ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লিভার চিকিৎসায় ‘টেইস’ পদ্ধতি ব্যবহার করে সাফল্য এসেছে দেশেই

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৬ মে ২০১৬

লিভার চিকিৎসায় ‘টেইস’ পদ্ধতি ব্যবহার করে সাফল্য এসেছে দেশেই

নিখিল মানখিন ॥ লিভার চিকিৎসায় নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে সফলতা পাচ্ছেন বাংলাদেশের চিকিৎসকরা। পদ্ধতির নাম হলো ‘লিভার টিউমার ও ক্যান্সার নিরাময়ে ট্রান্স-আরটারিয়াল কেমো-এম্বোলাইজেশন (টেইস) পদ্ধতি।’ আকৃতি ও অবস্থানের কারণে যাদের যকৃতের টিউমার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সরানো সম্ভব নয়, তাদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিই বিশ্বে সবচেয়ে কার্যকর বলে বিবেচিত হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে রক্তনালীর মাধ্যমে সরাসরি টিউমারে কেমোথেরাপি দেয়া যাবে। ঢাকার একটি বেসরকারী হাসপাতালে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ‘সফল’ হয়েছেন একদল চিকিৎসক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মামুন-আল-মাহতাব স্বপ্নীল এ দলের নেতৃত্ব দেন। দেশে পূর্ণাঙ্গ লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার নেই। লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে রোগীকে বিদেশে যেতেই হয়। আবার বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও লিভার প্রতিস্থাপনের স্থায়ী সেন্টার নেই। তাই নতুন এ পদ্ধতি দেশের লিভার রোগীদের সুস্থ করে তুলতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন চিকিৎসকরা। মামুন-আল-মাহতাব স্বপ্নীল জনকণ্ঠকে জানান, নতুন এ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজির আঙিনায় প্রবেশ করল। আমাদের রোগীরা এখন থেকে দেশেই লিভার ক্যান্সারের এ চিকিৎসা পাবেন। তাদের খরচ পড়বে ভারতের অর্ধেক। দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে শীঘ্রই এ চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। এই দলে আরও আছেনÑ শেখ মোহাম্মদ নুর-ই-আলম, আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দ আবুল ফজল, জাহাঙ্গীর সরকার, আহমেদ লুৎফুল মোবেন, মোঃ আবদুর রহিম ও ফয়েজ আহমেদ খন্দকার। তাদের প্রায় সবাই নয়াদিল্লীর ইনস্টিটিউট অব লিভার এ্যান্ড বিলিয়ারি সায়েন্সেস এবং চেন্নাইয়ের গ্লোবাল হেলথ সিটিতে ‘টেইস’ পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে ডাঃ স্বপ্নীল জানান। বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর যত লোকের মৃত্যু হয়, তাদের মধ্যে যকৃতের ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের সংক্রমণকেই এ দেশে যকৃতের ক্যান্সারের মূল কারণ বলে মনে করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই রোগীরা আসেন একেবারে শেষ পর্যায়ে। তখন আর অস্ত্রোপচার করার উপায় থাকে না বলে জানান ডাঃ স্বপ্নীল। তিনি আরও জানান, লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের জন্য প্রধানত দায়ী হেপাটাইটিস। রোগটি বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার সামর্থ্য রাখে। পাঁচ ধরনের ভাইরাস হেপাটাইটিস রোগটির জন্য দায়ী। এগুলোকে ইংরেজী এ, বি, সি, ডি এবং ই দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো সাধারণত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের মাধ্যমে, যৌনবাহিত হয়ে বা আক্রান্তের শরীরের কোন তরলের সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচটি ভাইরাসের মধ্যে বি ভাইরাসটি সবচেয়ে সাধারণ। ভাইরাসটি আক্রান্ত মায়ের শরীর থেকে নবজাতক বা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মধ্যে বাহিত হতে পারে। এছাড়া দূষিত সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদকগ্রহণকারীদের মাঝে ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা আছে। দেশে পূর্ণাঙ্গ লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার নেই। লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে রোগীকে বিদেশে যেতেই হয়। আবার বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও লিভার প্রতিস্থাপনের স্থায়ী সেন্টার নেই। বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশ লিভার প্রতিস্থাপনে সফলতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশে একটি স্থায়ী সেন্টার গড়ে উঠলে প্রতিটি লিভার প্রতিস্থাপন ব্যয় ৩০ থেকে ৩৫ লাখে নেমে আসতে পারে, যা দেশের বাইরে লাগে ৯০ লাখ থেকে আড়াই কোটি টাকা। ব্যয়বহুল চিকিৎসা হওয়ায় লিভার নষ্ট হয়ে যাওয়া অনেক রোগীকে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়। তবে লিভার প্রতিস্থাপন প্রকল্পের প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা কমিশনে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। লিভার প্রতিস্থাপনে কয়েকবার সফলতার মুখ দেখেছে বাংলাদেশ। বারডেম ও ল্যাবএইডের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ও খুব শীঘ্রই লিভার সংযোজন শুরু করতে পারবে বলে আশা করছে। এভাবে দেশে একাধিক হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ লিভার সংযোজন কার্যক্রম শুরু হলে রোগীদের আর বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে না। এতে বিশাল অংকের টাকা ব্যয়ের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক হয়রানি থেকে রোগীরা রেহাই পাবেন বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে দ্বিতীয়বারের মতো সফল লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয় বারডেম হাসপাতালে। কিন্তু লিভার প্রতিস্থাপনে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত দেশে মাত্র তিনটি লিভার প্রতিস্থাপনের কাজ হয়েছে। দেশে এখন পর্যন্ত সরকারী ও বেসরকারীভাবে কোন স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার নেই। লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করতে বারডেম হাসপাতাল ও ল্যাবএইড হাসপাতালকে অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের উপকরণ ধার করে ব্যবহার করতে হয়েছে। লিভার প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা। নির্ভয়ে লিভার দান ও প্রতিস্থাপনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে লিভার বিশেষজ্ঞরা বলেন, পৃথিবীর খুব কম দেশে লিভার প্রতিস্থাপনের কাজ হয়। একদিকে রয়েছে ডোনারের অভাব, অন্যদিকে দরকার বিশাল অংকের টাকা। এমন অবস্থায় আমাদের মতো গরিব দেশে সফল লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করতে পেরে আমরা অত্যন্ত গর্বিত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, লিভার দান করার ক্ষেত্রে ভয়ের কিছুই নেই। কাউকে দান করলেও ৬ সপ্তাহের মধ্যে তার লিভার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। দেশে স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন করা হলে এ রোগের চিকিৎসা ব্যয় কয়েকগুণ কমে আসবে। এমন কথা জানিয়ে লিভার প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রায় ১৮শ’ থেকে ২২শ’ গ্রাম লিভার থাকে। এর দুই-তৃতীয়াংশ অন্যত্র ব্যবহৃত হতে পারে। স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার গড়ে উঠলে এ ব্যয় ৩০-৩৫ লাখে নেমে আসতে পারে। এ কাজ সম্পন্ন করতে সিঙ্গাপুরে আড়াই কোটি টাকা এবং ভারতে লাগে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। বারডেম হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞরা জানান, লিভার রোগের চিকিৎসা দেশে এখনও খুব সীমিত। সরকারীভাবে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে লিভার রোগীদের জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। বেসরকারীভাবে বারডেম হাসপাতালে লিভার সার্জারি বিভাগ চালু আছে। ১৯৯৯ সালে বারডেমে এ বিভাগ চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। এখানে লিভার সংশ্লিষ্ট পিত্তনালী সংযোজন, প্যানক্রিয়াস রিসেকশনসহ অন্যান্য অপারেশন করা হয়। বর্তমানে এখানে আটজনের শক্তিশালী একটি দল কাজ করছে। এছাড়া প্রাইভেটভাবে কিছু হাসপাতালে লিভারের চিকিৎসা হলেও তা রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও অভাব রয়েছে। অথচ প্রাথমিক অবস্থায় লিভারের কোন রোগ ধরা পড়লে তা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অনেকের জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে। কারও হেপাটাইসিস বি বা সি ভাইরাস থাকলে এবং সময়মতো তা প্রতিরোধ না করলে ধীরে ধীরে লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সারে রূপ নেয়। এ ধরনের রোগীদের শেষ চিকিৎসাই হচ্ছে লিভার প্রতিস্থাপন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয়Ñ এ্যান্ড স্টেজ লিভার ডিজিস। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে অনেক আগে থেকেই লিভার প্রতিস্থাপন হচ্ছে। আমাদের দেশেও লিভার প্রতিস্থাপন সম্ভব। তবে লিভার প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এখনও যে বাধাগুলো আমাদের রয়েছে তার মধ্যে প্রথমত হচ্ছে যন্ত্রপাতি। এজন্য যেসব যন্ত্রপাতি লাগে সেগুলোর দাম কোটি কোটি টাকা। বারডেমে যে দুটি লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তার জন্য সিএমএইচ, হার্ট ফাউন্ডেশন, গ্যাস্ট্রোলিভার, পপুলার হাসপাতাল থেকে যন্ত্রপাতি আনতে হয়েছে। এ ধরনের একটি জটিল অপারেশনের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনবলও প্রয়োজন। সেটারও অভাব রয়েছে। এ ধরনের জটিল অপারেশনের জন্য ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় লাগে। সার্জন, লিভার বিশেষজ্ঞ, হেপাটোলজিস্ট, এ্যানেসথেসিয়াসহ কমপক্ষে ১৬ জনের একটি টিমের প্রয়োজন হয়। এটি ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসাও বটে। এছাড়া আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, যাদের এ ধরনের চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য আছে তারা দেশের বিশেষজ্ঞদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। অথচ যন্ত্রপাতি পেলে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে দেশেই এ চিকিৎসা করা সম্ভব। সারাবিশ্বে লিভার গ্রহীতার মৃত্যুঝুঁকি ১০ শতাংশ হলেও লিভার দাতার কোন মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। সুস্থ লোকের দেহ থেকে লিভারের কিছু অংশ কেটে নিয়ে সংযোজন করা হয়। সাধারণত ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যেই দাতার লিভার আবার আগের মতো হয়ে যায়। এছাড়া লিভার রোগীদের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৯৯৯ সালে লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছে। লিভার রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণার উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। লিভার রোগ প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই।
×