ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিভিউ আবেদনের সুযোগ ১৫ দিনের মধ্যে

‘মৃত্যুদণ্ডই তার ন্যূনতম শাস্তি’ ॥ নিজামীর আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৬ মার্চ ২০১৬

‘মৃত্যুদণ্ডই তার ন্যূনতম শাস্তি’ ॥ নিজামীর আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

আরাফাত মুন্না ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপীল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। চূড়ান্ত এ রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন জানাতে পারবেন তিনি, যার নিষ্পত্তিসাপেক্ষে রায় কার্যকর করবে সরকার। পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ সকল হত্যাকা-ে আলবদর বাহিনীর প্রতি মতিউর রহমান নিজামীর পূর্ণ সমর্থন ছিল। একাত্তরে নিজামীর ন্যূনতম অপরাধগুলোও ছিল ভয়ঙ্কর ও বীভৎস। এ কারণেই মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোন শাস্তি তার হতে পারে না। মৃত্যুদ-ই তার ন্যূনতম শাস্তি। মঙ্গলবার বিকেলে ১৫৩ পৃষ্ঠার এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। এর আগে রায়ে স্বাক্ষর করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ আপীল মামলার রায় প্রদানকারী চার বিচারপতি। অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। পূর্ণাঙ্গ রায়টি লিখেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়েছেন। রায়ের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন করতে ১৫ দিনের সময় পাবেন আসামিপক্ষ। বুধবার থেকে এ ১৫ দিনের ক্ষণ গণনা শুরু হবে। এ সময়ের মধ্যে কেউ রিভিউ আবেদন না করলে আইন অনুসারে দ- কার্যকর প্রক্রিয়া শুরু করবে সরকার। এ্যাটর্নি জেনারেল জানান, রিভিউ হলে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে। রিভিউ খারিজ হলে মৃত্যুদ- কার্যকর প্রক্রিয়া ফের শুরু হবে। সেক্ষেত্রে সর্বশেষ সুযোগ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন আসামি। প্রাণভিক্ষার আবেদন না করলে কিংবা আবেদন করার পর নাকচ হয়ে গেলে চূড়ান্তভাবে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। রায়ে আদালত বলেন, ১৯৭১ সালের নবেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে নিজামী লিখেছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু পাকিস্তানী ‘মোনাফেক’ ভারতের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তাদের এ ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও আদর্শকে রক্ষা করতে হবে। ওই নিবন্ধে আলবদর বাহিনী গঠন করায় নিজামী সন্তোষ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের প্রশংসা ও সাহসের যোগান দিয়েছে নিজামী। রায়ে সুপ্রীমকোর্ট বলেন, নিজামীর ওই নিবন্ধ প্রকাশের পর দেশজুড়ে ব্যাপকহারে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং মানবতাবিরোধী অন্যান্য অপরাধ সংঘঠিত করেছে আলবদর বাহিনী। রায়ে বলা হয়, ওই সময় নিজামী ছিল খুবই সক্রিয় রাজনৈতিক নেতা। তিনি ওই সব হত্যাকা-ের বিষয়ে পুরোপুরি অবগত থাকা সত্ত্বেও আলবদর বাহিনীকে কোন বাধা দেননি, বরং এসব অপরাধে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। একই সঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য আলবদর বাহিনীকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচীতে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছে। রায়ে আরও বলা হয়, এসব রাজনৈতিক বক্তৃতায় মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মোনাফেক’, ‘দুর্বৃত্ত’, ‘ভারতের দালাল’ এবং ‘দেশের শত্রু’সহ নানা ধরনের অভিধায় আখ্যায়িত করেছে। ওই সব বক্তৃতায় মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করতে এবং প্রতিশোধ নিতে আলবদর, রাজাকার ও ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে। নিজামীর এসব বক্তৃতাই প্রমাণ করে, বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ সকল হত্যাকা-ে আলবদর বাহিনীর প্রতি তার সমর্থন ছিল। রায়ে আদালত বলেন, ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়েই আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। আর ওই সময় নিজামী ছিলেন ছাত্রসংঘের প্রধান। রায়ে আপীল বিভাগ বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায় অনুসারে সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (উর্ধতন নেতৃত্বের দায়) নিজামীকে বহন করতে হবে। এটা প্রমাণিত যে, দলের নেতা হিসেবে কর্মীদের প্রতি তার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছিল। রায়ে আদালত বলেন, আলবদর বাহিনী যেসব হত্যাকা- ঘটিয়েছে, তা স্বাভাবিকভাবে অত্যন্ত বীভৎস ও নৃশংস। এসব হত্যাকা-ে শুধু শহীদদের পরিবারই নয়, সমস্ত দেশের মানুষই মর্মাহত হয়েছে। দেশবাসী দীর্ঘদিন ধরে এসব অপরাধীর শাস্তির জন্য অপেক্ষা করছে। নিজামীর ন্যূনতম অপরাধগুলোও ছিল ভয়ঙ্কর ও বীভৎস। কাজেই মৃত্যুদ- ছাড়া অন্য কোন শাস্তি তার হতে পারে না। এটাই তার ন্যূনতম শাস্তি বলেও রায়ে উল্লেখ করে সুপ্রীমকোর্ট। গত ৬ জানুয়ারি দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় দেন চার বিচারপতির আপীল বেঞ্চ। রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ একাত্তরে গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে আলবদর বাহিনীর শীর্ষনেতা নিজামীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-াদেশ বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত। একই সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে করা তার আপীল আবেদন আংশিক খারিজ করে দেয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নিখিল পাকিস্তানের সভাপতি হিসেবে পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন নিজামী। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ছাড়াও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি (উর্ধতন নেতৃত্বের দায়) হিসেবে আলবদর বাহিনী ও ছাত্রসংঘের অপরাধের দায়ও তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে রায়ে। নিজামীকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- এবং হত্যা-গণহত্যা ও ধর্ষণসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (উর্ধতন নেতৃত্বের দায়) প্রমাণিত আটটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে চারটিতে ফাঁসি ও চারটিতে যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে তিনটিতে ফাঁসি ও দুটিতে যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। অন্য তিনটিতে চূড়ান্ত রায়ে দ- থেকে খালাস পেয়েছেন নিজামী, যার মধ্যে একটিতে ফাঁসি ও দুটিতে যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ ছিল ট্রাইব্যুনালের রায়ে।
×