ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকিং খাতে বড় পরিবর্তন আনা হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৫ মার্চ ২০১৬

ব্যাংকিং খাতে বড় পরিবর্তন আনা হবে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ রিজার্ভের অর্থ লোপাটের ঘটনায় ব্যাংকিং খাতে পরিবর্তন আনার আভাস পাওয়া গেছে। তবে ব্যাংকিং খাতের কোন্ পর্যায়ে এ পরিবর্তন আনা হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন ইঙ্গিত না দিলেও সোমবারও এ ঘটনায় অর্থমন্ত্রীর কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরতে দেখা গেছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গবর্নরের বিষয়টি তিনি সরাসরি বলেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি শোনেন, কোন মন্তব্য করেননি। আজ মঙ্গলবার সকালে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করা হবে। এই সম্মেলনে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে। শুধু তাই নয়, সোমবার সন্ধ্যায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে জরুরী বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। ওই বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. আসলাম আলমসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আজ কী বলবেন ও পরবর্তী করণীয় কি হতে পারে তা নির্ধারণ করা হয়। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী জানান, টেলিফোনে গবর্নরের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। আজ দিনের যে কোন সময় এ বিষয়ে দু’জনের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া অর্থ লোপাটের ঘটনায় আজ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরুরী বোর্ড সভা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের কারণে বোর্ড সভাটি স্থগিত করা হয়েছে। এদিকে, মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষ হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিজ দফতরে এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন অর্থমন্ত্রী। ওই সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থ লোপাটের এ ঘটনায় ব্যাংকিং খাতে পরিবর্তন আনা হবে। ডেফিনেটলি দে আর উড বি চেইঞ্জেস। এতবড় একটা সিরিয়াস ব্যাপার। আই টেক ইট ভেরি সিরিয়াসলি। অর্থমন্ত্রী আরও জানান, তিনি এখন গবর্নর ড. আতিউর রহমানের জন্য অপেক্ষা করছেন। এছাড়া আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবেন অর্থমন্ত্রী। গবর্নর ড. আতিউর রহমানকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জরুরী তলব করা হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মোঃ শাহেদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রিজার্ভ থেকে হ্যাকারদের ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। অর্থমন্ত্রী নিজেও ক্ষুব্ধ। তাই এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থমন্ত্রী নিজেই আজ একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেবেন। ইতোমধ্যে গবর্নরকে তলব করা হয়েছে। তবে সংবাদ সম্মেলনে গবর্নর ড. আতিউর রহমান উপস্থিত থাকবেন কি-না সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সম্মেলনে এ ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকের শুরুতে অর্থমন্ত্রী রিজার্ভ ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষোভের সঙ্গে জানান অর্থমন্ত্রী। ক্ষুব্ধ অর্থমন্ত্রীকে অন্য সিনিয়র মন্ত্রীরা শান্ত করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিসভার এক সদস্য বলেন, বৈঠকের শুরুতে অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে রিজার্ভের অর্থ চুরির বিষয়টি উত্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি (অর্থমন্ত্রী) বলেন, অর্থ চুরির বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ আমাকে জানায়নি। এর মধ্যে তাদের (বাংলাদেশ ব্যাংক) সঙ্গে আমার মিটিং হয়েছে। তারপরও তারা আমাকে কিছুই বলেনি। পাঞ্জাবি পরিহিত অর্থমন্ত্রীকে এ সময় বেশ রাগান্বিত দেখায়। এ সময় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার আসন থেকে অর্থমন্ত্রীকে বলেন, আপনার পাঞ্জাবিটা খুবই সুন্দর। তিনি (অর্থমন্ত্রী) এত বেশি ক্ষুব্ধ থাকেন যে, ওবায়দুল কাদেরের কথা শুনতে পাননি। তখন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, কাদের (ওবায়দুল কাদের) বলেছে আপনার পাঞ্জাবিটা খুব সুন্দর। এটা শুনে ধন্যবাদ জানিয়ে স্বাভাবিক হয়ে হেসে ফেলেন অর্থমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানা গেছে, মন্ত্রিসভার বৈঠকের টেবিলটি পূর্ব-পশ্চিম দিকে পাতানো। দু’পাশে মন্ত্রিসভার সদস্যরা বসেন। টেবিলের পূর্বপ্রান্তে বসে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভার বৈঠকের আসন বিন্যাসে প্রধানমন্ত্রীর ডান পাশে শুরুতেই বসেন অর্থমন্ত্রী মুহিত, এর পর বসেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সোমবারের বৈঠকের ছবিতে ওবায়দুল কাদেরকে টেবিলের বাম দিকের ছয় নম্বর আসনে বসতে দেখা গেছে। প্রসঙ্গত, গত ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক থেকে লেনদেনের সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন-এসডব্লিউআইএফটি) কোড জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ৮০০ কোটি টাকা) চুরি হয়ে চলে যায় শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপিন্সে। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও ব্যাংকিং সচিব এম আসলাম আলম তা জানতে পারেন মার্চের প্রথম সপ্তাহে। এছাড়া ফিলিপিন্সের ডেইলি ইনকোয়ারারে ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ লোপাটের খবর এলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড় ওঠে। তদন্তে জানা যায়, গত ৪ ফেব্রুয়ারি সুইফট মেসেজিং সিস্টেমে হ্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে সঞ্চিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই অর্থ ফিলিপিন্সের একটি ব্যাংকে সরিয়ে ফেলা হয়। শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংকে আরও ২০ মিলিয়ন ডলার সরানো হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুরুতেই বিষয়টি টের পেলেও কর্মকর্তারা তা গোপন করে যাওয়ায় অর্থমন্ত্রী মুহিতকে এক মাস পর তা পত্রিকা পড়ে জানতে হয়। এদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটি সম্মেলনে অংশ নিতে গত ১০ মার্চ ভারত যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। তবে সোমবার বিকেলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। গবর্নর ভারত থেকে ফিরে এলে পদত্যাগ করতে পারেন বলে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে গুঞ্জন ছিল। এছাড়া পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়েও গুঞ্জন রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের যা বলেন অর্থমন্ত্রী ॥ রিজার্ভের রক্ষিত টাকা লোপাটের ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই সাংবাদিকরা সুযোগ পেলেই এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চান। তাই সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক শেষে যখন অর্থমন্ত্রী নিজ দফতরে ফিরে আসেন তখনও এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। ওই সময় স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ ঘটনায় অবশ্যই ব্যাংকিং খাতে পরিবর্তন আনতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে বিষয়েও সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, অর্থ লোপাটের বিষয়টি চেপে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে তা সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছে তাকে অযোগ্যতা আখ্যায়িত করে ক্ষুব্ধ মুহিত রবিবার বলেন, এই স্পর্ধার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেবেন বলেও জানিয়েছিলেন মুহিত। এদিকে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী কোন নির্দেশনা দিয়েছেন কি-না জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, আই এ্যাম ওয়েটিং ফর আতিউর। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব বলেছিলাম, আলোচনা আমার হয়েছে। এখন বিবৃতি দেবেন কি-না জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, আর কিছু স্টেটমেন্ট নেই। গবর্নর ফিরে এলে আই উইল গিভ মাই স্টেটমেন্ট। সেটা আজও (গতকাল) হতে পারে, কালও (আজ) হতে পারে। কারণ সে কখন আসবে তার কোন ঠিক নেই। যদিও গতকাল সোমবার বিকেলে ভারত থেকে ফিরে এসেছেন গবর্নর ড. আতিউর রহমান। পরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, যে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী বিরাট বিরাট প্রকল্প করছেন, রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ, জিডিপি ৭ শতাংশ হবে বলে মনে করছি- সেই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ঘটনা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এটা আমরা কল্পনা করি নাই, আমরা চিন্তা করি নাই, এ ব্যাপারে অবশ্যই বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করব। ব্যাপারটা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী-আমরা সকলেই গুরুত্বসহকারে নিয়েছি। গবর্নরের পদত্যাগ দাবি করলেন লেনিন ॥ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের টাকা লোপাটের ঘটনায় গবর্নরের পদত্যাগ দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা চুরির নৈতিক দায় গবর্নর এড়াতে পারেন না। আত্মসম্মানবোধ থাকলে তিনি অবশ্যই পদত্যাগ করবেন। সোমবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের স্মরণসভায় তিনি এসব কথা বলেন।
×