ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী

এ দেশের মানুষকে নিয়ে কেউ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলে সহ্য করব না

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২০ এপ্রিল ২০১৬

এ দেশের মানুষকে নিয়ে কেউ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলে সহ্য করব না

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, বাঙালী জাতি বীরের জাতি। বাংলাদেশের মানুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে এ দেশকে স্বাধীন করেছে। তাই এদেশের মানুষকে নিয়ে কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে অন্য কেউ সহ্য করলেও আমি করব না। আমরা ভিক্ষা নিয়ে কিংবা হাত পেতে, মাথানত করে চলব না। নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল হয়েই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলবÑ এটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। আওয়ামী লীগ দেশের উন্নয়ন চায়, দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাই আওয়ামী লীগের কাছে দেশপ্রেম। বাংলাদেশ সবক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। কেউ-ই এই অগ্রযাত্রাকে রুখতে পারবে না। মঙ্গলবার রাজধানীর ফার্মগেটস্থ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ কৃষক লীগের ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দিচ্ছেন আমাদের কৃষকরা। তারা মানুষের ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করছেন। তাই দেশের কৃষকদের আমাদের মাথায় তুলে রাখা উচিত। এদের সবচেয়ে সম্মান দেয়া উচিত। তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তিই হচ্ছে কৃষি। আমাদের দেশের অর্থনীতিও কৃষিনির্ভর। তাই কৃষককে বাঁচাতে এবং কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকার থেকে যা যা করার তার সবই করছে সরকার, আগামীতেও করবে। কৃষক লীগ সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাংগঠনিক সম্পাদক কৃষিবিদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, ছবি বিশ্বাস এমপি, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট খন্দকার শামসুল হক রেজা, কৃষক নেতা আলতাব হোসেন ভুলু, শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, উম্মে কুলসুম স্মৃতি, কৃষিবিদ সাখাওয়াত হোসেন সুইট, ওমর ফারুক, বিশ্বনাথ সরকার বিটু প্রমুখ। অনুষ্ঠানের শুরুতে বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে গানের আয়োজন করা হলেও সাউন্ড সিস্টেমের কারণে গান বাজানো সম্ভব হয়নি। মঞ্চে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীসহ অতিথিদের বিব্রতবোধ করতে দেখা গেছে। প্রধান অতিথি শেখ হাসিনাকে কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শামসুল হক রেজা ক্রেস্ট ও সমীর কুমার চন্দ্র চন্দ ও সাখাওয়াত হোসেন সুইট কৃষক লীগের নিয়মিত প্রকাশনা ‘কৃষকের কণ্ঠ’ প্রদান করেন। পুরো অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কৃষক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ সমীর চন্দ্র চন্দ। দেশী শাক সবজি, ফুল ও ফল দিয়ে মূলমঞ্চ সাজানো হয়েছিল। হলরুমের বাইরেও ছিল দেশীয় বিভিন্ন ফলমূলের গাছ। প্রধানমন্ত্রী গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী এবং মাঠপর্যায় থেকে কৃষকদের সুযোগ-সুবিধার তথ্য সংগ্রহের জন্য কৃষক লীগের নেতৃবৃন্দকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১টি বছর এদেশের কৃষকরা ছিলেন শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত। বিএনপির আমলে শুধু সার চাওয়ার অপরাধে ১৮ কৃষককে গুলিতে জীবন দিতে হয়েছে, ন্যায্যমূল্য চাইতে গিয়ে পবিত্র রমজান মাসে ১৭ শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে। কৃষকদের প্রতিটি উপকরণই ছিল তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ তারা ক্ষমতায় এসেছিল নিজেদের ভাগ্যে গড়তে, নিজেরা ব্যবসা করতে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং বর্তমান সরকারের আমলে কৃষি খাতের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপির আমলে কৃষকদের খাদ্য উৎপাদনে কোনই সাহায্য করা হয়নি। কারণ খাদ্য উৎপাদন বেশি হলে তারা কামাই করবে কিভাবে? তিনি বলেন, বিএনপির নীতিই ছিল দেশের মানুষকে ক্ষুধার্ত, বুভুক্ষু রেখে দরিদ্রতা ও ভিক্ষুকের জাতি হিসেবে দেখিয়ে বিদেশ থেকে ভিক্ষা নিয়ে তা লুটপাট করে খাওয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগের নীতি হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। আওয়ামী লীগের নীতিই হচ্ছে আমরা কারোর কাছে হাত পেতে চলব না, আমরা করুণা নিয়ে চলতে চাই না। নিজেরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলব। সেভাবেই আমরা দেশকে গড়ে তুলছি। আর এটা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এটিই আমাদের শিখিয়ে গেছেন। কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর বিরোধিতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, ক্ষমতায় গেলে আমরা কৃষকদের ভর্তুকি দেব। তখন বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো হুমকি দিয়েছিল ভর্তুকি দিলে তারা সাহায্য দেবে না। আমি তখন সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম, সাহায্য না দিলেও আমরা নিজেদের অর্থে কৃষকদের ভর্তুকি দেব। ক্ষমতায় এসে আমরা তাই দিয়েছি। কৃষকদের ১০ টাকায় ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলা, প্রায় দুই কোটি কৃষককে কৃষি কার্ডের বিনিময়ে সব ধরনের কৃষি উপকরণ ও ভর্তুকি প্রদান করে যাচ্ছি। এসব কারণেই দেশ আজ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, আমরা দেশে খাদ্য নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। বর্গাচাষীদের বিনা জামানতে ঋণ প্রদানের বিষয় তুলতে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক্ষেত্রেও অনেকে বিরোধিতা করে বলেছিল, বিনা জামানতে ঋণ দিলে তা ফেরত পাওয়া যাবে না। তখন আমি বলেছিলাম অনেক বড় বড় লোক ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না, কিন্তু আমাদের কৃষক সমাজ কখনও বেইমানি করবে না। আমাদের সময় কৃষককে ঋণ পেতে ব্যাংকে যেতে হয় না, কৃষকদের কাছেই ঋণ দিতে ব্যাংক যায়। সেই ব্যবস্থাই আমরা করে দিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা শুধু কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, উৎপন্ন কৃষিজাতপণ্য বিদেশে রফতানি করব। এখন কৃষকদের কেউ দাম নিয়ে ঠকাতে পারে না। মোবাইল ফোনেই কোথায়, কী দাম এবং কৃষি ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান নিজেরাই জানতে পারছেন। সেই ব্যবস্থাও আমরা করে দিয়েছি। বাংলাদেশের সফলতা ও অগ্রগতির বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে, বিশ্ব মন্দার মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপর রাখতে সক্ষম হয়েছে। এখন প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগ অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের এমন উন্নতি দেখে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে। কিন্তু আমি বলি বিস্ময় নয়, মানুষের প্রতি কর্তব্যবোধ-দায়িত্ব, দেশপ্রেম ও আদর্শ নিয়ে আমরা কাজ করছি বলেই দেশের এমন অগ্রগতি হয়েছে। সারাদেশে এক শ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার হবে জানিয়ে তিনি বলেন, যথেচ্ছ কৃষি জমির অপব্যবহার রোধে আমরা সারাদেশে এসব বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। সেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। ফলে কেউকে আর যত্রতত্র শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার সুযোগ আমরা দেব না। আর এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণকে বেশি উৎসাহিত করা হবে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং প্রতিটি ঘরে ঘরে আলো জ্বালানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের ১৬ কোটি জনগণের মধ্যে একজনও আর গৃহহারা থাকবে না, একটি মানুষও ক্ষুধার্ত, শিক্ষা ও চিকিৎসাবঞ্চিত থাকবে না। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। আমরা তাঁর স্বপ্ন, দেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলবোই। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত অদম্য সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করেই তিনি দেশকে সবদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশের এই অগ্রযাত্রা কেউ ঠেকাতে পারবে না। অনেকই জরিপ হয়। বিশ্বের মধ্যে কৃষি খাতে উন্নয়নের রেটিং নিয়ে যদি জরিপ হতো, সেই জরিপে শেখ হাসিনাই হতেন এক নম্বর। সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কিংবদন্তি হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কারণ তাঁর হাতের ছোঁয়ায় ও পরশে বাংলাদেশের চেহারাই আজ বদলে গেছে। তাঁর ছোঁয়ায় ১৬ কোটির বাংলাদেশ আজ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। শেখ হাসিনা না থাকলে কোনদিনই এই অর্জন সম্ভব হতো না।
×