ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাড়ে ৪ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির অভিযোগ অডিট রিপোর্টে

বরফ দিয়ে চিংড়ির ওজন বাড়ানোর জালিয়াতি

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৯ মার্চ ২০১৬

বরফ দিয়ে চিংড়ির ওজন বাড়ানোর জালিয়াতি

নাজনীন আখতার ॥ বিদেশে বরফ বেচেও নগদ অর্থ সহায়তা নিল চিংড়ি রফতানিকারকরা! নিয়মানুযায়ী শুধু চিংড়ির ওজনের ওপর সরকার থেকে নগদ অর্থ সহায়তা পাওয়ার কথা থাকলেও বেশি অর্থ লাভের আশায় বরফসহ চিংড়ির ওজন দেখিয়েছে তিন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। আর নিয়মের বাইরে এ সহায়তা দিয়ে সরকারকে তিন বছরে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি গুনতে হয়েছে। হিমায়িত চিংড়ি মাছ রফতানির সময় মাছের নিট ওজনের পরিবর্তে বরফাচ্ছাদিত ওজনের ওপর বিধিবহির্ভূতভাবে অর্থ সহায়তা দেয়ার এ জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ করা হয়েছে অডিট প্রতিবেদনে। সম্প্রতি সরকারী হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে অডিট আপত্তির তথ্য তুলে ধরা হয়। সংসদীয় কমিটিকে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুলনায় জনতা ব্যাংকের খান এ সবুর রোড ও কর্পোরেট শাখা থেকে এ নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয় চিংড়ি রফতানিকারকদের। প্রতিবেদনে চিংড়ি রফতানিকারকদের নাম উল্লেখ না করে বলা হয়েছে, জনতা ব্যাংক লিমিটেডের খুলনার দুটি শাখার ২০০৭ থেকে ২০১০ সালের রফতানি ভর্তুকি বা নগদ সহায়তা দেয়া সংক্রান্ত হিসাব অডিটকালে দেখা যায়, হিমায়িত চিংড়ি মাছ রফতানির বিপরীতে রফতানিকৃত মাছের নিট ওজনের পরিবর্তে বরফাচ্ছাদিত ওজনের ওপর বিধিবহির্ভূতভাবে নগদ সহায়তা দেয়ায় ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৬১ হাজার ৮৮৬ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পণ্য আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের আকৃতি ও গুণগতমান অক্ষুণœ রাখার জন্য পণ্যের ধরন অনুযায়ী মোড়ক সামগ্রী ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এখানে রফতানিকৃত হিমায়িত চিংড়ি মাছের গুণগতমান অক্ষুণœ রাখার জন্য বরফাচ্ছাদিত হয়Ñ যা মাছের মোড়ক হিসেবে গণ্য। ১৯৬৯ সালের শুল্ক আইনের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী আমদানি ও রফতানিকৃত পণ্যের নিট ওজনের ওপরই প্রযোজ্য হারে শুল্ক ও করাদি আদায় করা হয়ে থাকে। সেই হিসেবে রফতানিকৃত হিমায়িত চিংড়ি মাছের নিট ওজনের ওপরই নগদ সহায়তা প্রাপ্য হবে। এদিকে ব্যাংক নগদ সহায়তা দেয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে জানিয়েছে, চিংড়ি একটি পচনশীল পণ্য। এর গুণগতমান অক্ষুণœ রাখার জন্য গ্লেজিং (যাকে বরফাচ্ছাদিত বলা হয়েছে) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রয়োজনীয় বিকল্পহীন একটি টেকনোলজিক্যাল ব্যবস্থা। গ্লেজিং একটি পাতলা বরফের আস্তরণ যা সর্বদাই নিট ওজনের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষভাবে আইকিউএফ (ইনডিভিজুয়াল কুইক ফ্রিজেন) ৫ পাউন্ড ওজন পর্যন্ত চিংড়ির ক্ষেত্রে বিক্রয় চুক্তিতে ক্রেতার প্রয়োজন অনুসারে গ্লেজিংয়ের শতকরা হার উল্লেখ করা হয়ে থাকে এবং সে অনুপাতে মূল্য নির্ধারিত হয়। ক্রেতা পানি বা বরফের জন্য কোন ভাড়া দেন না। কেবলমাত্র প্রত্যাবাসিত রফতানি মূল্যের ওপর নগদ সহায়তা বা রফতানি ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ২০০৩ সালের ৩ জুন এর সার্কুলারে বরফ আচ্ছাদনের পদ্ধতি বিষয়ে বলা হলেও হিমায়িত পর্যায়ে বরফ আচ্ছাদনের পরিমান উল্লেখ ছিল না। চলতি ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে হিমায়িত মাছ রফতানির বিপরীতে বরফ আচ্ছাদনের হারের ভিত্তিতে নগদ সহায়তা প্রযোজ্য করা হয়েছে। এ খাতে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বরফ আচ্ছাদিত হলে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা প্রাপ্য হবে। হিমায়িত মাছের অংশ বিবেচনায় ২০ শতাংশ বরফ আচ্ছাদিত থাকলে আপত্তি নিষ্পত্তি যুক্তিযুক্ত হবে। তাছাড়া এ বিষয়ে সংক্ষুব্ধ তিনটি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান আদালতে মামলা দায়ের করেছে যা বিচারাধীন। ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ যুক্তি তুলে ধরে আপত্তি নিষ্পত্তির দাবি জানানো হলেও জবাব সন্তোষজনক নয় বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ওই সময়ের সার্কুলারে ৫ পাউন্ড পর্যন্ত প্যাকে হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ রফতানির বিপরীতে প্রতি (পাউন্ড) এফ ও বি মূল্যের সর্বোচ্চ সিলিং বা সীমা নির্ধারণ করায় ওজনের বিষয়টি মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ যে মূল্যেই রফতানি করা হোক না কেন সেক্ষেত্রে প্রতি পাউন্ড ওজনের ভিত্তিতে নির্ধারিত হারে নগদ সহায়তা প্রাপ্য হবে। তাই আপত্তিকৃত অর্থ আদায়ের ওপর জোর দিয়েছে নিরীক্ষা অধিদফতর। অর্থ মন্ত্রণালয়ও অর্থ আদায়ের ওপর জোর দিয়ে বলেছে, অডিট আপত্তির প্রেক্ষিতে হিমায়িত চিংড়ি বা মাছ রফতানির ক্ষেত্রে বরফ আচ্ছাদনের একটি সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করে অর্থ বিভাগ থেকে সার্কুলার জারি করা হয়েছে। যা ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর করা হয়েছে। তবে কোন ভূতাপেক্ষ অনুমোদন না থাকায় আপত্তিকৃত টাকা আদায়যোগ্য। তবে মামলা থাকায় আদালতের রায়ের ওপর ব্যবস্থা নিতে হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
×