ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি শুরু, ঐতিহ্যবাহী উৎসবের রং চারুকলায়

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১৭ মার্চ ২০১৬

মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি শুরু, ঐতিহ্যবাহী উৎসবের রং চারুকলায়

মোরসালিন মিজান ॥ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা...। অগ্নিস্নানে শুচি হওয়ার সেই সময় আসন্ন প্রায়। যেটুকু বাকি, দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাবে। আর তার পর পহেলা বৈশাখ। হ্যাঁ, অসাম্প্রদায়িক বাঙালীর সবচেয়ে বড় আর বর্ণাঢ্য উৎসবটি। এ কারণে প্রস্তুতি পর্বটাও হয় দীর্ঘ। সারা দেশজুড়ে চলে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ শুরু করেছিল ১৯৮৯ সালে। এখান থেকেই পহেলা বৈশাখ সকালে বের করা হয় অত্যন্ত আকর্ষণীয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা সামনে রেখে এবারও সরব হয়ে উঠেছে চারুকলার ক্যাম্পাস। প্রতি বছর যে সময়ে শুরু হয়, এবার তারও আগে। বুধবার ছবি এঁকে প্রস্তুতি পর্বের উদ্বোধন করেন বরেণ্য শিল্পী রনবী ও মনিরুল ইসলাম। তখন থেকেই মুখরিত গোটা ক্যাম্পাস। বুধবার দুপুরে চারুকলা অনুষদে গিয়ে দেখা যায়, যথারীতি প্রস্তুত করা হয়েছে জয়নুল গ্যালারির সামনের খোলা জায়গা। টেবিল পাতা হয়েছে কয়েকটি। ব্যবস্থা করা হয়েছে রং তুলির। বিভিন্ন মাপের ক্যানভাস তৈরি যখন, সামনে এসে দাঁড়ান বরেণ্য শিল্পী ও কার্টুনিস্ট রনবী। তার ঠিক পাশেই ছিলেন আরেক বিখ্যাত শিল্পী মনিরুল ইসলাম। দু’জনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন চারুকলার ডিন নিসার হোসেন। না, ঠিক আঁকার কথা ছিল না তাদের। তবু আঁকলেন। শিক্ষার্থীরাও আঁকিয়ে নেয়ার সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ফলে ছবি এঁকেই হলো উদ্বোধন। মাত্র কয়েক মিনিট রং তুলির ছোঁয়াছুঁয়ি হলো। চারপাশ থেকে ঘিরে সেই দৃশ্য দেখলেন শিক্ষার্থীরা। মোবাইল ফোনে ছবি তোলার চেষ্টা করলেন। এরই মাঝে আঁকা শেষ। কিন্তু কী আশ্চর্য! দেখে মন ভরে যায়! ছবি আঁকা শেষ হতেই বেজে ওঠে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢাক। বাঙালী মন কি আর উতলা না হয়ে পারে? সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় নাচ। উপস্থিত শিক্ষার্থীরা তুমুল নেচে ওঠেন। লোকজ সংস্কৃতির মুড়ি মুড়কি, নারিকেলের নাড়ু, মিষ্টি বাতাসা ইত্যাদি দিয়ে চলে আপ্যায়ন। সব মিলিয়ে বৈশাখের আগেই উৎসবের আমেজ। হাসিরাশি আনন্দ হৈহুল্লোড় জানিয়ে দেয়, বৈশাখ আসন্ন। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে কথা হয় বরেণ্য শিল্পী রনবীর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। সারা দেশেই এ উপলক্ষে উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। চারুকলা অনুষদ প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। আমরা শিল্পীরা এর সঙ্গে বহুকাল ধরে একাত্ম হয়ে আছি। এক সময় এত বড় কাজ করতে হিমশিম খেতে হতো। এখন চারুকলার ছাত্র বেশি। শিক্ষক বেশি। কাজটি আগের তুলনায় সহজ হয়েছে। এর পরও প্রচুর শ্রম ঘাম দিতে হয়। কষ্ট করতে হয়। কিন্তু অনেকেই এই শ্রম ঘাম ভালবাসার কথা জানেন না। তারা কেবল মঙ্গল শোভাযাত্রার বর্ণাঢ্য রূপটি দেখেন। কীভাবে এত বড় কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয় সে বিষয়ে জানলে সবাই আরও বিস্মিত হবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। একই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত শিল্পী মনিরুল ইসলাম বলেন, আমি পঞ্চাশ বছর আগে এখানে শিক্ষকতা করেছি। তার আগে একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলাম। এখানে এলে তাই স্মৃতিকাতর হয়ে যাই। বৈশাখের মতো উৎসবে নিজেকে এই যে যুক্ত করতে পারা, সত্যি আনন্দের। আয়োজন সম্পর্কে উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক ও চারুকলার ডিন নিসার হোসেন জানান, যতদিন যাচ্ছে আয়োজনটি তত বড় হচ্ছে। এ কারণেই সময় একটু এগিয়ে আনা হয়েছে। পহেলা বৈশাখের আগের রাত পর্যন্ত এখানে ৫ শতাধিক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী কাজ বরবে। সব রকমের সহায়তা দেবেন শিক্ষকরা। ছাত্র-শিক্ষক সবাই মিলে ছবি আঁকবেন। সরাচিত্র হবে। মাটির পুতুল, পাখি, মুখোশ ইত্যাদিতে ভরে উঠবে চারুকলার প্রতি প্রান্ত। লোকজ ঐতিহ্যের স্মারকসমূহ বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা দিয়েই আয়োজন করা হবে মঙ্গল শোভাযাত্রার। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল থিম এখনও ঠিক হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, আজ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় শিক্ষকদের বৈঠক থেকে প্রতিপাদ্য ঠিক করা হতে পারে। সমকালীন সব দিক বিবেচনায় রেখে প্রতিবাদী অবস্থানেই থাকবে চারুকলা এমন ধারণা দেন তিনি। উদ্যাপন কমিটির সমন্বয়ক খালিদ হাসান রবিন জানান, এবার আয়োজনের নেতৃত্ব দিচ্ছে চারুকলার ১৭তম ব্যাচ। প্রথম দিনটি ছবি আঁকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হবে সরাচিত্র আঁকার কাজ। কয়েক দিনের মধ্যেই মঙ্গল শোভযাত্রার মূল অনুষঙ্গ স্ট্রাকচার নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
×