ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঋষিজের আলতাফ আলী হাসু স্মরণ

মুক্তিযুদ্ধ ও শোষিতের সংগ্রামকে ধারণ করেছিল তাঁর গান

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১২ মার্চ ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধ ও শোষিতের সংগ্রামকে ধারণ করেছিল তাঁর গান

মোরসালিন মিজান ॥ ‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে/ আমি এহন রিকশা চালাই ঢাকা শহরে...।’ অত্যন্ত জনপ্রিয় এ গানের কথাই আগে বলতে হবে। কোথাও বাজলেই হলো, শ্রোতা একাত্ম হয়ে যান। শুরু হয়ে যায় গুণগুণ! যে যার মতো করে ঠোঁট মেলান। গানে প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার বেদনা। মিলনাকাক্সক্ষা। একই সঙ্গে গ্রাম থেকে উদ্বাস্তু হয়ে রাজধানী শহরে আসা মানুষের জীবনসংগ্রাম। খেটে খাওয়া মানুষের এমন অযুত সংগ্রাম ও হৃদয়ানুভবকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন আলতাফ আলী হাসু। অসংখ্য গানে গণমানুষের কথা বলা গীতিকবিকে শুক্রবার স্মরণ করল তারই সংগঠন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। প্রতিবারের মতো এবারও কথায় গানে গণসঙ্গীতে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানানো হলো তাকে। একই অনুষ্ঠানে প্রদান করা হলো আলতাফ আলী হাসু স্মৃতিপদক। বিকেলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীতে। একাধিক সংগঠনের শিল্পী ও সমবেত সুধী দাঁড়িয়ে গানÑ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...। পরের গানে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের কথা। শিল্পীরা গেয়ে যানÑ মুক্তির মন্দির সোপান তলে/ কত প্রাণ হলো বলিদান/ লেখা আছে অশ্রুজলে...। ততক্ষণে বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি আরও একবার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে শুরু হয় আলোচনা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীরের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন সৈয়দ রেজাউর রহমান, গোলাম কুদ্দুছ, সোহরাব হাসান, লুৎফর রহমান রিটন প্রমুখ। বক্তারা বলেন, আলতাফ আলী হাসু ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তার। একই ব্যক্তি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে সংগ্রাম করেছেন। বিশিষ্ট বাম নেতা আইনজীবী হিসেবেও ছিলেন স্বনামধন্য। আর মানুষের একেবারে আপনজন হয়ে ওঠেন গান রচনা করে। তার গান শুধু গান হয়ে থাকেনি। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছে। অনুষ্ঠানে আলতাফ আলী হাসু স্মৃতিপদক-২০১৬ প্রদান করা হয়। এ বছর পদকটি দিয়ে সম্মানিত করা হয় রাজনীতির মানুষ, লেখক ও গবেষক নূহ-উল-আলম লেনিনকে। পদক গ্রহণ করে তিনি বলেন, আমাকে পুরস্কৃত করার প্রস্তাব আমি সাধারণত ফিরিয়ে দিই। কিন্তু আলতাফ আলী হাসুর নামে যে পদক, সেটি গ্রহণ করে আমি গৌরবান্বিত বোধ করছি। একসঙ্গে বাম রাজনীতি করার স্মৃতি তুলে ধরে লেনিন বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যা করার পর যারা প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন হাসু তাদের অন্যতম। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল সঙ্গীতায়োজন। হাসুকে উৎসর্গ করে সঙ্গীত পরিবেশন করে আয়োজক সংগঠন ঋষিজ, ক্রান্তি, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, বহ্নিশিখা ও স্ব-ভূমি লেখক শিল্পীকেন্দ্র। অনুষ্ঠানের বিশেষ পরিবেশনা ছিল খ্যাতিমান গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীরের গান। সংগঠনের এক সময়ের সাধারণ সম্পাদক হাসুর লেখা বিখ্যাত গান ‘ও সখিনা’ গেয়ে শ্রোতাদের নষ্টালজিক করে তুলেন তিনি। ছিল আরও কয়েকটি জনপ্রিয় গণসঙ্গীতের পরিবেশনা। গান শেষে কথা হয় ফকির আলমগীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, হাসুর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা। গানের কথা ও সুরেও তিনি মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছিলেন। তার গানে ছিল দেশ মাটি মানুষের কথা। অনাহারী দুখী মানুষের কথা তার গানে পেয়েছি আমরা। শহরে চাকচিক্যের মাঝে থেকেও তারা রিক্সাওয়ালা পল্লীবালাকে ভুলতে পারে না। গ্রামের প্রতি এই যে পিছুটান, শেকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার এমন আকুতি বার বার ওঠে আসে হাসুর গানে। একই সঙ্গে গানে আমরা পাই আন্তর্জাতিকতাবাদ। এসব কারণেই হাসু স্বতন্ত্র উচ্চতা লাভ করেন। তাকে স্মরণ করতে হয়। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন সংগঠনের শিল্পী ফকির সিরাজ ও ঝর্ণা আলমগীর।
×