ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৮ মার্চ ২০১৬

প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে

নাজনীন আখতার/ এমদাদুল হক তুহিন ॥ আইন প্রণয়ন, পাহাড় জয়, আকাশে পাখা মেলা, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় দৃপ্ত পদক্ষেপ, কর্মক্ষেত্র- এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে নারী অংশগ্রহণ করেনি। প্রতিটি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়ছে। তবে চলার এ পথ মসৃণ নয়। বিপদসঙ্কুল। হাজার প্রতিকূলতা, বাধাবিপত্তি ডিঙ্গিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টায় চলছে নিরন্তর যুদ্ধ। নির্যাতন থামিয়ে দিতে চায়, অধিকার খর্ব করতে চায় সমাজ, এর পরও থেমে নেই নারী। চলার পথে, বাড়ি ফেরার পথে, ঘরে-বাইরে;, এমনকি কর্মস্থলেও কোন না কোনভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে নারী। তাও থেমে নেই। আর অফুরান এ প্রাণশক্তি নিয়ে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে সমঅধিকার লড়াই আর লক্ষ্য পূরণে শক্তিশালী হওয়ার শপথ নিয়ে আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হচ্ছে। ঊনবিংশ শতক থেকে শুরু হওয়া নারীর নিজস্ব চিন্তা ভাবনার ফসল আজকের আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দীর্ঘদিনের অবদমিত অবস্থার টানাপোড়েন কাটিয়ে সেদিন নারী চেয়েছিল মুক্তি, তার জীবনের অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার। আজকের নারী দিবস এক দিনের অর্জন নয়। ক্ষুদ্র পরিসর থেকে ছড়িয়ে পড়া এই বৈশ্বিক স্বীকৃতির পেছনে রয়েছে ধারাবাহিক ইতিহাস। ২০৩০ সালের মধ্যে লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এবার জাতিসংঘের প্রতিপাদ্যে। দিবসটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ সারাদেশে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে নানান কর্মসূচীর মাধ্যমে দিবসটি পালন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। র‌্যালি, সমাবেশ, পথনাটক ও আলোচনাসভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটি পালন উপলক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নারী বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। নারীর বর্তমান চিত্র ॥ প্রতিনিয়তই সমাজের কোথাও না কোথাও ঘটছে নারী নির্যাতন। পাশবিক নির্যাতনের চিত্র প্রকাশ্যে এলেও মানসিক নির্যাতনের চিত্র অন্ধকার সমাজের অন্ধকারেই রয়ে যায়। ঘটমান সেইসব মানসিক নির্যাতনের কথা অনেকক্ষেত্রে মুখ ফুটে বলতেও চায় না কোন কোন নারী। ঢাকার মেয়ে বর্ণালী মাহমুদ, কর্মজীবী নারী। অত্যন্ত প্রগতিশীল, তবে নারীবাদী নন। চলার পথে তাকে প্রতিনিয়তই রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাঁটতে হয়। প্রায়শই সমাজের উচ্ছিষ্টের কটূ উক্তিতে হয়ে ওঠেন ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, ‘আমি নারীবাদী নই, কিন্তু মানুষ হিসেবে যখন মানুষের মর্যাদা পাই না, তখন খুব কষ্ট হয়।’ তার ভাষায়, নিজের পছন্দমতো চলাটাও অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অন্যের পছন্দানুসারে পোশাক না পরায় হতে হয় প্রশ্নের সম্মুখীন! আর প্রায়শই হতে হয় টিজিং-এর শিকার। শুধু বর্ণালী নন, কোন কারণ ছাড়াই ঘরে-বাইরে নারীকে হতে হয় পুরুষতান্ত্রিকতার নির্মম দুঃসহ যন্ত্রণার শিকার। তবে সেই দুঃসহ যন্ত্রণাকে তুড়ি মেরে জীবনযুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে নারী। আদায় করে নিচ্ছে অধিকার। সিলেটের অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর থেকেই চালাচ্ছেন স্কুটি। তাকেও চলার পথে প্রতিনিয়ত শুনতে হয় টিপ্পনি। তবু থেমে নেই স্কুটির চাকা। ঘুরছে দ্রুততর। স্কুটির চাকার মতো কানিজ মাহমুদের পরিবারের ভাগ্যও ঘুরতে শুরু করেছে। চট্টগ্রামের মেয়ে কানিজ, বুটিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। চাটগাঁ থেকে অর্থনীতেতে মাস্টার্স শেষে জড়িয়ে পড়েন ব্যবসার সঙ্গে। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে অর্ডার সংগ্রহ করে লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে চলছে নকশার কাজ। এই নারী উদ্যোক্তার গড়ে মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা। শুধু নিজের নয়, তিনি পরিবারের দেখাশোনায়ও ব্যয় করছেন নিজের উপার্জিত অর্থ। একই অবস্থা সিলেটের নারী সায়মা রহমান সুমিরও। শহরের মিরবক্সটুলায় নিজের বুটিকের দোকান। নিজেই দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এ ব্যবসার সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে যুক্ত, তবে এটা আমাদের অনেক পুরনো দোকান। এতদিন বাচ্চারা ছোট ছিল। তারা বড় হয়েছে। এখন আমার অবসর। তাই দোকানে বসছি প্রতিদিন।’ সুমির আয়ও খারাপ নয়, যদিও তার ব্যবসার উপর নির্ভর করে পরিবার চলে না। তাদের মতোই সমাজের সর্বত্রই দেখা যায় নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার চিত্র। নারীবান্ধব বর্তমান সরকার নারীর অধিকার আদায়ে বদ্ধপরিকর। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, উর্ধতন কর্মক্ষেত্রেও নারীরা অবদান রেখে চলছেন স্বমহিমায়। দিবসটির প্রাক্কালে এক অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, বর্তমান সরকার নারীর অধিকার আদায়ে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। তবে জনবহুল এ দেশে সব সমস্যা সরকারের পক্ষে এককভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। সবাইকে এজন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে, কেবল সম্মিলিতভাবে অধিকার আদায়ে লড়াই করলেইÑজয় নিশ্চিত। অনুষ্ঠানে নারীর আধিকার আদায়ের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি আরও বলেন, সবাই যদি এক সঙ্গে কাজ করি করি তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে নারী-পুরুষের সমতা আনয়ন করতে পারব, তবেই নারীর প্রতি সকল বৈষম্য রোধ হবে। সত্যিই তাই, বহু ক্ষেত্রেই বিলোপ হবে বৈষম্য। তবে এখনও ঘরে-বাইরে কারণ ছাড়াই নির্যাতিত হয় নারী, এই আধুনিক যুগেও! তাই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি ‘নারীর অর্জন ও সাফল্যকে স্থায়ীকরণের লক্ষ্যে চাই আরও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ’ সেøাগানটিকেই এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে। বেশ কয়েকদিন ধরে চলছে সভা-সেমিনার। ‘নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজন সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা’ ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা দূরীকরণ এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ’ ‘জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে চাই সরাসরি নির্বাচন’র দাবির মতোই সিডও সনদ থেকে সকল প্রকার সংরক্ষণ তুলে নেয়ারও জোর দাবি রয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন। রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, সমসুযোগ, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নারী-পুরুষ সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের সর্বস্তরে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, আজকের সমাজে যে পরিবর্তন এবং উন্নয়ন হয়েছে তা পুরুষের একার চেষ্টায় নয়, বরং নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। অগ্রযাত্রার এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালের পূর্বেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেছেন, সরকার নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সমতা ও দারিদ্র্য বিমোচনকে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় অগ্রভাগে স্থান দিয়েছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘অধিকার, মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান’ যথার্থ ও সময়োপযোগী হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই প্রতিপাদ্য নারীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমঅধিকার নিশ্চিত করতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৬’ যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপন করা হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত। তিনি আরও বলেন, ‘নারী সমাজের অনগ্রসরতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে নারী উন্নয়নে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। নারী উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সকল সনদ, ঘোষণা ও সিদ্ধান্তগুলো আমরা অনুসমর্থন করেছি এবং সেসব লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ তাঁর বাণীতে বলেছেন, সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সামাজিক সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক বৈষম্য ও নিরাপত্তাহীনতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সংবিধান অনুযায়ী প্রথম থেকেই সব ধরনের কাজে নারীদের অংশগ্রহণ, এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জাতীয় সংসদের অধিকসংখ্যক নারীদের উপস্থিতির মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে নারীর প্রতি বৈষম্য কমতে শুরু করেছে। তবে তা এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। বিরোধীদলীয় নেতা আশা প্রকাশ করেন নারী-পুরুষের সম-অংশীদারিত্বের মাধ্যমেই দেশের অগ্রগতি ও উন্নতি নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাঁর বাণীতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সকল নারীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, ‘জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারী সমাজের অগ্রগতি সাধিত হলে মানব প্রগতির সর্বাধিক বিকাশ সম্ভব হবে। এ সত্যটি উপলব্ধি করেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। নারী সমাজ যাতে অবহেলা, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার এবং ন্যায্য অধিকার থেকে তারা যাতে বঞ্চিত না হয় সেদিকে সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁর বাণীতে বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন নারী উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচী নিয়েছিল। সে সময় নারীদের আর্থিকভাবে স্বারলম্বী হতে উৎসাহ দেয়া হয়। ওই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে নারীরা দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। এদিকে আজ ৮ মার্চ মঙ্গলবার নারী দিবস পালন উপলক্ষে সোমবার থেকেই নানা কর্মসূচী পালন শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন। সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ দলিত নারী ফোরাম ও প্রগতিশীল গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশন। আজ ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর মুক্তমঞ্চে বিকাল সাড়ে ৪টায় এ দিবস পালন উপলক্ষে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ৭০টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি বিকাল ৪টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক সমাবেশের আয়োজন করেছে। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ও স্টেপস টুওয়ার্ডস বিকেল ৩টায় একটি সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ বিকাল ৪টায় ফার্মগেটে থ্রি ডি সেমিনার হল কেআইবি কমপ্লেক্সে এক সেমিনারের আয়োজন করেছে।
×