ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নববর্ষ ও আমাদের কুটির শিল্প

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১০ এপ্রিল ২০১৬

নববর্ষ ও আমাদের কুটির শিল্প

বাংলার অতি প্রাচীন শিল্পখাতের নাম কুটির শিল্প। গ্রামবাংলার স্বনির্ভর আন্দোলনের হাতিয়ার এই কুটির শিল্পের সঙ্গে মিশে আছে আবহমান বাংলার কৃষ্টি-সভ্যতা এবং ঐহিত্যের প্রবহমান ধারা। অপার সম্ভাবনার এই শিল্পখাত খেটে খাওয়া গ্রামীণ মানুষের অনবদ্য শৈল্পিক সৃষ্টি এবং জীবিকার অন্যতম মাধ্যম। ঐতিহাসিক সম্ভাবনা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতির বৈপ্লবিক মেলবন্ধন ঘটিয়েছে এই কুটির শিল্প। যা কালের বিবর্তনে রফতানি আয়ের অন্যতম শিল্পখাতে বিকশিত হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছাড়াও এই শিল্পখাতটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলোগুলো হলো- ১. গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র, ২. কম পুঁজিতে গ্রামভিত্তিক ছোট ছোট দেশীয় শিল্পের বিকাশ, ৩. বাংলার প্রাচীন পেশাভিত্তিক কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের লালন, ৪. বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক আয় আহরণ, ৫. দেশীয় পণ্য সম্ভারে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে ঐতিহ্য পরিচায়ক হিসেবে উপস্থাপন, ৬. গ্রামের সঙ্গে শহরের, শহরের সঙ্গে বিশ্বের অর্থনৈতিক মেলবন্ধন ঘটানো। গণমুখী, স্থানীয় কর্মসংস্থানভিত্তিক এই শিল্পখাতটির অমিত সম্ভাবনা সত্ত্বেও সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে কাক্সিক্ষত সফলতা পাচ্ছে না। তবে ভাবতেও অবাক হতে হয়Ñ চার দশকের অবহেলার শিকার এই শিল্পখাতের সঙ্গে জড়িত কিছু পেশাজীবী জনগোষ্ঠী বংশপরম্পরায় ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে এখনও সচল রেখেছেন কুটির শিল্পের চাকা। আমাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প, মসলিন, জামদানি, নকশিকাঁথা, তাঁতশিল্পের গৌরবময় ইতিহাসের চিরন্তন সাক্ষী এই কুটির শিল্প। এই ধারাবাহিকতা এখন অনেকদূর এগিয়ে গেছে মেধা এবং শৈল্পিকতায়। যেমন এই শিল্পে যোগ হয়েছে- শীতলপাটি, কলাগাছের ম- থেকে তৈরি কাগজ, কারুকার্যের টুপি, মাথার চুল, মাছের আছিল, কাঁটা থেকে গবাদিপশুর হাড়গোড় পর্যন্ত ব্যবহৃত হচ্ছে উৎপাদনের পণ্যসম্ভারের তালিকায়। রফতানি হচ্ছে সেসব পণ্য। নিয়ে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। খুলে দিচ্ছে শিল্পের সম্ভাবনার দ্বার। এ ক্ষেত্রে সরকারের সুদৃষ্টি না থাকলেও দেশের মানুষের একান্ত নিরলস চেষ্টায় দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে দেশের রফতানি বাজারের সম্ভাবনাকে। বহুকাল থেকে আমাদের কারুশিল্পীদের উৎপাদিত কুটির ও হস্তশিল্পজাত পণ্যসামগ্রী দেশীয় বাজারসহ পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত হয়ে আসছে। দেশব্যাপী কুটির ও হস্তশিল্প খাতের প্রসারের যে ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে এ খাতের শিল্প ইউনিট সংখ্যার ক্রমবৃদ্ধিই এর প্রমাণ বহন করে। তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৬১ সালে দেশে কুটির ও হস্তশিল্পের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার, ১৯৯১ সালে ৪ লাখ ৫ হাজার, ২০০৫-সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার। আর বর্তমানে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ৮ লাখ ৩০ হাজারের অধিক। এ শিল্পকে ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে ২৯ লাখেরও বেশি মানুষের। আবার দেশজ উৎপাদানে কুটির শিল্পের অবদান প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। দেশের শিল্পখাতে অগ্রগতির পথে কুটির শিল্পের এই অবস্থান নিঃসন্দেহে শুভ লক্ষণ। এবার কুটির শিল্পের বিপ্লব এবং সাফল্য-সম্ভাবনার গল্প বলছি শুনুন। কুষ্টিয়ার গড়াই নদীবর্তী কুমারখালীতে গড়ে উঠেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম তাঁতের বাজার ‘কাপুড়িয়া হাট’। হাট এবং তাঁত শিল্পকে ঘিরে এখানকার সবকিছু। এমনকি হাটের দিন রোববার বন্ধ থাকে এই এলাকার স্কুল-কলেজ। কুমারখালীতে হস্তচালিত ৪০ হাজার এবং বিদ্যুৎচালিত ৯ হাজার তাঁত রয়েছে। এ শিল্পের ওপর নির্ভর করে প্রায় দেড় লাখ তাঁতী, শ্রমিক-কর্মচারী জীবিকা নির্বাহ করে। টাঙ্গাইলের মধুপুরে কলাগাছের খোল আর আনারসের পাতা থেকে আঁশ ছাড়িয়ে তৈরি সুতায় কাপড় তৈরি হচ্ছে। একাজটি করছে মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (এমসিসি) নামক একটি বেসরকারী সংস্থা। জানা যায়, ফিলিপিন্সসহ আরও কয়েকটি দেশে আরও আগেই এ ধরনের উপাদান থেকে কাপড় তৈরি করলেও বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ এই প্রথম। এই কলার খোল আর আনারসের পাতার তৈরি কাপড় থেকে দেখা দিয়েছে রফতানি আয়ের সম্ভাবনা। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছে বাংলার কাদামাটির খাঁটি সোনা- বাংলার টাইলস। পোড়ামাটির সোনা’য় হতাশা কেটে গেছে মৃৎশিল্পীদের। আধুনিক শিল্পের একটি নতুন প্রয়াস। চোখে পড়ার মতো সাফল্য। আছে আমাদের শৈল্পিক ঐতিহ্য কুমিল্লার খাদি। এ শিল্পটাকে ঘিরে কুমিল্লায় গড়ে উঠেছে বিশাল বাজার। কুমিল্লা ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ বড় বড় শহরগুলোতেও বর্তমানে তৈরি কথিত এই খাদি বা খদ্দরের ব্যাপক প্রসার হচ্ছে। যমুনার চর এলাকায় সাধারণ তালপাতা ও ছনের তৈরি ডালা ও চালুন সামগ্রী অনেক পরিবারে এনেছে সচ্ছলতা, দেশের জন্য এনেছে বৈদেশিক মুদ্রা। ‘ডালাখ্যাত’ হাপুনিয়া গ্রামের নাম ক’জনে জানেন। কেবল গ্রামই নয়, উপজেলার প্রায় বিশ গ্রামের কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ডালা বা ঝুড়ি অথবা বাস্কেট তৈরির হন্তশিল্পের সঙ্গে নিজেদের ভাগ্য জড়িয়ে ফেলেছেন। আর নারী হাতের কারিগরি ছোঁয়ায় তালপাতা ও ছনের তৈরি ওই রকমারি পণ্য আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর ইউরোপের দেশগুলোতেও যাচ্ছে। হাপুনিয়া, মহিপুর, কামরিচা, গোসাইবাড়ি, বাগড়া, তাজপুর, পেঁচুল, টুনিপাড়া, ভাটগাড়ি গ্রামে প্রায় ৯শ’ নারী এ উপজেলার ভবানীপুর, আমিনপুর, ছোনকা, বেলগাড়সহ প্রায় ৩ হাজার নারী এ পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন পাশাপাশি কয়েকজন পুরুষও এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ঝালকাঠির শীতল পাটি দেশের অন্যতম একটি কুটিরশিল্পও গৌরবময় ঐতিহ্য। তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কুটির শিল্পগুলোর বুনিয়াদি অবস্থান গ্রামাঞ্চলকে কেন্দ্র করেই। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তরুণ-তরুণীদের মেধাশক্তি, সৃজনী ক্ষমতা আর প্রযুক্তির আলিঙ্গন পেয়ে কুটির শিল্পের সীমানা গ্রাম থেকে মফস্বল এমন প্রধান শহরগুলোতে ডালপালা মেলেছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় উৎপাদিত পণ্যের বাজারমূল্য ৩৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। আরেক তথ্যে জানা গেছে, মাত্র ৩৫ শতাংশ কুটির শিল্প বিসিকের তালিকাভুক্ত, বাকি ৬৫ শতাংশই তালিকার বাইরে। সবচেয়ে বেশি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রতিষ্ঠান রয়েছে ঢাকা বিভাগে- প্রায় আড়াই লাখ। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে- প্রায় ২৮ হাজার। তাছাড়া বরিশাল বিভাগে- প্রায় ৫২ হাজার, চট্টগ্রামে- ১ লাখ ১৬ হাজার, খুলনা-প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার, রাজশাহী-১ লাখ ৩০ হাজার, রংপুরে- প্রায় ৮৩ হাজার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ৯৬ শতাংশই একক মালিকানা এবং ৩ শতাংশ যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। শিল্প খাতে রফতানি বৃদ্ধির জন্যই দেশের কুটির ও হস্তশিল্পের প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। স্বল্পপুঁজিতে অধিক কর্মসংস্থান, আয় ও উৎপাদন বাণিজ্যে আরও অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে। এ জন্য উক্ত খাতে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তা সমাধানের লক্ষ্যে বাস্তব ও কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বিসিক ও ইপিবিসহ অন্যন্য সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, পুঁজি সহায়তা, দেশ-বিদেশে মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন, উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজার খুঁজে বের করা প্রভৃতি বহুমাত্রিক আয়োজনে কুটিরশিল্প বিকাশে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। ভাটি বাংলার হাওড় অঞ্চলকে ঘিরে সম্প্রসারিত হতে পারে এই কুটির শিল্প। সরকার যদি কুটির শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নীতি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয় তাহলে সার্বিকভাবে দেশের অনতিক্রম্য মাধ্যমিক স্তর এবং মাধ্যমিক পাসের শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তরুণ-তরুণীরাও যুক্ত হবে এই শিল্পখাতের সঙ্গে। একটি বৃহৎ পরিকল্পনায় অগ্রসর হলে এই কুটির শিল্প দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে রেনেসাঁ ঘটাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কলাম লেখক ও উন্নয়ন গবেষক
×