ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইউপি ভোটে সহিংসতা-এরশাদ আমলের রেকর্ড ছাড়িয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩১ মে ২০১৬

ইউপি ভোটে সহিংসতা-এরশাদ আমলের রেকর্ড ছাড়িয়েছে

স্টাফ রিপোটার ॥ ইউপি নির্বাচনে ভোটের দিন সহিংসতায় প্রাণহানির অনন্য নজির রয়েছে ১৯৮৮ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলের। ওই নির্বাচনে প্রাণহানির ঘটনা দেশের একটি রক্তাক্ত ইতিহাস। অতীতের ইউপি নির্বাচনে প্রাণহানির তথ্য অনুযায়ী ’৮৮ সালের ইউপি নির্বাচনে প্রাণহাণির ঘটনা ঘটেছে ১শ’ জনের কাছাকাছি। এছাড়া ১৯৭৩, ’৭৭ ’৮৩ সালের ইউপি নির্বাচন বাদ দিলে সব নির্বাচনে বিচ্ছিন্ন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এ বছর এখন পর্যন্ত পাঁচ দফা ইউপি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। পাঁচ দফায় ভোটগ্রহণের দিন সহিংসতায় মাত্র ৩৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে, যা ’৮৮ সালের নির্বাচনের এক-তৃতীয়াংশ। ভোটগ্রহণের আগে-পরে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা সব নির্বাচনেই ছিল। কিন্তু এবারের মতো এত আলোচনা আগে কখনও হয়নি। এবারের নির্বাচনে এখন পর্যন্ত প্রথম ও পঞ্চম দফায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বেশি। প্রথম দফা ভোটের দিন সহিংসতায় ১০ জন এবং পঞ্চম দফায় ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এ প্রাণহানির ঘটনায় কমিশনের দায়িত্বশীলতার অভাবও রয়েছে বেশ। বিশেষ করে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন শেষে পরবর্তী ধাপের নির্বাচন সহিংসতামুক্ত করতে ইসির ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। এ কারণে তৃতীয় দফায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে মাত্র একজনের। তাও আবার নির্বাচনপরবর্তী ভোট গণনা কেন্দ্র করে পাবনায় মারা যায় একজন। তবে চতুর্থ দফায় নির্বাচনের পর কমিশনের পক্ষ থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হলেও তার বাস্তবায়ন ছিল না। এছাড়া এ দুই দফায় সহিংসতা রোধে ইসির বিশেষ কোন উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে চতুর্থ দফায় চারজনের এবং পঞ্চম দফায় ১১ জনের প্রাণ ঝরে যায়। এছাড়া দ্বিতীয় দফায় প্রাণহানি হয়েছে আটজনের। নির্বাচন কমিশনার মোঃ শাহনেওয়াজ বলেছেন, নির্বাচনের মৃতের যে সংখ্যা দেখানো হচ্ছে প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে কম হবে। স্বাধীনতার পর এবার দেশে নবমবারের মতো ইউপি নির্বাচন হচ্ছে। প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে। ওই নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সব জায়গায় পুলিশও নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। গ্রামের চৌকিদাররা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। তার পরও তেমন সহিংসতা হয়নি নির্বাচনে। একই পরিস্থিতি ছিল ১৯৭৭ সালের ইউপি নির্বাচনে। ১৯৮৩ সালে নির্বাচনের দায়িত্ব প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত হয়। সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনেও বড় ধরনের সহিংসতার তথ্য পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে জঘন্য ইউপি নির্বাচন হয় ১৯৮৮ সালে। সারাদেশে একদিনে হওয়া ওই নির্বাচনে সব কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। দেশজুড়ে চলে ভোটকেন্দ্র দখলের মচ্ছব। ওই নির্বাচনের পর থেকেই ইউপি নির্বাচন দফায় দফায় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কমিশন থেকে। ১৯৯২ সালে পঞ্চম ইউপি নির্বাচন নিয়েও তেমন অভিযোগ ছিল না। ওই নির্বাচনের সময় বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও সবচেয়ে বেশি ইউনিয়নে জয় পায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। এর পর ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রাণহানি ঘটে ৩১ জনের। ২০০৩ সালে সপ্তম ইউপি নির্বাচনে ২৩ জনের প্রাণহানি ঘটে। আর ২০১১ সালের ২৯ মার্চ থেকে শুরু হয়ে জুলাইয়ে শেষ হওয়া অষ্টম ইউপি নির্বাচনে মাত্র ১০ জনের প্রাণহানি হয়েছে বলে ইসি সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে ১৯৯২ সালের পর এবারই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে তারা জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ’৮৮ সালের ওই ইউপি নির্বাচনে যত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে তা রক্তাক্ত ইতিহাসের রেকর্ড সৃষ্টি হয়ে রয়েছে। তবে ওই সময়ে মিডিয়ায় মাতামাতি ছিল না। পরের নির্বাচনগুলোতে নির্বাচনের আগে-পরে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে এত আলোচনার সৃষ্টি হয়নি। তবে এবারের নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিনে মৃত্যুর ঘটনার পাশাপাশি নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা নিয়েও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তার পরও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনে একটি প্রাণহানির ঘটনাও দুঃখজনক। কাজেই নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে আরও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নির্বাচনের সময় কমিশন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। নির্বাচনকালে স্থানীয় প্রশাসনও কমিশনের নির্দেশে পরিচালিত হওয়ার কথা। কাজেই নির্বাচন কমিশন কার্যকর ব্যবস্থা নিলে সংঘাত-সংঘর্ষ অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। এজন্য তালিকাভুক্ত সংঘাতপ্রবণ এলাকা ও কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা উচিত। তাদের মতে, নির্বাচন সামনে রেখে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা হয়ত পুরোপুরি কমানো সম্ভব হবে না। তার পরও এ বিষয়ে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদ জনগণের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও আস্থার জায়গা। এখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তাই এ নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের কোন অন্ত থাকে না। সারাদেশ উৎসবের আমেজে মেতে ওঠে। ভোট প্রদানে অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে শুরু করে নবীন তরুণও উন্মুখ হয়ে থাকে। নারী ভোটারদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও এ নির্বাচন মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচিত। তাই এ নির্বাচন যতটা সহিংসতামুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে ততই জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ওপর নজর রাখা ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, পুরো বিষয়টি একটি কাঠামোগত সমস্যা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অনেকদিন থেকেই স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা হলো। এটাতে হয়ত সমস্যা থাকত না যদি একটি সাযুজ্যপূর্ণ কাঠামো থাকত। প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে যদি শুধু কাউন্সিলর ও মেম্বাররা নির্বাচিত হতেন, পরবর্তী সময়ে ওই মেম্বার ও কাউন্সিলররা যদি চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচন করতেন তাহলে দায়বদ্ধতার জায়গা অনেক স্বচ্ছ ও নাগালের মধ্যে থাকত। যেমনটা পশ্চিমবঙ্গে হয়ে থাকে। সরাসরি চেয়ারম্যানরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার কারণে সহিংসতা অনেকখানি বেড়েছে। যদি চেয়ারম্যানদের দায়বদ্ধতা শুধু কাউন্সিলরদের কাছে থাকত তাহলে কাঠামোটাই শক্তিশালী হতো বলে মনে হয়। তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচনে যে সহিংসতা বিদ্যমান সেটা ভালভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। বর্তমানে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে মান্ধাতা আমলের নির্বাচনী কাঠামো বলা যেতে পারে। কারণ একটি মাত্র ভোট বেশি পেলেই একজন জয়ী হচ্ছে। সেখানে আর অন্য কোন বিবেচনা থাকছে না। এটা কোনভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। তাই এর বিপরীতে সংখ্যানুপাতিক বা সমানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচন করা যেতে পারে। বিশ্বের ৮০টির মতো দেশে এ সমানুপাতিক নির্বাচনী কাঠামো প্রচলিত আছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, স্থানীয় সরকার পরিষদ দলীয় দখলে রাখার বিষয়ে সব সরকারেরই চেষ্টা ছিল। যে কোন উপায়ে তারা স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে এ নির্বাচন কখনই সরকারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে অনুষ্ঠিত হয়নি। সবচেয়ে সহিংস এবং রক্তাক্ত উদাহরণটি সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৮৮ সালে এরশাদের সামরিক শাসনামলে। চর দখল, ভোটকেন্দ্র দখল ও রক্তপাতের জন্য ওই নির্বাচন এখনও অনেকে ভুলে যাননি। এর পরের নির্বাচনগুলো মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হলেও সরকারী হস্তক্ষেপের অভিযোগ সব সময়ই ছিল। আগের নির্বাচনগুলোর পরিবেশ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এলাকায় যার প্রভাব বেশি সেসব এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন হিসেবে পরিচিত এবারের ইউপি নির্বাচনেও মূলত এলাকায় প্রভাবেই জাল ভোট, কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে। নিজের এলাকায় প্রার্থীর ব্যক্তিগত প্রভাব মূলত তাদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নির্বাচন কমিশনের মতে, ইউপি নির্বাচন দেশের একটি বড় নির্বাচন। সুষ্ঠুভাবে এ নির্বাচন সম্পন্ন করা কঠিন একটি বিষয়। অনেক পক্ষ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে। কমিশনের নিজস্ব লোক না হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কমিশনের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণেই অতীতের সব নির্বাচনের মতো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা থাকে যা রোধ করা সম্ভর হয় না। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
×