ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভ জালিয়াতির দুই মাসেও হোতা চিহ্নিত হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৮ এপ্রিল ২০১৬

রিজার্ভ জালিয়াতির দুই মাসেও হোতা চিহ্নিত হয়নি

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনায় ২ মাসেও মূল হোতা এখনও চিহ্নিত হয়নি। ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সের ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ দেশটির বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের দায় চিহ্নিত হলেও মূল আসামিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিনেট, বিচার বিভাগসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ঘটনা তদন্তে এখন পর্যন্ত কোন কূলকিনারাই করতে পারেনি। কেননা ফিলিপিন্সের সন্দেহভাজন ৭ ব্যক্তি টাকা লুটের ঘটনায় একে অপরকে দোষ দিচ্ছেন। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে রিজার্ভ চুরির টাকা ফেরত দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন চীনা বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী কিম অং। তার অভিযোগ, আমি নই, রিজার্ভের টাকা লুটে নিয়েছেন দুই চীনা নাগরিক শুহুয়া কাও ও দিং জিজ। অথচ অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে চীনা সরকার। ফিলিপিন্সের তদন্ত কমিটির মন্তব্যকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ বলেও আখ্যায়িত করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদিকে টাকা চুরির ঘটনায় শ্রীলঙ্কার শালিকা ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিওর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেও দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শনাক্ত করতে পারেনি রাঘববোয়ালদের। চুরির টাকা নয়, বন্ধুর দেয়া জাইকার অর্থায়ন বলে রীতিমতো বড় গল্প বানিয়ে প্রচার করেছেন ওই এনজিওর প্রধান নির্বাহী। অন্যদিকে রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধানে এ মুহূর্তে ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কায় অবস্থান করছেন বাংলাদেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার সিআইডি কর্মকর্তারা সেখানকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জানা গেছে, গত ৫ ফেব্রুয়ারি ‘সুইফট মেসেজ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০১ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮০০ কোটি টাকা অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ফিলিপিন্সে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং বাকি অর্থ শ্রীলঙ্কায় পাচার হয়। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছেÑ শ্রীলঙ্কায় পাচার করা অর্থ তারা ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছে। অর্থ লোপাটের ওই ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমদিকে গোপন রাখলেও পরে তা গণ্যমাধ্যমে প্রকাশ হয়। এ ঘটনায় শুধু বাংলাদেশ নয়, ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কা আলাদাভাবে তদন্ত করছে। ফিলিপিন্সে সর্বোচ্চ আইন প্রণয়ন সংস্থা সংসদের উচ্চকক্ষ সিনেট কমিটি, মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ কর্তৃপক্ষ, জাতীয় তদন্ত ব্যুরো ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব কর্তৃপক্ষকে ডেকে দফায় দফায় শুনানি করেছেন। সিনেট কমিটির সর্বশেষ শুনানিতেও জেরার মুখোমুখি করা হয় সন্দেহভাজন ৭ ব্যক্তিকে। মূল হোতার নাম তো দূরের কথা জবানবন্দীতে তারা একে অপরকে দোষারোপ করেছেন। একদিকে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন অন্যদিকে রিজার্ভ চুরির টাকা ফেরতও দিতে চেয়েছেন চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিনো ব্যবসায়ী কিম অং। সিনেট কমিটির তৃতীয় শুনানিতে রিজার্ভ চুরির অন্যতম সন্দেহভাজন ব্যবসায়ী কিম অং জানিয়েছিলেন, রিজার্ভ চুরির পেছনে দুই চীনা জাংকেট এজেন্ট রয়েছেন। বেজিংয়ের শুহুয়া গাও এবং ম্যাকাওয়ের ডিং জিজে নামে ওই দুই চীনা নাগরিক জালিয়াতির ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপিন্সে স্থানান্তর করেন। তবে বৃহস্পতিবার ফিলিপিন্সের এমন ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে চীনা সরকার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র ফিলিপাইন সিনেটর রালফ রেক্তোর এ বক্তব্যকে ‘একেবারে ফালতু’ বলে মন্তব্য করেছেন। ব্যাংকিং খাতের অন্যতম বড় এ চুরির ঘটনায় চীনা হ্যাকারদের ‘জড়িত থাকার সম্ভাবনা’র বিষয়ে রয়টার্সকে জানানো প্রতিক্রিয়ায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই মুখপাত্র লু কাংক বিষয়টিকে ফিলিপিন্সের তদন্ত কমিটির ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ বলেও আখ্যায়িত করেন। রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাতকারে এ নিয়ে সিনেটর রালফ রেক্তো বলেন, শুহুয়া গাও এবং ডিং জিজে নামের ওই দুই হ্যাকার যেখানেই থাকুক না কেন সিনেটের তদন্ত কমিটি তাদের খুঁজে বের করতে চীনা সরকারের কাছে সহায়তা চাইতে পারে। সন্দেহভাজন এই দুই এজেন্ট বর্তমানে ম্যাকাওয়ে রয়েছেন বলেও ধারণা করেন সিনেটর রেক্তো। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোঃ রাজি হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, রিজার্ভ জালিয়াতির সঙ্গে ইতোমধ্যে ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের শনাক্ত করা গেছে। খুব শীঘ্রই মূল হোতা বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মকর্তার। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, একে অপরকে দোষ দেয়ার মাধ্যমে মূল আসামিকে আড়াল করতে চাইছে ফিলিপিন্স। কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা। এদিকে রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের ঘটনা তদন্তে এখন ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কায় অবস্থান করছে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির দুটি দল। বৃহস্পতিবার ফিলিপিন্সে বাংলাদেশের তদন্ত প্রতিনিধিরা সেখানকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তারা সেখানে পুলিশ বিভাগ ছাড়াও সিনেট কমিটি, এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের (এএমএলসি) সঙ্গে কথা বলবেন। এ ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য নিয়েছেন বাংলাদেশের তদন্ত প্রতিনিধিরা। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছে তদন্ত দল দেশটির সিআইডির সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানেও তদন্তের বিষয়ে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তদন্ত দল দুই দেশেই এ ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশী কেউ যুক্ত আছে কি-না সেটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করতে তিন দেশের কর্মকর্তারা যাতে যৌথভাবে তদন্ত করতে পারেন এ বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা চেয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা।
×