সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার পূর্ব এলাকায় তেল ও গ্যাসপ্রাপ্তির অনুসন্ধান চালাচ্ছে পেট্রোবাংলার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বাপেক্স। সারিয়াকান্দির যমুনার তীর বরাবর, গাবতলীর গ্রামে ইতোপূর্বের ভূকম্পন জরিপের জায়গায় এবং বগুড়া সদর ও শাজাহানপুরে এবার বিশেষ পদ্ধতিতে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, এই অঞ্চলে তেল ও গ্যাসপ্রাপ্তির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কী পরিমাণ তেল ও গ্যাস মজুদ আছে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বলা সম্ভব নয়। তারা শুধু অনুসন্ধান করে একটি রিপোর্ট দেবে। দেশের পুরাতন যে জায়গাগুলোতে অনুসন্ধান চলেছে সেখানেই অনুসন্ধানী দল যাচ্ছে। বর্তমানে বগুড়া ছাড়াও জামালপুর, নেত্রকোনায়ও জরিপ চলছে। এর আগে পাবনা ও দিনাজপুরে অনুসন্ধান হয়েছে।
খনিজসম্পদ প্রাপ্তির এই অনুসন্ধান শুরু হয়েছে গেল বছর। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৪ মার্চ পুনরায় অনুসন্ধান শুরু হয়। উত্তর-পশ্চিামাঞ্চলে তেল গ্যাসপ্রাপ্তির অনুসন্ধান নতুন নয়। গত শতকের শুরুতে ১৯১০ সালে প্রথম এই অঞ্চলে অনুসন্ধান শুরু করে একটি বিদেশী কোম্পানি। এর ৪৫ বছর পর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি বগুড়ার পূর্ব এলাকায় যমুনার পশ্চিম তীরে কুচমা কলাকোপায় স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাক্যুম অয়েল কোম্পানি কূপ খনন করে। সেই আমলের যন্ত্রপাতি দিয়েই যখন তেলপ্রাপ্তির শতভাগ আশা ছিল তখনই কোন অজানা কারণে কূপ খননের জায়গাগুলো সিলড করা হয়।
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে গিয়ে ১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সিলেটের হরিপুরে যখন তেলের সন্ধান মিলল তখনই পুরাতন খননের জায়গাগুলোতে ফের অনুসন্ধান চালায় পেট্রোবাংলা। কারণ হরিপুরে প্রাপ্ত এই পদার্থকে ব্রিটিশ কোম্পানি প্রথম পানি বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্বদ্যিালয়ের (বুয়েট) ক’জন অধ্যাপক ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের ওপর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ওই পদার্থ যে ক্রুড অয়েল তা প্রমাণিত হয়। একই বছর সারিয়াকান্দির যমুনার তীর বরাবর, গাবতলীর কলাকোপা তল্লাতলায় পেট্রোবাংলার ভূকম্পন জরিপ দল মাটির নিচের ডাটাবেজ নিয়ে অনুসন্ধান করে। খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব এবিএম গোলাম মোস্তফা ওই সময় জানিয়েছিলেন, প্রাথমিক খননে তেলপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে তেল উত্তোলনের সার্বিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এই অধ্যায়ের পরও অজানা (!) কারণে অনুসন্ধান উত্তোলনের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় ভূতত্ত্ববিদগণ বলেছিলেন, দেশের উত্তর-পশ্চিামাঞ্চলের মাটি অনেক পুরাতন। বিশ্বের অন্যতম বদ্বীপ বঙ্গ অববাহিকার বিশাল একটি অংশজুড়ে বাংলাদেশ। এই দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে সিকিম-কাঞ্চনজঙ্ঘার উপত্যকা খসিয়া জয়ন্তিকা থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। গিরিপথ ছুঁয়ে সরলরেখায় সমুদ্র অরণ্যময় মালভূমি ও সমতলভূমি নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত। এই ভূমিতে তেল না পাওয়াটাই বিস্ময়কর ছিল। হরিপুরে তেল পাওয়ার পর এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এই মাটির নিচে তেল-গ্যাস খনিজের অফুরন্ত ভা-ার রয়েছে।
ইতোমধ্যে কয়লা ও কঠিন শিলা উত্তোলিত হয়েছে উত্তরের দিনাজপুর অঞ্চলে। পূর্বাঞ্চলে গ্যাস ও তেল তো মিলেছেই। উত্তরাঞ্চলে যে তেল-গ্যাস আছে তার আভাস এর আগে পাওয়া গেছে। নাটোরে গ্যাস অনুসন্ধানের কূপ খননের পর আশাবাদী হওয়ার পর্যায়েই সিলড করা হয়। একই অবস্থা হয়েছে পাবনা ও বৃহত্তর দিনাজপুরে। তেঁতুলিয়ায় শালবাগানে তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন সরকার এই তেল উত্তোলনের জন্য ফ্রান্সের ফস্টাল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। ওই বছরের মে মাসে ৮ হাজার ফুট গভীরতায় কূপ খুঁড়ে ১২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসানো হয়। এই কাজে ব্যয় হয় ৩৫ কোটি টাকা। মাস দুয়েক পর হঠাৎ ওই কোম্পানি পাইপ বসানোর জয়গায় সিলড করে চলে যায়। কেন তেল উত্তোলন করা গেল নাÑ এই রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খনিজ অনুসন্ধানে সব সময় কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। খননকাজ, জরিপকাজ কম হওয়ায় খনিজ উত্তোলন- বিশেষ করে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সম্ভবনাকে কাজে লাগানো হয়নি। ভূবিজ্ঞানীগণ বার বার বলছেন, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তেল ও গ্যাসের অপার ভা-ার রয়েছে। তারপরও পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি অনুসন্ধানের পর চলমান প্রক্রিয়া আর থাকে না। বছর দশেক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য সার্ভিসের ওয়াশিংটন ফাইলের স্টাফ রাইটার জুডিথ ট্রানজো জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের ওপরই ভাসছে, যার বড় অংশটি রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে।
এক সূত্র জানায়, বগুড়া ও পাবনার মধ্যে প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকায় ভূস্তরে যেভাবে গ্যাস ও তেল থাকার কথা সেই অবস্থাতেই আছে। ভূগর্ভে হাইড্রোকার্বন উপাদান ও তা মজুদ হওয়ার বিজ্ঞানসম্মত নিয়ম আছে। ভূস্তরে রয়েছে অনেক ভাঁজ। উৎসশিলার মধ্যে জৈব উপাদান তাপে ও চাপের বিবর্তনে তেল ও গ্যাসে রূপ নেয়। জমে থাকা এসব উপাদান শিলা থেকে বের হয়ে ফাঁক-ফোকরে স্থান নেয়। পরে উর্ধমুখী হয়ে আরেক স্তরে ছোটে। এই চলাতাইে তৈরি হয় ফাঁদ বা ট্র্যাপ। লুকিয়ে থাকা এই সম্পদ কাঠামোগত বা স্ট্রাকচারাল ট্র্যাপে থাকলে তেল-গ্যাস উত্তোলনে ঝুঁকি কম। বগুড়া থেকে পাবনার মধ্যকার ভূস্তরে তেল-গ্যাস নানাভাবে রয়েছে।
বাপেক্স বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। কখনও আশ্রয় নেয়া হচ্ছে ম্যাগনেটিক ফিল্ডে। জালের মতো বিছিয়ে এ ধরনের অনুসন্ধান নতুন। তবে আরও আধুনিক প্রযুক্তি আছে। সূত্র জানায়, অনুসন্ধানের পর তেল-গ্যাসের রিজার্ভ আঁচ করা গেলে কয়েকটি পর্যায়ে আরও অনুসন্ধান চলবে। বর্তমান সরকার দেশের সকল সম্পদ উত্তোলন করে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ ছাড়িয়ে উন্নত দেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় খনিজ অনুসন্ধান ও উত্তোলনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
