ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবু সুফিয়ান কবির

বৈশাখী মেলা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১০ এপ্রিল ২০১৬

বৈশাখী মেলা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি

সম্রাট আকবরের আমলে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে যে ই-লাহী সন চালু হয়েছিল, তা-ই বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত লাভ করে। কৃষকশ্রেণীর সেই ফসলি সন আস্তে আস্তে বাঙালী সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে ওঠে। খ্রিস্টাব্দের আগমনে বাঙালী উৎফুল্ল হয়, কিন্তু বঙ্গাব্দের আগমনে বাঙালী ভাসে আনন্দের জোয়ারে । ঢাকানগরীর রমনার বটমূল বৈশাখী আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এই বৈশাখী রং লাগে গোটা দেশে। গ্রামীণ মেলায় প্রধানত বিভিন্ন ধরনের মাটির ও কাঠের পুতুল, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী, কাঠের পণ্য, বিভিন্ন মাধ্যমে তৈরি খেলনা, কুলা, পাখা আর বিক্রি হতো নানা ধরনের নাড়ু, মিঠাই আর মিষ্টান্ন। আরও থাকত চুড়ি, ফিতা আলতা, নকশী রুমালসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক। বিনোদন হিসেবে থাকত পুতুলনাচ, যাত্রা, নাগরদোলা ও বায়োস্কোপ। কোথাও কোথাও দেখা যেত নৌকাবাইচ, ষাঁড়ের লড়াই ও কুস্তি প্রতিযোগিতা। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও অবদান সর্বজনস্বীকৃত, যদিও এর সুফল পায় না নারী। নগর সংস্কৃতি ও অর্থীতিতেও যে নারী অবদান রাখছেন না, তা নয়। এরই প্রতিফলন পড়ে বৈশাখী মেলায় ও অন্যত্র। গ্রামীণ মেলার এই উৎসবের ধারা শহরে এসে বিবর্তন লাভ করে। শহরের মেলাগুলোতে বায়স্কোপের জায়গায় দেখা যায় মুখোশ, আর মিঠাইর স্থান দখল করেছে ফুচকা আর চটপটি। আরও থাকে পান্তা- ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ। কোথাও কোথাও হয় পুতুলনাচ, আবার কোথাও বা নাগরদোলার উপস্থিতি চোখে পড়ে। তবে মেলা শহরের প্রায় প্রতিটি এলাকায় হয়ে থাকে। যে মেলাগুলোর প্রধান আকর্ষণ হরেক রকমের কুটিরশিল্প ও হস্তশিল্পের উপস্থিতি। এই শিল্পপণ্যগুলোর প্রায় ৯০ ভাগই তৈরি করেন নারীরা। বৈশাখী মেলা ও নানা আয়োজনের সঙ্গে নারীদের মেধা ও শ্রম যুক্ত হওয়ার কারণে দেশের অর্থনৈতিক চিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আর পোশাকের বিষয়টিতে যুক্ত হয়েছে এমন এক বৈচিত্র্য যা গ্রামের চেয়ে শহরের আনুষ্ঠানিকতাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। আর এই পোশাকের কথা এলেই প্রথমে চলে আসে নারীদের পোশাকের বিষয়টি। বিশেষভাবে বৈশাখী পোশাকের কথা এলেই প্রথমে আসে নারীর সেই চিরন্তনি পোশাক শাড়ির কথা। এমনটি ভাবা হচ্ছিল আজ থেকে দুই বা তিন দশক আগে। বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন বৈশাখী পোশাক মানেই হচ্ছেÑ শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতার পোশাকের কথা। অবশ্য পোশাকের একপেষে ধারাটিকে সর্বজনীন রূপ দিতে কিছু ফ্যাশন হাউস বেশ ভূমিকা রেখেছে। বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেইÑ এই পোশাকগুলোর প্রতিটি স্তরে থাকে নারীদের হাতের ছোঁয়া। দেশের বিভিন্ন এলাকার তাঁতপল্লীর নারীরা ঘরকন্যার কাজের পাশাপাশি চরকায় সুতা কাটা, মাকুতে সুতা বুননের কাজসহ সুতা রং করার কাজটি করে থাকেন। তাছাড়া শহরের আধুনিক ফ্যাশন হাউসগুলোর ব্লক, বাটিক, হাতের কাজগুলো সঙ্গেও জড়িত আছে নারীরা কর্মীরা। অনেক ফ্যাশন হাউসের মালিক নারী, আবার অনেক ফ্যাশন হাউসের প্রধান ডিজাইনার নারী। তারা নিয়মিত বৈশাখী পোশাক তৈরি ও বিপণন করে নিজেরা যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছে, তেমনি কারুশিল্প ও ফ্যাশন হাউসগুলোকে সমৃদ্ধ করছে। বৈশাখে পাওয়া যায় চট্টগ্রামের নকশী পাখা, রংপুরের শতরঞ্জি, সোনারগাঁওয়ের হাতি, ঘোড়া, পুতুল ও কাঠের কারুপণ্য ও নকশী হাতপাখা, সিলেটের শীতলপাটি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কারুপণ্য এবং টাঙ্গাইলের বাঁশ ও বেতের সামগ্রী। মেলায় সাধারণত স্থান পায় পোশাক, নকশীকাঁথা, শাড়ি, বিছানার চাদর, কুশনকভার, থ্রি-পিস, গৃহসজ্জা, মাটির তৈরি পণ্য ও হস্তশিল্পর বিভিন্ন সামগ্রী। ঢাকার বা অন্যান্য শহরের ফ্যাশন হাউসগুলোয় পেশাদারি ডিজাইনরা পোশাক তৈরিতে ভূমিকা রাখলেও দেশের আনাচে-কানাচে যে লাখ লাখ হস্ত ও কারুশিল্পী রয়েছে, তাদের অধিকাংশই অপেশাদার নারীকর্মী। তৃণমূল পর্যায়ের এসব কারুশিল্পী কোন ধরনের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই উত্তরাধিকার সূত্রে এসব পেশার সঙ্গে জড়িত। বৈশাখী মেলা তাদের এক অমিত সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী হস্ত ও কুটিরশিল্পকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে বৈশাখী মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। বলা যায় বৈশাখী মেলার আয়োজনের মাধ্যমে এই কারুশিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করছে এবং তাদের অর্থনীতিক উন্নয়নের মাধ্যমে এসব নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। তবে এই নারী কারুশিল্পের বিষয়টিকে আরও ব্যাপকতা দেয়া প্রয়োজন। অবশ্য বিসিক ঢাকায় বৈশাখী মেলার আয়োজনের মধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কারুশিল্পীদের আমন্ত্রণ জানায়। তবে বিসিক কর্তৃক কারুশিল্পীদের প্রতিটি জেলায় মেলার আয়োজন করতে পারলে কারুশিল্পীরা আরও ব্যাপক হারে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হতে পারে। একই সঙ্গে প্রতিটি জেলার গ্রামীণ উদ্যোগী ও প্রতিভাবান নারী কারুশিল্পীরা বিপুল উৎসাহ লাভ করবে এবং বৈশাখী আয়োজনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রেখে আসছে। এতে ঐতিহ্য রক্ষার মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিও লাভ করতে পারবে।
×