ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

গুলির শব্দ আর বারুদের গন্ধের মধ্যে আমার বিয়ে

গেরিলা আলমতাজ ॥ নারী মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৯ মার্চ ২০১৬

গেরিলা আলমতাজ ॥ নারী মুক্তিযোদ্ধা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে দেশকে পাক হানাদার মুক্ত করতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছি। ব্যক্তি জীবনে কোন কিছু পাব, তা ভেবে সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিইনি। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রতিদান হিসেবে এ দেশটাকে যে স্বাধীন করতে পেরেছি এটাই আমার বড় পাওয়া। কথাগুলো বলছিলেন মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত বরিশালের নারী মুক্তিযোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি। ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর উপজেলার শ্যাকরাইল গ্রামের হাবিবুর রহমান ও বেগম জাহানারা বেগম দম্পতির পঞ্চম সন্তান আলমতাজ বেগম। বাবা ছিলেন বরিশাল আদালতের আইনজীবী সহকারী। সে সুবাদে বরিশাল শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। এ এলাকার একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি বলেন, আমি তখন বরিশাল শহরের জগদীশ সারস্বাত বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই আমার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়েছিল আর তা হয়েছিল আমার বড় ভাই কবি অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ও মেজো ভাই ফিরোজ কবিরের মাধ্যমে। তারা পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সিরাজ শিকদারের সঙ্গে বাম রাজনীতি করতেন। দু’ভাইয়ের বন্ধুরা বরিশাল শহরের বিএম কলেজ রোডের আমাদের বাসায় আসতেন, আলাপ-আলোচনা করতেন। আমি তাতে অনুপ্রাণিত হতাম। যদিও প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি, পরবর্তীতে আমার বড় ভাইয়ের সহপাঠী ও আমার স্বামী সেলিম শাহনেওয়াজের কাছ থেকে বুঝতে পেরেছি ওটা বাম রাজনীতি। তখন ছিল পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট (সর্বহারা) পার্টি। নিজেরা আলোচনার সময় বলতেন, পশ্চিমারা আমাদের দেশ শাসন-শোষণ করছে, এটা বন্ধ করা দরকার। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন তখন আর আমাদের ঘরে বসে থাকার সময় নেই। তাদের আলোচনার মূল বিষয় নিয়ে তারা আমাদের বাসায় বসেই পোস্টার লিখতেন। আমিও তাদের পোস্টার লেখায় সাহায্য করতাম। তারপর মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। মেজো ভাই ফিরোজ কবির চলে গেলেন যুদ্ধে। ভাই চলে যাওয়ার পর আমার মধ্যেও যুদ্ধে যাওয়ার অনুভূতি পেয়ে বসে। বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠী জেলার সীমান্তবর্তী আটঘর-কুড়িয়ানা পেয়ারাবাগানে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যুদ্ধ-ঘাঁটিতে মেজোভাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। একদিন তিনি ফিরে এসে আমাকে বললেন, আমি যুদ্ধে যেতে চাই কিনা? এ প্রশ্নে আমার মন নেচে উঠল। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমে আমার পরিবার রাজি ছিল না। কিন্তু ভাইয়ার সহযোগিতা আর আমার আগ্রহ কোন বাধাই মানল না। পেয়ারাবাগানে যাওয়ার পর সিরাজ শিকদারের সঙ্গে পরিচয় হলো। পরে আমাকে অস্ত্র চালানো ও গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওই ঘাঁটিতে আমিই ছিলাম একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধচলাকালীন সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে স্বরূপকাঠীর সন্ধ্যা নদীতে আমি সর্বপ্রথম পাকসেনাদের গানবোটে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছি। ওই হামলায় ১০ পাকি সেনা ও তাদের দোসর মারা যায়। দ্বিতীয়বার সিরাজ শিকদারের নির্দেশে ঝালকাঠীর গাবখান চ্যানেলে আমি একাই গেরিলা পদ্ধতিতে পাকি সৈন্যবাহী গানবোটে গ্রেনেড ও হাতবোমা হামলা চালিয়ে সব পাকি সেনাকে মেরে ফেলি। পরবর্তীতে একাধিকবার পাকিসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সবশেষ ঢাকায় বিএনআর (পাকিস্তান সরকারের ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকন্সট্রাকশন) অফিসে হামলার সময়ও আমি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। একাত্তরের ২৮ মে ক্যাম্পে গুলির শব্দ ও বারুদের গন্ধের মধ্যেই বিয়ে হলো আমার। বর সহযোদ্ধা বরগুনার পাথরঘাটার সেলিম শাহনেওয়াজ। সহযোদ্ধারা আনন্দ-ফুর্তি করে ফুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে, আমাদের বিয়ে হয়েছে। তখন বাসর ঘর হয়নি। কিন্তু বিয়ের পরই আসে শোকের পালা। পেয়ারাবাগান অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও সাংগঠনিক শক্তি বেড়ে যাওয়ায় হানাদাররা চতুর্মুখী অভিযান চালাতে শুরু করে। এ সময় হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে ধরা পড়েন মেজো ভাই কমান্ডার ফিরোজ কবির ওরফে মনুসহ কয়েক মুক্তিযোদ্ধা। শত্রু ক্যাম্পে নির্মম নির্যাতনে মনু ১৮ আগস্ট শহীদ হন বন্দী আরেক মুক্তিযোদ্ধা এমজি কবির ভুলুর চোখের সামনে। আমি তখন পেয়ারাবাগান ছেড়ে বরগুনার পাথরঘাটায় স্বামীর গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেই। আর আমার স্বামী চলে যান পাবনার নতুন ক্যাম্পে। কিন্তু পাথরঘাটার হানাদার বাহিনীর দোসররা আমার অবস্থান জেনে যায়। আমি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে পাবনার মুক্তাঞ্চলে চলে আসি। সেখান থেকে ঢাকার জিগাতলা হয়ে হাজারীবাগে এক ট্যানারির কাছে গোপন আস্তানায় বসবাস শুরু করি। ঢাকায় পার্টির মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও অভিযানে অংশ নিয়েছি। এভাবে কেটে গেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়টি মাস। দেশ স্বাধীনের পর আমি ছিলাম ঢাকার মীরেরটেকে দলীয় আস্তানায়। এর কয়েক মাস পরই আমি অন্তঃসত্ত্বা হই। কিছুদিন পর সর্বহারা পার্টিতে দলীয় কোন্দল দেখা দেয়। ১৯৭২ সালের ৬ জুন আমি খুলনায় সাংগঠনিক কাজে যাওয়ার পর জানতে পারি ঢাকার ইন্দিরা রোডে বড় ভাই অধ্যাপক হুমায়ুন কবির গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন। এ ঘটনার সপ্তাহখানেক পর দলীয় কর্মীরা আমাকে জানান, বড় ভাই নিহত হওয়ার আগেই ৩ জুন খুলনায় আমার কাছে আসার পথে ঝালকাঠী লঞ্চঘাটে গুপ্তঘাতকের হামলায় নিহত হয়েছেন আমার স্বামী সেলিম শাহনেওয়াজ। তার লাশ সুগন্ধা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আমি ঢাকায় ফিরে বড় বোনের বাসায় আশ্রয় নেই। সেখানেই ডিসেম্বর মাসে জন্ম নেয় আমার মেয়ে সেলিনা শাহনেয়াজ শিমু। তখন থেকেই আমার জীবনে শুরু হয় অভাব নামের আরেক যুদ্ধ। যা স্বাধীনতা যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। মেয়েকে নিয়ে বাবার বরিশালের বাসায় এসে বসবাস শুরু করি। তখন বাবারও চরম আর্থিক দীনতা চলছিল। উপায়ন্তর না পেয়ে একসময় নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৪০ টাকা ভাতায় প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কাজ শুরু করি। শিমুর বয়স তখন আড়াই বছর। হঠাৎ একদিন বরিশালের বাসায় আসেন আমার বড় ভাশুর তৎকালীন সেনাবাহিনীর অডিট সুপার মঞ্জুরুল আলম। তখন তার স্ত্রী দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে মারা গেছেন। দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তিনি আমাকে গ্রহণ করার জন্য পরিবারের কাছে সরাসরি প্রস্তাব দেন। শিমু তার বাবার পরিচয়ে বড় হবে ভেবে পরিবারের লোকজন এ প্রস্তাবে রাজি হয়। বিয়েও হয়। শিমু আর ওই পরিবারের তিন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকাতে দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে বসবাস শুরু করি। বছর পাঁচেক পর আমার কোলজুড়ে আসে দ্বিতীয় কন্যা নিঝুম। দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে আট বছর কেটে যায়। একদিন তিনিও হঠাৎ করে মারা যান। আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয় আমার। এবার প্রতিপক্ষ শ্বশুরবাড়ির লোকজন। দ্বিতীয় বিয়ের ১১বছর পর আমার দুই মেয়েসহ আমাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। চলে আসি ঢাকায়। সে সময় আমার ছোট বোন আমাকে ও দু’মেয়েকে আশ্রয় দেয়। আক্ষেপ করে নারী মুক্তিযোদ্ধা আলমতাজ বেগম বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে আমার দু’ভাই, স্বামী এমনকি আমিও এখন পর্যন্ত সরকারীভাবে কোন স্বীকৃতি পাইনি। ভবিষ্যতে পাব কিনা তাও জানি না। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধকালে মৃত্যুকে পরোয়া করিনি কিন্তু আজ যখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময় এসেছে তখন খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে। আলতাজ বেগমের বড় মেয়ে শিমু জানান, সম্প্রতি তার মায়ের ক্যান্সার রোগ ধরা পড়েছে। দীর্ঘদিন তার মা ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অর্থাভাবে তাকে কোন উন্নত চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। বর্তমানে মা পাথরঘাটা উপজেলা শহরের বাড়িতে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। Ñখোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ও খোকন কর্মকার, পাথরঘাটা থেকে
×