ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিনহাকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন ও এ্যাটর্নি জেনারেলকে বাদ দেয়ার দাবি মন্ত্রী কামরুল ইসলামের এ বিচার থেকে সিনহার সরে দাঁড়ানো উচিত, জনকণ্ঠের মামলায়ও তার একই কাজ করতে ;###;হতো- বিচারপতি শামসুল হুদা

সরে দাঁড়ান

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৬ মার্চ ২০১৬

সরে দাঁড়ান

আরাফাত মুন্না ॥ প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মৃত্যুদ-ে দ-িত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর আপীলের পুনঃশুনানি দাবি করেছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। এ আপীলের শুনানিতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন দলের কাজ নিয়ে প্রধান বিচারপতির অসন্তোষ প্রকাশের মধ্য দিয়ে রায়ের ইঙ্গিত মিলছে বলে দাবি করেন সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী বলেন, তিনি সরে দাঁড়াতে পারেন। শনিবার রাজধানীর ধানম-িতে বিলিয়া মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত ‘একাত্তরের গণহত্যাকারীদের বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র : সরকার, বিচার বিভাগ ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচকের বক্তব্যে তিনি এ দাবি জানান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদ- হয়েছিল জামায়াতের অর্থ যোগানদাতা হিসেবে পরিচিত মীর কাশেমের। তাকে রক্ষার চেষ্টা চলছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে গণজাগরণ মঞ্চও আন্দোলনে রয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এ মামলার রায় কী হবে, তা প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্যে আদালতে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি। তার বক্তব্যের মধ্যে এটা অনুধাবন করেছিÑ এ মামলায় আর মৃত্যুদ-ের রায় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। কামরুল বলেন, প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্য আদালতে কী বললেন? প্রসিকিউশন এ মামলা নিয়ে রাজনীতি করছে। জামায়াত যে অভিযোগ করেছে, বিএনপি যে অভিযোগ করেছে, তাদের আন্তর্জাতিক লবিস্ট গ্রুপ যে সুরে কথা বলছে, একই সুরে কথা বলেছেন প্রধান বিচারপতি। প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন তিনি। শুধু তাই নয়, এ বক্তব্যে ট্রাইব্যুনালের পাঁচ বছরের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ ও হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা ২২টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে। এর মধ্যে চারজনের দ- কার্যকর হয়েছে। এই প্রসিকিউশন টিমই সাকা চৌধুরীর মামলায় কাজ করেছে। তখনতো কোন সমস্যা হয়নি। এখন কেন প্রশ্ন উঠল? কামরুল আরও বলেন, আমি জানি না আমার কথাগুলো আদালত অবমাননার মধ্যে পড়ে কি-না। তবে সত্য কথা বলতে আমি ভয় পাই না। সত্য নির্ভয়ে বলতে হয়। তিনি বলেন, আমি মীর কাশেমের ট্রাইব্যুনালের পুরো রায় পড়েছি। আমি যতটুকু দেখেছি আমার কাছে মনে হয়েছে মামলাটি সঠিকভাবেই হয়েছে। প্রধান বিচারপতি যখন প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন আমি তখনই পুরো রায়টি পড়লাম। আমি কোথাও ত্রুটি খুঁজে পাইনি। আর ওই ট্রাইব্যুনালেতো তিনজন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকই বিচার করেন। তারাওতো কোন ত্রুটি পাননি। জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়ের প্রশংসা করে কামরুল ইসলাম বলেন, স্বদেশ রায় এখানে উপস্থিত, তাকে আমি ধন্যবাদ দেই। তার প্রতি সমস্ত জাতি কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, সাকা চৌধুরীর রায় অন্যকিছু হতে পারত। কিন্তু স্বদেশ রায় তার লেখনির মাধ্যমে আমাদের সজাগ করেছেন বলে সাকা চৌধুরীর ফাঁসি হয়েছে। কামরুল বলেন, বাংলাদেশে ৪৫ বছরে অনেক বিচারপতি এসেছে আর গেছে, কিন্তু কেউ তার মতো এত অতিবক্তব্য দেয়নি। তার অতিকথনে সুধী সমাজের মানুষেরা জিহ্বায় কামড় দিচ্ছেন। তাই তাকে অতিকথন থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি। আর তা না হলে সরকারকে নতুন করে বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করা উচিত বলে আমি মনে করছি। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একই সুরে কথা বলা শুরু করেছেনÑ এ মন্তব্য করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, তার দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনা করা। কিন্তু তিনিও প্রধান বিচারপতির সুরে কথা বলছেন। কোথায় যাব? এ্যাটর্নি জেনারেলের বিষয়ে কামরুল বলেন, তিনি বেশি বুঝেন। তিনি বলেছেন, এ বক্তব্য দেয়া হয়েছে বলেই রায় অন্যরকম হবেÑ এটা ভাবার কোন কারণ নেই। তবে আমি বলব, প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্য আদালতে যা বলেছেন, এরপর হয় তিনি আসামিকে খালাস দেবেন, নয়ত সাজা কমিয়ে দেবেন, না হয় মামলা পুনর্বিচারে পাঠাবেন। মৃত্যুদ- বহাল রাখার আর কোন উপায় নেই তার। তিনি আরও বলেন, প্রধান বিচারপতির সুরে আমাদের এ্যাটর্নি জেনারেলও প্রসিকিউশনের সমালোচনা করছেন। তিনি আপীল মামলায় প্রসিকিউটরদের সহায়তা নেন না। আমার আইনজীবী পেশার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, যে আইনজীবী বলবে তিনি অনেক জানেন, তিনি আসলে কিছুই জানেন না। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, কেন আজ মীর কাশেমের মামলায় প্রশ্ন ওঠবে। মীর কাশেম মৃত্যুদ-াদেশ নিয়ে কারাগারের কনডেম সেলে অবস্থান করছে। কিন্তু তার অর্থ কিন্তু বাইরে কার্যকর। বাইরে কিন্তু তার বিরাট কর্মীবাহিনী সক্রিয়। তার দেহটা কারাগারে আছে, তার অর্থ-বৃত্ত কিন্তু বাইরে আছে। খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হচ্ছেÑ প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন করে শুনানি হওয়া উচিত। প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে একটি বেঞ্চ হোক, সেই বেঞ্চে আপীলের শুনানি হোক। একই সঙ্গে এ্যাটর্নি জেনারেলকেও শুনানি থেকে বাদ দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই আইন প্রতিমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক বলেন, এখন সঙ্কটময় মুহূর্ত চলছে। প্রধান বিচারপতি প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন। আর এখন যদি রায়টা মৃত্যুদ- বহাল থাকে তাহলে টবি ক্যাডম্যানরা বলতে থাকবে আমরা চাপ সৃষ্টি করেই এ রায় নিয়েছি। আর রায় যদি বিপরীত হয় তাহলে আমরা মানব না। এটা একটা বড় সঙ্কট। তিনি বলেন, এ সঙ্কট আমাদের সৃষ্টি। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, আমিও একজন ছোট বিচারক ছিলাম। ১২ বছর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ২৪ বছর পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে অনেক বিচার করতে হয়েছে। আমার জীবনে কোন রায়ের আগে কোন মন্তব্যই করিনি। তিনি বলেন, আমার মনে কষ্ট হয়, প্রধান বিচারপতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও যদি রায়ের আগেই মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মন্তব্য করেন তাহলে জাতি কোথায় যাবে? ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা...’ গানটির কয়েক লাইন গেয়ে মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী বলেন, বিচারপতিরাও আইনের উর্ধে নয়। আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছেÑ রাষ্ট্রের প্রধানও আইনের উর্ধে নন, তাকেও ইম্পিচমেন্ট করার সুযোগ আছে। তাই প্রধান বিচারপতিও আইনের উর্ধে নন। মন্ত্রী বলেন, আইন সবার জন্য সমান। তিনি যে সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন এখন সেই সঙ্কটের সমাধান তাকেই করতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা নিয়ে প্রধান বিচারপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। আর সেটা তিনি প্রত্যাহার না করলে পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন সরকারের এই মন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের কথা বলা হচ্ছে, তারা ১৮ দিনে বিচার শেষ করেছে। সেটা ন্যায়বিচার। আর আজ আমরা পাঁচ বছর ধরে সবার বক্তব্য শুনতেই যাচ্ছি, আসামিরাও সাফাই সাক্ষী দিচ্ছে। তারপরও আমাদের বিচার নাকি সঠিক নয়। এখন টাকার কাছেই সবকিছু, বিবিসির মতো মিডিয়া যারা, একাত্তরে গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছে। কিন্তু আজ তারাই আবার যুদ্ধাপরাধীদের ইসলামিক লিডার বলছে। এমন হলে দুনিয়া কিভাবে চলবে? প্রশ্ন করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের যে বিচার হচ্ছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি ইউনিক ঘটনা। যে আইনে যেভাবে এ বিচারটা হচ্ছে তার জন্য বাংলাদেশ পৃথিবীর সামনে বুক উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, আর সেই বিচারের বিরুদ্ধে একটা বিশাল লবিং, বিশাল ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা দুঃখের সঙ্গে দেখছি আন্তর্জাতিকভাবে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তার সঙ্গে আমাদের বিচার সংশ্লিষ্টদের কণ্ঠও মিলে যাচ্ছে। তার প্রতি আমরা মুক্তিযোদ্ধারা নিন্দা জানাই। শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুল হুদা বলেন, আমি নিজেকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েই বক্তব্য দিচ্ছি। আমরা যখন বিচারকের আসনে যাব, আমাদের সাবধান হয়েই কথা বলতে হবে। বিচারকের সম্মান আমাদের রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অশোভনীয়। প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আজ মুক্তিযুদ্ধের বুকে লাথি মারার যে ব্যবস্থা আপনারা করছেন তা থেকে বিরত থাকুন। মুক্তিযুদ্ধ না হলে আপনারা সুপ্রীমকোর্টের বিচারক কেন, ক্লার্কও হতে পারতেন কি-না তা নিয়েও সন্দেহ আছে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব এখন সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার। সিদ্ধান্ত আপনাকে নিতে হবে। আপনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আর আমরা মুক্তিযোদ্ধা। বিচারপতি শামসুল হুদা নিজের বিচারিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমি বিচারিক জীবনে অনেক পর্যবেক্ষণ দিয়েছি, অনেকের চাকরিও গেছে আমার পর্যবেক্ষণের পর। কিন্তু কখনই আগে কোন মন্তব্য করিনি। আজকে কেন আপনারা তর্ক সৃষ্টি করবেন। তিনি বলেন, আমি যদি এখন সিনহা সাহেবের জায়গায় থাকতাম তাহলে আমি নিজেকে ওই মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নিতাম, যেটা জনকণ্ঠের মামলায়ও করা প্রয়োজন ছিল। তিনি ওই মামলায় স্বীকার করেও নিজেকে প্রত্যাহার করেননি। একটা পক্ষ হয়ে কিন্তু বিচার করা যায় না বলেও মন্তব্য করেন এই বিচারপতি। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, গত ৭০ বছরে আমরা এমন মুখর প্রধান বিচারপতি দেখিনি। তিনি ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই বেশি কথা বলে যাচ্ছেন। যা বেশি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে এবং আদালতকে আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আমরা সবার পক্ষ থেকে বলছি এটা অনভিপ্রেত। মুনতাসীর মামুন বলেন, তিনি কিন্তু প্রসিকিউশনের সমালোচনা করতে গিয়ে তার সহকর্মী বিচারকদেরও সমালোচনা করছেন। কারণ ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা কিন্তু হাইকোর্টেরই বিচারপতি এবং তারা কিন্তু প্রসিকিউশনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই রায় দিয়েছেন। সুতরাং তিনি রায় নিয়ে কথা বলছেন। তিনি আরও বলেন, প্রধান বিচারপতি যদি তার সহকর্মী বিচারকদের নিষ্ঠা বা কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাহলে তারা হাইকোর্টের বিচারপতি থাকতে পারেন কি-না? ওই রায় নিয়ে কথা বলা মানেই তিনি কিন্তু বিচারকদের নিয়ে কথা বলছেন। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি হয়ত ফৌজদারি আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের পার্থক্য বুঝতে পারছেন না। কারণ তিনি এ আইনে এর আগে কখনও বিচার করেননি। তিনি যে কারণে বারবার সাক্ষীর কথা বলছেন। গণহত্যার কী করে সাক্ষী হবে? যখন মানুষ জীবন শঙ্কায় ছিল তখন সাক্ষী আসবে কী করে। মুনতাসীর মামুন বলেন, আমাদের প্রধান বিচারপতিতো যুদ্ধের সময় জীবন শঙ্কায় ছিলেন না, তিনিতো ওই সময় আমাদের প্রতিপক্ষ ছিলেন। প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে মুনতাসীর মামুন বলেন, ধর্ষণের কি প্রমাণ দেবেন আপনি? প্রধান বিচারপতি এ ধরনের কথা বলে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একটা সংঘর্ষ সৃষ্টি করছেন, যা বিএনপি-জামায়াত করেছিল। স্বাধীনতার সপক্ষের সরকার কিভাবে স্বাধীনতাবিরোধী একজন ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন প্রশ্ন রাখেন তিনি। এ পর্যন্ত কোন প্রধান বিচারপতির জন্য গোলটেবিল আলোচনা করতে না হলেও, এখন কেন গোলটেবিল করতে হবেÑ প্রশ্ন মুনতাসীর মামুনের। মুনতাসীর মামুন আরও বলেন, তিনি আমাদের আদালতের মুখোমুখি করে দিচ্ছেন, তার কারণেই টবি ক্যাডম্যানরা সুযোগ পাচ্ছে। এরও বিচার হওয়া দরকার। আলোচনা অনুষ্ঠানে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের পক্ষে (বিচারপতি মানিক লন্ডনে অবস্থান করছেন) তার মেয়ে নাদিয়া চৌধুরী লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। তার বক্তব্যে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেমের মামলার বিচার চলাকালীন যুদ্ধাপরাধী মামলাসমূহের তদন্ত ও প্রসিকিউশনের কাজের দুর্বলতা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা ন্যায়বিচার পরিপন্থী। ন্যায়বিচারের নীতি অনুসারে কোন ব্যক্তিকে কোন অভিযোগে অভিযুক্ত করতে হলে তাকে অবশ্যই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপন করা বেআইনী। বিচারপতি মানিকের বক্তব্যে বলা হয়, মীর কাশেমের লবিস্ট টবি ক্যাডম্যান প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পর যুদ্ধাপরাধ বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং তার মতে প্রধান বিচারপতি এরূপ মন্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়Ñ যুদ্ধাপরাধ মামলাসমূহের বিচারপ্রক্রিয়ায় ত্রুটি রয়েছে। টবি ক্যাডম্যানের এ বক্তব্যের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। বিচারপতি মানিক বলেন, আমি বিচারপতি হিসেবে তিনটি যুদ্ধাপরাধ মামলায় বিচারক হিসেবে ছিলাম। কিন্তু আমি সেই তিনটি মামলায় প্রসিকিউশনের দোষত্রুটি দেখি নাই। যুদ্ধাপরাধী মামলায় প্রসিকিউশনের অথবা তদন্তকারী কর্মকর্তার কোন ত্রুটি থাকলে তা অবশ্যই ট্রাইব্যুনাল (ট্রায়াল কোর্ট) বিবেচনা করত। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশনের কোন ত্রুটি অথবা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কোন ত্রুটি পায় নাই। প্রধান বিচারপতির বেআইনী বক্তব্যের পর তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক বলেই মনে করেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় বলেন, আমি শুরুতেই একটা প্রশ্ন রাখবÑ তিনি কি এখনও নৈতিকভাবে প্রধান বিচারপতি আছেন? কারণ জনকণ্ঠের মামলায় প্রধান বিচারপতি সাকা চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন, এমন তথ্য প্রমাণ আদালতে উপস্থাপনের পর তিন তা স্বীকার করেন। উনি আদালতে এটা স্বীকার করার পর তিনি আর নৈতিকভাবে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি থাকতে পারবেন কি-না? এর আগে গোলটেবিল অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র : সরকার, বিচার বিভাগ ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনাসভার ধারণাপত্র পাঠ করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সম্মিলিতভাবে এই ধারণাপত্রটি লিখেন। ওই ধারণাপত্রে বলা হয়, জামায়াতের হুমকি, হামলা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে ট্রাইব্যুনাল গত ছয় বছরে ২২টি মামলা নিষ্পত্তি করে গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করেছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধের মামলায় নতুন মাইল ফলক স্থাপন করেছে। ধারণাপত্রে বলা হয়, প্রথম দিকে ট্রাইব্যুনালের স্থান নির্বাচন, গঠনপ্রণালী, তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনে কিছু অযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ নিয়ে আমরা সরকারের কম সমালোচনা করিনি। শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী আবদুল কাদের মোল্লার মামলা পরিচালনায় ট্রাইব্যুনালের অদক্ষতার প্রতিবাদে শাহবাগের চত্ব¡রে ছাত্র-জনতার মহাজাগরণ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে কাদের মোল্লার আপীলে সুপ্রীমকোর্ট ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে গোটা জাতির প্রশংসা অর্জন করেছেন। ওই ধারণাপত্রে বলা হয়, সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর আপীল শুনানিতে মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার কঠোর সমালোচনা করে এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। ধারণাপত্রে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামীর প্রধান আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের প্রধান অর্থ জোগানদাতা ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, অন্যতম প্রধান যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেমের মামলায় প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে চৌদ্দটি অভিযোগ এনেছিল। এর ভেতর দুটি অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ল তাকে মৃত্যুদ- এবং অন্যগুলোতে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দিয়েছে। আদালতে প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণের পরই তাকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে। অন্য অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের যদি কোন দুর্বলতা থাকে তার সমালোচনা নিশ্চয় প্রধান বিচারপতি বা আপীল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা করতে পারেন এবং আমাদেরও তা মেনে নেয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে প্রসিকিউশন মৃত্যুদ-যোগ্য অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে আরও মনোযোগী হন। ধারণাপত্রে বলা হয়, তবে আরও অনেক সাক্ষী কেন আনা হয়নি, মাননীয় প্রধান বিচারপতির এই সমালোচনার জবাবে আমরা বলতে চাই, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডজন ডজন সাক্ষী হাজির করার প্রয়োজন নেই, কারণ ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩’-এ সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে এই আইনের অধীনে পরিচালিত মামলায় ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত সনাতন সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য হবে না। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর মার্কিন প্রধান প্রসিকিউটর জাস্টিস রবার্ট জ্যাকসন বলেছিলেন, প্রাথমিকভাবে তিনি প্রমাণের জন্য নির্ভর করেছেন নাৎসি নেতাদের বক্তব্য, সরকারী দলিল এবং পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উপর। তিনি সাক্ষীর উপর বেশি নির্ভর করেননি এ কারণে যে, প্রতিপক্ষ বলতে পারে সাক্ষীদের প্রভাবিত করে শিখিয়ে পড়িয়ে আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় আমরা দেখেছি অভিযুক্তদের দল কীভাবে সরকারপক্ষের সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে, এমনকি হত্যা ও গুম করার ঘটনাও ঘটেছে। ধারণাপত্রে আরও বলা হয়, ট্রাইব্যুনালের যে তিনজন বিচারপতি এই মামলায় রায় লিখেছেন তারা সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সমমর্যাদার বিচারক। তাঁদের উপর আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে। কারণ এর আগে এই ট্রাইব্যুনাল ’৭১-এর গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক মানের রায় প্রদান করেছেন। আমরা আশা করি যে দুটি অপরাধে ট্রাইব্যুনাল মীর কাশেমকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন আপীলেও তা বহাল থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং বিচারপ্রত্যাশী সমগ্র জাতিকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে মীর কাশেমের মামলায় কোন অবস্থায়ই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার পুনারাবৃত্তি আমরা মানব না। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফের সভাপতিত্বে সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান কর্নেল (অব) আবু ওসমান, দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ প্রমুখ। উল্লেখ্য, মীর কাশেম আলীর আপীল মামলা শুনানিকালে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং তদন্ত সংস্থা যে গাফিলতি করেছে এ জন্য তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। তিনি বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনায় খুবই মর্মাহত। মামলার এভিডেন্স দেখলে, এগুলো পড়লে আমাদের খুব কষ্ট লাগে। মামলাগুলো যখন আমরা পড়ি, তখন আমাদের গা ঘিনঘিন করে তাদের মামলা পরিচালনা দেখে। সব মামলায় এটা হয়ে আসছে। এরপর প্রধান বিচারপতি এ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, এত হাফ হার্টেড হয়ে আপনারা মামলা চালান কেন? প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থার পেছনে রাষ্ট্রের লাখ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। কিন্তু তারা এসব কী মামলা পরিচালনা করছে? ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা শুধু ব্যস্ত টিভিতে চেহারা দেখানো নিয়ে। তারা দামীদামী গাড়ি চড়েন আর পুলিশের হুইসেল দিয়ে ঘুরে বেড়ান। এরপর যুদ্ধাপরাধীদের আন্তর্জাতিক লবিস্ট টবি ক্যাডম্যান এই বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আবারও প্রশ্ন তোলেন।
×