ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছাত্রের পরীক্ষা

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৭ মে ২০১৬

ছাত্রের পরীক্ষা

ছাত্র শ্রীমধুসূদন। শ্রীযুক্ত কালাচাঁদ মাস্টার পড়াইতেছেন অভিভাবকের প্রবেশ অভিভাবক। মধুসূদন পড়াশোনা কেমন করছে কালাচাঁদ বাবু? কালাচাঁদ। আজ্ঞে, মধুসূদন অত্যন্ত দুষ্ট বটে, কিন্তু পড়াশোনায় খুব মজবুত। কখনও একবার বৈ দুবার বলে দিতে হয় না। যেটি আমি একবার পড়িয়েছে দিয়েছি সেটি কখনও ভোলে না। অভিভাবক। বটে! তা, আমি আজ একবার পরীক্ষা করে দেখব। কালাচাঁদ। তা, দেখুন-না। মধুসূদন। (স্বগত) কাল মাস্টারমশায় এমন মার মেরেছেন যে আজও পিঠ চচ্চড় করছে। আজ এর শোধ তুলব। ওকে আমি তাড়াব। অভিভাবক। কেমন রে মোধো, পুরোনো পড়া সব মনে আছে তো? মধুসূদন। মাস্টারমশায় যা বলে দিয়েছেন তা সব মনে আছে। অভিভাবক। আচ্ছা, উদ্ভিদ কাকে বলে বল্ দেখি। মধুসূদন। যা মাটি ফুঁড়ে ওঠে। অভিভাবক। একটা উদাহরণ দে। মধুসূদন। কেঁচো! কালাচাঁদ। (চোখ রাঙাইয়া) অ্যাঁ! কী বললি! অভিভাবক। রসুন মশায়, এখন কিছু বলবেন না। মধুসূদনের প্রতি তুমি তো পদ্যপাঠ পড়েছ; আচ্ছা, কাননে কী ফোটে বলো দেখি? মধুসূদন। কাঁটা। কালাচাঁদের বেত্র-আস্ফালন কী মশায়, মারেন কেন? আমি কি মিথ্যে কথা বলছি? অভিভাবক। আচ্ছা, সিরাজউদ্দৌলাকে কে কেটেছে? ইতিহাসে কী বলে? মধুসূদন। পোকায়। বেত্রাঘাত আজ্ঞে, মিছিমিছি মার খেয়ে মরছিÑ শুধু সিরাজউদ্দৌলা কেন, সমস্ত ইতিহাসখানাই পোকায় কেটেছে! এই দেখুন। প্রদর্শন। কালাচাঁদ মাস্টারের মাথা-চুলকায়ন অভিভাবক। ব্যাকরণ মনে আছে? মধুসূদন। আছে। অভিভাবক। ‘কর্তা’ কী, তার একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দাও দেখি। মধুসূদন। আজ্ঞে , কর্তা ও পাড়ার জয়মুন্শি। অভিভাবক। কেন বলো দেখি। মধুসূদন। তিনি ক্রিয়া-কর্ম নিয়ে থাকেন। কালাচাঁদ। (সরোষে) তোমার মাথা! পৃষ্ঠে বেত্র মধুসূদন। (চমকিয়া) আজ্ঞে, মাথা নয়, ওটা পিঠ। অভিভাবক। ষষ্ঠী-তৎপুরুষ কাকে বলে? মধুসূদন। জানি নে। কালাচাঁদবাবুর বেত্র-দর্শায়ন মধুসূদন। ওটা বিলক্ষণ জানিÑ ওটা যষ্টি-তৎপুরুষ। অভিভাবকের হাস্য এবং কালাচাঁদ বাবুর তদ্বিপরীত ভাব অভিভাবক। অঙ্কশিক্ষা হয়েছে? মধুসূদন। হয়েছে। অভিভাবক। আচ্ছা, তোমাকে সাড়ে ছ’টা সন্দেশ দিয়ে বলে দেয়া হয়েছে যে, পাঁচ মিনিট সন্দেশ খেয়ে যতটা সন্দেশ বাকি থাকবে তোমার ছোট ভাইকে দিতে হবে। একটা সন্দেশ খেতে তোমার দু-মিনিট লাগে, কটা সন্দেশ তুমি তোমার ভাইকে দেবে? মধুসূদন। একটাও নয়। কালাচাঁদ। কেমন করে! মধুসূদন। সবগুলো খেয়ে ফেলব। দিতে পারব না। অভিভাবক। আচ্ছা, একটা বটগাছ যদি প্রত্যহ সিকি ইঞ্চি করে উঁচু হয় তবে যে বট এ বৈশাখ মাসের পয়লা দশ ইঞ্চি ছিল ফিরে বৈশাখ মাসের পয়লা সে কতটা উঁচু হবে? মধুসূদন। যদি সে গাছ বেঁকে যায় তা হলে ঠিক বলতে পারি নে, যদি বরাবর সিধে ওঠে তা হলে মেপে দেখলেই ঠাহর হবে, আর যদি ইতোমধ্যে শুকিয়ে যায় তা হলে তো কথাই নেই। কালাচাঁদ। মার না খেলে তোমার বুদ্ধি খোলে না! লক্ষ্মীছাড়া, মেরে তোমার পিঠ লাল করব, তবে তুমি সিধে হবে। মধুসূদন। আজ্ঞে, মারের চোটে খুব সিধে জিনিসও বেঁকে যায়। অভিভাবক। কালাচাঁদ বাবু, ওটা আপনার ভ্রম। মারপিট করে খুব অল্প কাজই হয়। কথা আছে গাধাকে পিটোলে ঘোড়া হয় না, কিন্তু অনেক সময়ে ঘোড়াকে পিটোলে গাধা হয়ে যায়। অধিকাংশ ছেলে শিখতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ মাস্টার শেখাতে পারে না। কিন্তু মার খেয়ে মরে ছেলেটাই। আপনি আপনার বেত নিয়ে প্রস্থান করুন, দিনকতক মধুসূদনের পিঠ জুডোক, তার পরে আমিই ওকে পড়াব। মধুসূদন। (স্বগত) আঃ , বাঁচা গেল। কালাচাঁদ। বাঁচা গেল মশায়! এ ছেলেকে পড়ানো মজুরের কর্ম, কেবলমাত্র ম্যানুয়েল লেবার। ত্রিশ দিন একটা ছেলেকে কুপিয়ে আমি পাঁচটি মাত্র টাকা পাই, সেই মেহনতে মাটি কোপাতে পারলে দিনে দশটা টাকাও হয়। অলঙ্করণ : সোহেল আশরাফ
×