ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ২৯ মে ২০১৬

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

(গতকালের পর) তারপর রাষ্ট্রপতি সাত্তার এরশাদকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং মেজর জেনারেল শামসুজ্জামানকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানা যায়। রাষ্ট্রপতি তথ্যমন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরীকে টেলিভিশন ও বেতারে এই সংবাদ পরিবেশন করার নির্দেশ দেন এবং মেজর জেনারেল শামসুজ্জামানকে তার নতুন নিয়োগের কথা বলেন। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরী জাতীয় সম্প্রচারে এই ঘোষণা দেয়ার পরিবর্তে এরশাদকে অবহিত করেন। [পৃ. ৮৫] মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খান লিখেছেন আমার সৈনিক জীবন। ঢাকা থেকে ২০১২ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর মতো তিনিও সোজাসাপ্টা মানুষ। ১৯৭৫ সালের মর্মন্তুদ কাহিনী তিনি বর্ণনা করেছেন। তার একটি মন্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। বঙ্গবন্ধু হত্যা বিষয়ে সেনাবাহিনী থেকে একটি মন্তব্য করা হয়, যা এখন আমাদের টেক্সটে ঢুকে গেছে। সেটি হলোÑ সেনাবাহিনীর বিপথগামী অংশ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। আমি সব সময় লিখেছি, সেনাবাহিনী হত্যা করে। কারণ বিপথগামী কয়েকজন হত্যা করলেও পুরো সেনাবাহিনী সেই বিপথগামীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি। বরং তা মেনে নিয়েছে সামগ্রিকভাবে। ব্যক্তিগতভাবে কে মেনেছেন না মেনেছেন তা বড় কথা নয়। জেনারেল মনজুর প্রায় সে রকম মন্তব্যই করেছেন- ‘আরও অবাক হলাম এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অন্য কোন অংশ এবং দলের কেউ প্রতিবাদ করল না বলে।’ [পৃ. ১০৭] সে সময় তিনি ঢাকার বাইরে ছিলেন। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। রাইফেলসে থাকা সত্ত্বেও তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীতে আবার ফিরে এলেন। তিনি যখন ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন তখন চট্টগ্রামে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয়। তিনি এয়ার ডিফেন্স আর্টিলারি ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন। তখন সেনাপ্রধান লে. জে. এরশাদের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। চট্টগ্রাম থেকে লে. কর্নেল মুনীরুজ্জামান এসেছিলেন ঢাকায় প্রমোশন সংক্রান্তপরীক্ষা দিতে। মনজুর ছিলেন বোর্ডের প্রধান। মুনীর তাকে জানান চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে এক অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে। মুনীরকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন তিনি। এ ঘটনা ২৯ মের। ৩১ মে সকালে মুনীর তাকে ফোন করে জানান, জিওসি জেনারেল মনজুর সকাল আটটায় মিটিং ডেকে তাকে থাকতে বলেছেন এবং তাকে আরও নির্দেশ দেন- ‘রেজিমেন্টের একটি ব্যাটারি বিমানবন্দরে এবং আরেকটি ব্যাটারি পতেঙ্গায় নদীর মুখে তখনই যেন মোতায়েন করেন, পাশাপাশি বিমানবন্দরে সব ধরনের বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেন।’ [পৃ. ১৩৭] এতে অনুমান করা যায় মনজুর জিয়ার হত্যার সঙ্গে থাকুক না থাকুক, পরে বিদ্রোহীদের সঙ্গেই ছিলেন। মনজুর রশীদ খানও তাই মনে করেন। এরশাদ যে তখনই ক্ষমতা দখলের কথা ভাবছিলেন এবং কোন্ কোন্ জেনারেল তার পক্ষে ছিলেন সেটি একটি ঘটনায় বোঝা যায়। এরশাদ অবশ্য বাইরে ভাব দেখাচ্ছিলেন সাংবিধানিকভাবেই তিনি এগোতে চান। চট্টগ্রামে যখন এই ঘটনা ঘটছে তখন সেনা সদরে বৈঠক বসেছে। এরশাদ এসে জানালেন, তিনি সিএমএইচে বিচারপতি সাত্তারের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। সেনাবাহিনী তাকে সমর্থন করবে। ‘এ-ও বললেন, বিচারপতি সাত্তার খুবই ঘাবড়ে গেছেন। দায়িত্ব নেয়ার মতো অবস্থায় নেই।... এবার প্রশ্ন করলেন, ‘আমাদের এখন কী করা উচিত?’ এবারও সবাই চুপ। লক্ষ্য করলাম, একজন পিএসও যিনি সেনাপ্রধানের ঠিক সামনের টেবিলের বাঁ পাশে বসা, খুব উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন, কী কী করা উচিত, তার একটা চেক লিস্ট এখনই করে ফেলি।’ শুরু থেকেই তাকে যথেষ্ট উৎফুল্ল ও তৎপর মনে হলো। আর কেউ কিছু বলছেন না। এবারও জেনারেল এরশাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মনজুর তুমি কী বলো?’ আমি চট করে বলে ফেললাম, সংবিধানে যে ব্যবস্থা আছে, তাই আমাদের মেনে চলা উচিত। বলার সঙ্গে সঙ্গে যেন সবাই আরও চুপ হয়ে গেলেন। মনে হলো আমি যেন একটা ভুল করে ফেলেছি। একটু পর মেজর জেনারেল মান্নান সিদ্দিকী বলে উঠলেন, ‘আমি মনজুরের সঙ্গে একমত। আমাদের সংবিধান মতোই কাজ করা উচিত।’ [পৃ. ১৩৯-১৪০] এরশাদ ক্ষমতা দখলের আগে রাঙ্গামাটি এলাকার ইনফেনট্রি ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে ব্রিগেডিয়ার মনজুরকে নিয়োগ দেয়া হয়। এক বছর ছিলেন সে পদে। এরশাদ ক্ষমতা দখলের আগে মাহবুবুর রহমান নামক ‘রাজনীতিবিদ’কে প্রায়ই দেখা যেত সেনাসদরে। বিভিন্ন জনের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। অবশ্যই এরশাদের উৎসাহে। এরশাদ এরপর সামরিক আইন জারি করেন। তাকে উপ-আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করা হলো। জেনারেল মান্নাফ ছিলেন জিওসি। তিনি মনজুরকে জানিয়েছিলেন- ‘তিনি সামরিক শাসন জারির পক্ষে ছিলেন না, তবে দেশ শাসন করার মতো যোগ্যতা আমাদের নেই। শুনেছি, তৎকালীন বিডিআরের প্রধান মেজর জেনারেল আতিকুর রহমানেরও এ রকমেরই অভিমত ছিল। যাই বলা হোক না কেন, বাস্তবে আমরা সবাই সামরিক শাসনের পক্ষে ছিলাম; এবং সে লক্ষ্যেই কাজ করেছি।’ [পৃ. ১৬৮] সাহস করে এই সত্যটি লিখেছেন মনজুর রশীদ খান। ॥ নয় ॥ মেজর জেনারেল মইনুলের বইয়ের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। জিয়া নিহত হওয়ার সময় তিনি ছিলেন সেনাসদরে। ১৯৭৫ সালের পর জিয়া তাকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। ১৯৭৭ সালে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭৭ সালে যখন তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন তখনও সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খল অবস্থা। অফিসারে অফিসারে দ্বন্দ্ব। লন্ডন থেকে ফিরে যখন তিনি জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন তখন এরশাদও ছিলেন। জিয়া তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, লন্ডনে তার জায়গায় কাকে দেয়া যায়? জিয়ার এ প্রশ্নের উত্তরে মইনুল কর্নেল সাবিউদ্দিনের নাম করেন। এরশাদ তখনই বলেন, ‘হি ইজ নট আওয়ার ম্যান।’ এটি শুনে মইনুল হতবাক হয়ে এর প্রতিবাদ করেন। জিয়া তারপর তাদের থামিয়ে দেন। মইনুল লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনীর অবস্থা তখনও ছিল বিশৃঙ্খল। নতুন এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল নুরুল ইসলাম জিয়ার রাজনৈতিক কাজ ও দল গঠন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনিই বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণে উদ্যোগ নেন। মইনুল জিয়াকে বলেছিলেন এ প্রস্তাব নাকচ করতে। তিনি করেননি। পরে এরশাদ আমলে ও বেগম জিয়ার আমলে তিনি যখন ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে রাষ্ট্রদূত তখন খুনীদের সে সব জায়গায় পাঠানোর চেষ্টা হলে তিনি তাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।’ মইনুল আরও উল্লেখ করেছেন জেনারেল শওকত ও মনজুরের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল। জিয়ার বিভিন্ন কার্যকলাপ দেখে এটি স্পষ্ট হয় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা তিনি জানতেন, এতে প্রশ্রয়ও দিয়েছিলেন। বিনিময়ে খুনীদের যত রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়া যায় দিয়েছিলেন। জিয়ার উচ্চাভিলাষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য তিনি সেনা আইন পর্যন্ত সংশোধন করেন। বিভিন্ন সামরিক আইন করা, সংশোধনী করা এসব ব্যাপারে জিয়াকে সাহায্য করেছিলেন আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী নামে আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্তকর্তা। যাকে পরে এরশাদ আমলে এসব নষ্টামির জন্য সচিব ও বিচারক করা হয়। মইনুল লিখেছেন, জিয়া যখন রাজনৈতিক দল তৈরির উদ্যোগ নিলেন তখন বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা সাহায্য করেন। এ সময় মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু ও জেনারেল এরশাদ জিয়াকে উৎসাহিত করতে থাকেন। শুধু তাই নয়, উপ-সেনাপ্রধান এরশাদ হওয়ার সুবাদে তিনি সেনাবাহিনীতে বিভেদের সৃষ্টি করেন। ‘মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের দাবিয়ে রেখে অমুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধার পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেন।’ [পৃ. ১১৪] রাজনীতিতে জিয়াকে উৎসাহিত করার জন্য এরশাদ কীভাবে তোষামোদ করতেন তার একটি উদাহরণ দিয়েছেন মইনুল। “এরশাদ জিয়াকে প্রায়ই বলতেন, ‘আপনি সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে খুব জনপ্রিয়।’ অথচ আমার মতে, তখন জিয়ার জনপ্রিয়তা ক্রমাবনতির দিকে।” [পৃ. ১১৪] সেনাবাহিনীতে নিজেকে জনপ্রিয় করার জন্য ২৮ জনকে কর্নেলের পদে পদোন্নতি দেয়া নিয়ে মইনুলের সঙ্গে জিয়ার মতানৈক্য হয়। জিয়া ‘সেনাবাহিনীর স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু রাজনৈতিক স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেন।’ [ওই] ওই সময় অন্যান্য অফিসারও তোষামোদে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যেমন বগুড়ায় ৩০ সেপ্টেম্বর বিদ্রোহের জন্য কর্নেল সাদেকুর রহমানকে দায়ী করেন। জিয়া তাকে পদোন্নতি দিতে চাইলে মইনুল যখন বাধা দেন তখন লতিফ যিনি ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত সাদেককে সমর্থন করেন। এই ঘটনা সুবিদ আলী ভূঁইয়া আবার সাদেককে বলে দেন। ‘যা গুরুতর বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য। সাদেক যেহেতু জিয়ার সামরিক সচিব তাই তাকে খুশি করার জন্য ভূঁইয়া তাকে মিটিংয়ের তথ্য দেন।’ সাদেক ছিলেন মইনুলের আত্মীয়। এ কথা জেনে তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং মইনুল তখন তথ্যের উৎস জানতে চাইলে সুবিদ আলীর কথা বলেন। মইনুল বিষয়টি জেনারেল জিয়াকে অবহিত করে তাকে বদলির সুপারিশ করেন। ‘জিয়া আমাকে জানান,’ লিখেছেন মইনুল, ‘তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান এরশাদের সুপারিশেই সুবিদ আলী ভূঁইয়াকে আর্মি হেডকোয়ার্টারের সামরিক সচিবের মতো স্পর্শকাতর পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’ [পৃ. ১১৫] পরে অবশ্য সুবিদ আলীকে বদলি করা হয়। (চলবে)
×