ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনেক ব্যাংক মুখ খুলছে না

কমপক্ষে ১১ ব্যাংকে স্কিমিং ডিভাইস দিয়ে এটিএম জালিয়াতি

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৩ মার্চ ২০১৬

কমপক্ষে ১১ ব্যাংকে স্কিমিং ডিভাইস দিয়ে এটিএম জালিয়াতি

রহিম শেখ ॥ একটি-দুটি নয়, কমপক্ষে ১১টি ব্যাংকে স্কিমিং ডিভাইস দিয়ে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে নকল কার্ড বানিয়ে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এ পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংকের কার্ড জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ পেলেও অনেক ব্যাংক মানসম্মানের ভয়ে মুখ খুলছে না। এটিএম বুথের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণের পরও মামলা থেকে সরে আসছে কোন কোন ব্যাংক। আবার কোন ব্যাংক নিশ্চিত হওয়ার পর নীরবেই গ্রাহকের গায়েব হওয়া টাকা ফেরত দিচ্ছেন। এদিকে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এদেশীয় বেসরকারী মালিকানাধীন ব্যাংকের ভিসা কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় ঘটেছে বিদেশেও। সম্প্রতি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ার পর বিদেশী ব্যাংকের সঙ্গে এ সংক্রান্ত নেটওয়ার্কিং সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব ঘটনায় গ্রাহকের কী পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, চার ব্যাংকের ৪০ জন গ্রাহকের ২০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এসব জালিয়াতির নায়ক বিদেশী নাগরিক পিওটরের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, এই জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বেসরকারী ইস্টার্ন, সিটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ও মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংকের গুলশান, বনানী ও মিরপুর কালশী এলাকার ছয় এটিএম বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে অর্থ আত্মসাত করে জালিয়াত চক্র। এতে প্রায় ১ হাজার ২৫৫ কার্ডের তথ্য-উপাত্ত চুরি করে চক্রটি। এর মধ্যে ৩৬টি কার্ড ক্লোন করে গ্রাহকের অজান্তে প্রায় ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকা তুলে নেয় জালিয়াতি চক্র। এর মধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের মোট ২৪ বারে ১৭ লাখ ৫৩ হাজার, সিটি ব্যাংকের ৪ বারে ১ লাখ ৪০ হাজার, ইউসিবিএলের ৭ বারে ১ লাখ ২৬ হাজার এবং মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১ বার লেনদেনে ৪০ হাজার টাকা উত্তোলন করে জালিয়াত চক্র। ওই ঘটনায় ইউক্রেনের নাগরিক পিওটর ও সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে তারা এটিএম বুথের পাশাপাশি পয়েন্ট অব সেলস (পস) মেশিনেও জালিয়াতির বিভিন্ন তথ্য দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এটিএম বুথের পাশাপাশি বেসরকারী ব্র্যাক ব্যাংকের পয়েন্ট অব সেলস (পস) মেশিনেও জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে আসে। সর্বশেষ গত শনি ও রবিবার ক্রেডিট কার্ড ক্লোন করে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চারটি বুথ থেকে ৩৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। এতে প্রতারণার শিকার হয়েছেন সৌদি আরবভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংক আল-রাজীর গ্রাহক। এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার বনানী থানায় এ বিষয়ে একটি মামলাও করেছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। প্রিমিয়ার ব্যাংকের বুথে জালিয়াতির শিকার সব কটি কার্ডই ছিল বিশ্বব্যাপী পরিচিত ব্যাংক আল-রাজীর মাধ্যমে ইস্যু করা ভিসা ব্রান্ডের। প্রিমিয়ার ব্যাংকে আল-রাজী ব্যাংকের কর্ড ব্যবহারের ব্যবস্থা রয়েছে। জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ার পর প্রিমিয়ার ব্যাংক আল-রাজীর সঙ্গে তাদের এ সংক্রান্ত নেটওয়ার্কিং সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। প্রিমিয়ার ব্যাংকের এমডি খন্দকার ফজলে রশিদ জনকণ্ঠকে বলেন, কয়েকটি বিদেশী ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। দুটি কার্ড এটিএম বুথে আটকে গেছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়েছে। বনানী থানায় একটি মামলাও হয়েছে। তিনি জানান, সিসিটিভি অনুসরণ করে রবিবার একজন প্রতারককে ধরার চেষ্টা করলে সে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ফুটেজ দেখে মনে হয়েছে, সে পেশাদার জালিয়াত চক্রের সদস্য। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তের কাজ চলছে। সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারী ইস্টার্ন, সিটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ব্র্যাক ও প্রিমিয়ার ব্যাংক ছাড়া অন্তত আরও ৫টি ব্যাংকের এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানা গেছে, তাদের তদন্তের বাইরেও অনেক গ্রাহকের টাকা গায়েব হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেসব টাকা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের দিয়ে দিচ্ছে। এদিকে টাকা পেয়ে গ্রাহকরাও আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগাযোগ করছেন না। কিন্তু এগুলো বিভিন্নভাবে জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো এই তথ্য বাইরে প্রকাশ করছে না। কোন গ্রাহক অভিযোগ নিয়ে এলে ব্যাংকের প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাচাই করে অভিযোগের সত্যতা থাকলে টাকা দিয়ে দিচ্ছে। এভাবে এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর প্রায় ৩ কোটি টাকার বেশি দিতে হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, এই জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও কাজ করছে। নতুন করে আরও দুই-একটি ব্যাংকে এ ধরনের জালিয়াতির আভাস পাওয়া গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলো খতিয়ে দেখছে। এ প্রসঙ্গে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ডিএমডি ও ইলেকট্রনিক কার্ড বিশেষজ্ঞ আবুল কাশেম মোহাম্মদ শিরীন জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড অর্থাৎ ভিসা ও মাস্টার কার্ড বিশ্বের যে কোন দেশ থেকে জালিয়াতি হতে পারে। তবে যে দেশের এটিএম বুথ ব্যবহার করে অর্থ জালিয়াতি করা হলে ওই দেশের মুদ্রা পাবে জালিয়াতরা। এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারী ব্যাংকের এক গ্রাহক জনকণ্ঠকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু সাম্প্রতিক ঘটনার তদন্ত করে ২১ লাখ টাকা জালিয়াতির তথ্য পেয়েছে। এর বাইরে অনেক গ্রাহকের তথ্য চুরি হয়ে একই প্রক্রিয়ায় টাকা গায়েব হওয়ার ঘটনা থাকতে পারে। যেগুলো প্রকাশিত হচ্ছে না। এ জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা গায়েব হওয়ার তথ্য সংগ্রহ করা উচিত। পরে এগুলো তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা হয়ত ঠেকানো যাবে। তা না হলে এসব ঘটনা আরও বাড়বে। কেননা এর আগে আরও যে কয়েকটি ব্যাংকে ডিজিটাল জালিয়াতি হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তাদেরও শাস্তি দেয়া হয়নি। এটিএমে আটকালে নতুন কার্ড ॥ ব্যাংকের এটিএম বুথে কোন গ্রাহকের কার্ড আটকে গেলে সেটি ফেরত না দিয়ে নতুন করে ইস্যু করতে হবে। গ্রাহকের আবেদনের ৭ দিনের মধ্যে এ কার্ড দেয়ার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। আটকে যাওয়া কার্ডের তথ্য নিয়ে কেউ যাতে জালিয়াতির সুযোগ না পায়, সে জন্য সতর্কতামূলক এ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ থেকে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এটিএম বুথে কার্ড জালিয়াতির ঘটনার পর বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
×