ঊনবিংশ শতাব্দীতে অবিভক্ত বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে যে অবিস্মরণীয় নতুন জোয়ার শুরু হয়, নারীর সামাজিক অবস্থান ও সেই আঙ্গিকে বিচার্য। সমাজের প্রায়ই অর্ধাংশ নারী জাতির স্বাভাবিক চলার পথ অনেকটাই আষ্ট্রেপৃষ্ঠে বাধা ছিল তৎকালীন সমাজ স্যবস্থার অভেদ্য প্রাচীরে। উনিশ শতকে নতুন আলোর বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। রাজা রামমোহন এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সঙ্গত কারণেই ইউরোপীয় সংস্কৃতি অবাধ বিস্তারের সঙ্গে জড়িত ছিল ঠাকুর বাড়ির পর্বত প্রমাণ ঐশ্বর্য এবং সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। ফলে দ্বারকানাথ ঠাকুরই বিশেষভাবে দিন নির্দেশকরূপে চিহ্নিত হন নতুন কলকাতা শহর বিনির্মাণের সক্রিয় ভূমিকায়। পাশাপাশি বন্ধু,সহযোগী রাজা রামমোহন রায় ও নিয়োজিত হলেন বহু দেববাদ এবং কট্টর ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিপরীতে নতুন এক ধর্মসংস্কার আন্দোলনে। ধর্মকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হলেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা সমস্ত প্রাচীনপন্থ অপসংস্কার থেকে। আর বিদ্যাসাগর এসে হাল ধরলেন অপ্রয়োজনীয় সামাজিক আবর্জনা থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত নারীতথা গোটা সমাজকে নতুন সূর্যের আলো দেখাতে।
প্রসঙ্গত এসেই যায় উনিশ শতকে আসলে নারীরা কেমন ছিল? বিস্তারিত ঐতিহাসিক পটভূমি ছাড়াও খুব সাধারণভাবে বলা যায় মেয়েরা একেবারেই অসহায় এবং অত্যাচার, অবিচারের সর্বশেষ পর্যায়ে ছিল। অশিক্ষা, প্রাচীন সংস্কার, অসহনীয় প্রচলিত প্রথার বেড়াজালে নারীর জীবন ছিল সর্বনাশের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বাল্য বিবাহের নামে অপরিণত জীবন যুদ্ধ, কৌলিন্য প্রথার অভিশাপে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার সীমাহীন দুর্ভোগ, বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধের জাঁতাকালে অসহায় মেয়েদের অবর্ণনীয় সামাজিক বঞ্চনা। আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে জ্বলন্ত চিতায় মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণের মতো লোমহর্ষক ঘটনা নারী জাতির এক সমস্যা সঙ্কুল কালো অধ্যায়।
নব জাগরণের সিদ্ধ পুরুষরা যখন আলোর পথ খুঁজে পেলেন, তখন আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে নারী জাতিকে অন্ধকার থেকে বের করে আনার প্রচেষ্টা চলতে থাকে।
দ্বারকানাথ আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় উঠতি শিল্পোদ্যোক্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও সমাজ সংস্কারের প্রতিও তাঁর দৃষ্টি ছিল উল্লেখ করার মতো। আধুনিক সৃষ্টিশীলতা, উদার মানবিকতা বাদ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেল বন্ধনসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যকলাপে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে তৎপর হলেন। নতুন আলোর দিশারী,কর্মবীর এই দ্বারা কানাথ স্ত্রী স্বাধীনতায় ও বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু রামমোহনের বন্ধু হলেও ব্রাহ্ম ধর্ম থেকে মাথা সম্ভব দূরেই ছিলেন।
উপনিষদের প্রথম বাংলা অনুবাদক রাজা রাম মোহন রায় ধর্মগ্রন্থ থেকেই বের করে আনেন নিরাকার ব্রহ্মের সমস্ত দিক-নিশানা। শুধু তাই নয় নারী-শিক্ষার প্রতিও তাঁর জোরালো সমর্থন ছিল। এমনকি আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত নারীরাই প্রথম এগিয়ে আসে।
আর নিপীড়িত নারীদের সত্যিকারের ত্রাণকর্তা হিসেবে আজো যাঁর নাম উজ্জল নক্ষত্রের মতো দীপ্তিমান তিনি নারীজাতির সত্যিকারের পথ দ্রষ্টা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। চারিত্র পূজা প্রবন্ধে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেনযে, কোনদিন তাকে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়নি, কারণ তাঁর মাই ছিলেন সাক্ষাত দেবী-প্রতিমা। তারপরেও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী একজন নিষ্ঠাবান, মানবিক মানুষ ধর্মশাস্ত্র ঘেঁটেই বের করে আনেন অনাদৃত, অবহেলিত বঞ্চিত নারীদের মুক্তির সমস্ত উপায়। দুঃসাহসিক এই বিপ্লবী একাই এগিয়ে যান নারী জাতিকে তাঁর সমস্ত মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেবার দৃঢ় প্রত্যায়। নিজের ছেলের সঙ্গে নিধবার বিয়ে দিয়ে সমাজে দৃষ্টান্ত রাখেন।
ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুনের প্রশাসনিক ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হয় বিদ্যাসাগরের অনমনীয় দৃঢ়তা। তারই ফলশ্রুতিতে অবিভক্ত বাংলায় মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল বেথুনের অগ্রযাত্রা। স্কুলের প্রতিষ্ঠা কাল ১৮৪৯।
বিদ্যাসাগরই প্রথম অনুভব শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে শিক্ষার প্রলেপে নারীজাতির যথার্থ মুক্তি আসবে না। ভিতর থেকে গেড়ে বসা সমস্ত সামাজিক কুপ্রথাকে সমূলে উৎখাত করতে না পারলে নারীরা সত্যিকার অর্থে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হবে। তাই বাল্য বিহাত রদ, বিধবা বিবাহ প্রচলন এবং সহমরণের মতো ঘৃণ্য কুপ্রথাকে রোধ করার আইনী ব্যবস্থার প্রয়োজন ও অপরিহার্য বলে মনে করলেন।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি মনয়ে নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হলেও এ শিক্ষা সবার জন্য অবারিতহয়নি এবং অবরুদ্ধ নারীরা সে ভাবে ঘর থেকেও বের হতে পারেনি। নারীর এই বিপর্যস্ত সামাজিক অবস্থা মূর্তহয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে,নাটকেএবং কবিতায়। বিংশ শতাব্দীতে নজরুলের লেখার মধ্যেও আমরা পাই নারী জাতির অসহায়িত্বের সামাজিক দলিল।