রিয় বলেন, অনেকে বলছেন বেশি পরিমাণে প্রক্ষেপণ করি যদি কিছু হয়, হিসেব করে যদি প্রক্ষেপণই কম করতাম তাহলে ওইটুকু করারও আগ্রহ থাকত না। আমরা এই যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে করি না। যদি প্রক্ষেপণে বিশ্বাস না থাকে, প্রক্ষেপণের সেই অর্থে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেলে নীতির দক্ষতা নষ্ট হয়ে যায় এবং তখন কেউই তা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে না। তিনি বলেন, শুধু আকার বাড়ালে হবে না বাজেটের গুণগতমান বাড়াতে হবে। আয় ও ব্যয়ের কোন লক্ষ্যমাত্রাই অর্জিত হয় না। লক্ষ্যমাত্রা ও প্রকৃত অবস্থার মধ্যে ব্যবধানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিবেশী অন্য রাষ্ট্রে এই ব্যবধান অনেক কম। ভারতে উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রায় সাড়ে ৮০ শতাংশ অর্জিত হলেও বাংলাদেশে হয় ৭৩ শতাংশ। ভারত যেখানে কর আদায়ে লক্ষ্যের ৯৩ শতাংশ পূরণ করতে পারে, সখানে বাংলাদেশে হয় ৮০ শতাংশের নিচে। প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভারত ৯৩ শতাংশ বাস্তবায়ন করে, আর বাংলাদেশ করে সাড়ে ৮১ শতাংশ। দেবপ্রিয় বলেন, সরকার মোটামুটি স্বস্তির মধ্যে এবারের বাজেট দিলেও ‘কিছু টেনশন’ তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি টাকার অতিমূল্যায়ন হয়েছে, যা রফতানি ও মূল্যস্ফীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে দেশের বাজারে তেলের দামের সামঞ্জস্যবিধান হয়নি। প্রবাস আয়ের নিম্নমুখী প্রবণতা এর লক্ষ্যমাত্রা নাও অর্জিত হতে পারে। এ বাজেটের ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে অর্থায়নের বিষয়টিকে এ বাজেটের অন্যতম দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, ওই ঘাটতির ৪০ শতাংশ বিদেশী অর্থায়নে মোটানোর কথা বলা হলেও সেজন্য বড় কোন উদ্যোগের কথা বাজেট কাঠামোতে নেই। বাংলাদেশে যেখানে কখনও বছরে ৩ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার হয়নি, সেখানে কীভাবে রাতারাতি ৬ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ ব্যবহার করা হবে? আর ঘাটতি মেটাতে দেশীয় উৎস থেকে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ধার করার যে পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে তাতে সুদ ব্যয় আরও বাড়বে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বছর শেষে সরকারের ভাষ্যমতে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। এর বড় নিয়ামক হচ্ছে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কারণে সেবা খাতের অবদান বেড়েছে। তবে আগামী বছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে কৃষি ও শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। এজন্য ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আরও ৮০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারী আয় ৬৫ হাজার কোটি ও ব্যয় ৭৫ হাজার কোটি টাকা বাড়াতে হবে। আগামী বছর বিনিয়োগ বাড়বে বলে বলা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে বাড়বে তার রূপরেখা নেই। বিনিয়োগ বাড়ানোর মতো অর্থ যোগান দেয়ার মতো অবস্থা আছে কিনা তাও দেখতে হবে। বর্তমানে অর্থ যোগানের দুই মাধ্যমে পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী দুর্বলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে মন্তব্য করে সিপিডি বলছে, দেশে আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব খুবই প্রকটভাবে এসেছে ব্যাংকিং খাতের ভেতরে। বড় বড় কোন প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হয়নি। এছাড়া প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ানো হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থ দরকার তা বরাদ্দ দেয়া হয়নি। বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বেসরকারী বিনিয়োগ চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। নতুন বাজেটে চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, বাজেটে বাস্তবায়নের আগের সমস্যাগুলোই রয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজস্ব আয়, বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় ও বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারের দুর্বলতা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দিক নির্দেশনায় সিপিডি বলছে, বাজেট প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অংশগ্রহণ বাড়ানো, বাজেট বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন, নিয়মিত ত্রৈমাসিক রিপোর্ট পেশ ও পর্যালোচনা এবং কার্যকরী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা আনতে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সরকারী ব্যয় মূল্যায়ন কমিশন গঠন করা, সরকারের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় প্রকাশ, স্থানীয় প্রশাসনকে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করণ, সরকারী ব্যয়ে এনজিওগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা ইত্যাদি।
×