ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

তৌফিক অপু

আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের ‘কাদম্বরী’

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৫ মে ২০১৬

আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের  ‘কাদম্বরী’

চলচ্চিত্রের শুরুতে চমৎকার টাইটেল সিকোয়েন্স দৃষ্টি কাড়ে তার গ্রাফিক্স সেন্স ও অভিনব শব্দ চয়নের গুণে। রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় নিয়ে সত্যজিতের চারুলতা দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে যেখানে ত্রিকোণিক সম্পর্কের বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এপিকধর্মী একটি প্রায় পিরিয়ড ফিল্ম আমরা পেয়েছিলাম। ফলে কাদম্বরী দেখার আগে চারুলতার কথা মনে পড়ছিল বার বার। কিন্তু ছবি দেখার পর বোঝা গেল কেবল সত্যজিৎ রায় নয় সৌমিত্র মাধবী শৈলেন- সকলের প্রভাব থেকে মুক্ত এ ছবি। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন স্মৃতি’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ এবং রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট’- মূলত এই তিনটি বইয়ের ওপর ভিত্তি করেই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন সুমন ঘোষ। জ্যোতিরিন্দ্র নাথের চরিত্রে কৌশিক সেন, রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথের চরিত্রে শ্রীকান্ত আচার্য (প্রতিভাবান এই কণ্ঠশিল্পীর প্রথম অভিনয়) প্রত্যেকে চরিত্রানুগ সাবলীল অভিনয় করেছেন। তবে পৃথকভাবে কাদম্বরী চরিত্রে কঙ্কনা সেনশর্মার কথা উল্লেখের দাবিদার। তাঁর অভিনয়ের জেশ্চার- পোশ্চার, সংলাপ উচ্চারণ, দৈহিক ভাষা মাধবীকে নয় অপর্ণা সেনকে মাঝে মধ্যে মনে করিয়ে দিলেও সবটুকু অভিনয় প্রতিভাময়ী কঙ্কনার একান্তই নিজের। ছবি শুরু হয়েছে কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা দিয়ে। তার পর টুকরো টুকরো ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে এগিয়েছে গল্প। ১২৭৫ বঙ্গাব্দের ২০ আষাঢ় ঠাকুরবাড়িতে বৌ হয়ে আসেন কাদম্বরী দেবী। পিতৃগৃহে তার নাম ছিল কাদম্বিনী। ঠাকুরবাড়িতে এসে নতুন নাম হলো তার। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বামী। রূপে গুণে অতুলনীয় যুবক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যস্ত ব্যবসা, সাহিত্যচর্চা, নাটক, গান আর বন্ধুদের নিয়ে। উপরন্তু আছেন মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী, ব্যক্তিত্বময়ী সুন্দরী জ্ঞানদানন্দিনী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পরিবারে ‘নতুন’ নামে পরিচিত। সেই সুত্রে কাদম্বরী নতুন বৌঠান। রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল ঠাকুরবাড়িতে বালিকা কাদম্বরীর একমাত্র সঙ্গী সমবয়সী বালক দেবর রবি। গরিব পরিবারের মেয়ে বলে কাদম্বরীকে নিয়ে আড়ালে আবডালে মেয়ে মহলে বিদ্রƒপ চলে। তিনিও মিশতে পারেন না কারও সঙ্গে তেমনভাবে। এদিকে মুখচোরা কিশোর মাতৃহীন রবির একমাত্র আশ্রয় নতুন বৌঠানের কাছে। ক্রমে বড় হয়ে ওঠে দু’জনেই। ঠাকুরবাড়ির তিন তলার মহলে কাদম্বরী সাজিয়ে তোলেন তার ঘর। প্রশস্ত বারান্দায় চিনে মাটির টবে ফুলের বাগান। গান, গল্প, কবিতায় মোহময় হয়ে ওঠে জীবন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শৌখিন মানুষ। তিনি স্ত্রী ও ছোট ভাইকে নিয়ে মাঝে মাঝেই জোড়াসাঁকোর প্রাসাদ থেকে দূরে অন্য কোথাও বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। কখনও চন্দন নগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে। কখনও সদর স্ট্রিটের বাড়িতে। ক্রমশ বন্ধুত্ব থেকে গভীরতর দিকে মোড় নেয় তাদের সম্পর্ক। তবে এ ভালবাসা ঠিক শরীরে নয়, এ ভালোবাসা যেন আত্মার গভীরে। নিঃসন্তান কাদম্বরীর জীবনে এই সঙ্কট যেমন আছে, তেমনি রয়েছে অন্য রকম সঙ্কটও। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পেশাদারী মঞ্চের জন্য নাটক লেখেন। সেখানে তার প্রিয় অভিনেত্রী বিখ্যাত নটি বিনোদিনী। ঈর্ষার কাঁটা কাদম্বরীর বুকে বেঁধে। যদিও তার বিখ্যাত ও প্রতিভাবান স্বামীর কাছে এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েও কোন লাভ হয় না। গোপনে থিয়টারে গিয়ে কাদম্বরী দেখেন বিনোদিনীর অভিনয় দেখে কতটা আবেগে আপ্লুত হন তার স্বামী। ননদ স্বর্ণকুমারীর ছোটমেয়েটিকে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন কাদম্বরী। মেতে থাকতেন শিশুটিকে নিয়ে, ভুলতেন নিঃসঙ্গতার দুঃখ। কিন্তু শিশুটির অকাল মৃত্যুর পর নিজেকে অপয়া বলে মনে হয় তার। বাড়ির অন্য মেয়েরা তাকে দোষারোপ করে। এতে আরও ভেঙ্গে পড়েন তিনি। জ্ঞানদানন্দিনীকেও ঈর্ষা করেন কাদম্বরী। কিন্তু সেটাও প্রকাশের কোন পথ নেই। জ্ঞানদানন্দিনী তাকে পছন্দ করেন না। কারণ তিনি গরিব পরিবার থেকে এসেছেন। দেবর জ্যোতির সঙ্গে তার মাত্রাতিরিক্ত সখ্য। কাদম্বরীকে হেয় করেই যেন জ্ঞানদানন্দিনীর জয়। তার স্বামীকে ক্রমশ সরিয়ে নিয়ে তাকে একা করে দেয়ার মধ্যে যেন জ্ঞানদানন্দিনীর সব আনন্দ। রবির খ্যাতি হচ্ছে। এখন সে আর লাজুক কিশোর নয়। এখন ঘরে বাইরে তার আদর। তরুণ এই লেখককে ব্যস্ত থাকতে হয় অনেক কাজে। আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন নতুন বৌঠান। বিশেষ করে রবির বিয়ের পর। রবির বিয়ের মাত্র চার মাস পর নতুন বৌঠানের আত্মহত্যা। সেদিন জলে ভাসছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নতুন জাহাজ সরোজিনী। প্রথম রাতে সেখানে বসবে গানের আসর। সে আসরে রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, জ্ঞানদানন্দিনী তো থাকবেনই। কিন্তু কাদম্বরীও কি থাকবেন না? অবশ্যই থাকবেন তিনি। নীলাম্বরী বালুচরী শাড়ি পরে সগর্বে তিনি বসবেন স্বামীর পাশে, দেখিয়ে দেবেন জ্ঞানদানন্দিনীকে তার আসল মর্যাদা কোথায়। শ্রীরামপুরে জাহাজটি রয়েছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো এসে স্ত্রীকে নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে। কিন্তু ভাটায় জাহাজ আটকে পড়ায় আসা হয় না তার। নপ্রহরের পর প্রহর চলে যায়, জ্যোতিরিন্দ্র আর আসেন না। অপেক্ষার পর অপেক্ষা করেন কাদম্বরী। তার কথা সবাই ভুলে গেছে। রবির খাতাতেও তিনি লেখা দেখেছিলেন ‘হেথা হতে যাও পুরাতন’। তিনি আর নতুন বৌঠান নন। সবার কাছে পুরাতন হয়ে গেছেন, বাতিল হয়ে গেছেন। স্বামীর জামার পকেটে তিনি আবিষ্কার করেন একটি প্রেমপত্র। যেটি কোন এক নারী লিখেছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে। তবে আর বেঁচে থেকে কি হবে, আসুক ঘুম, আসুক চির শান্তি। অভিমানী কাদম্বরী দেবীর এই ট্র্যাজেডির সার্থক রূপকার হয়েছেন সুমন ঘোষ। কঙ্কনা সেন শর্মা তার অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে কাদম্বরী দেবীকে জীবন্ত করে তুলেছেন সার্থকভাবে। কাদম্বরী, ২০১৬, বাংলা, ৮৭ মিনিট। কাহিনী বিন্যাস, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা- সুমন ঘোষ। অভিনয় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, কঙ্কনা সেনশর্মা, কৌশিক সেন, তিতাস ভৌমিক, শ্রীকান্ত আচার্য, সঞ্জয় নাগ। চিত্রগ্রহণ- বরুণ মুখোপাধ্যায়। সম্পাদনা- সুজয় দত্ত রায়। সঙ্গীত- বিক্রম ঘোষ।
×