ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কার্ড জালিয়াতরা মত্ত ছিল আয়েশি জীবনে ॥ রিমান্ডে নানা তথ্য

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১ মার্চ ২০১৬

কার্ড জালিয়াতরা মত্ত ছিল আয়েশি জীবনে ॥ রিমান্ডে নানা তথ্য

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ভোগ বিলাসের আয়েশি জীবন ছিল এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেফতারকৃত এক বিদেশী ও তিন বাংলাদেশীর। প্রতিমাসে খরচ করত অন্তত ৫ লাখ টাকা। রাত হলেই গুলশানের অভিজাত ক্লাবে গিয়ে স্ফুর্তি করত। গ্রেফতারকৃতদের দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তারা কতগুলো বুথ থেকে, কিভাবে, কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে, কোন কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নকল কার্ড বানিয়ে টাকা তুলে নিয়েছে তা জানতেই দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এমনকি বিদেশে কত টাকা পাচার করা হয়েছে সেসব তথ্য জানতেও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ইতোপূর্বে ৬ দিনের রিমান্ডে পাওয়া তথ্য মোতাবেক পুরো প্রতারক চক্রে জড়িত দেশী-বিদেশীদের তালিকা করা হয়েছে। দীর্ঘ সেই তালিকায় নাম থাকাদের গ্রেফতার করতেই এবার গ্রেফতারকৃতদের নিয়ে সরেজমিনে অভিযান চালাবে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। গ্রেফতারকৃতদের মাধ্যমে পলাতক চার বিদেশী ও লন্ডন প্রবাসী দুই বাংলাদেশীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালানো হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত একবছর ধরেই দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকে এমন ঝামেলা চলছিল। কিন্তু বেসরকারী ব্যাংকগুলো বিষয়টি গ্রাহকসহ সংশ্লিষ্টদের বুঝতে দেয়নি। এমনকি অনেকক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও পাশ কাটিয়ে গেছে। সম্প্রতি গ্রাহকদের তরফ থেকে অধিকহারে এটিএম জালিয়াতির বিষয়ে কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকে প্রচুর অভিযোগ জমা পড়তে থাকে। এতে ঘাবড়ে যায় ব্যাংকগুলো। শেষ পর্যন্ত তারা নিরুপায় হয়ে পুলিশের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি ইস্টার্ন ব্যাংক বনানী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, অন্তত ২১ জন গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট থেকে এটিএম কার্ড ক্লোন করে অন্তত ১০ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। মামলা দায়েরের পর বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে এলে হৈচৈ শুরু হয়। ইস্টার্ন ব্যাংক মামলা দায়ের করার পর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) একই থানায় একই ধরনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ব্যাংকটির এটিএম বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করা হয়েছে। এরপর সেই তথ্য দিয়ে এটিএম কার্ড বানিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই মামলাটির সঙ্গে এটিএম বুথে থাকা সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত পরে গ্রেফতারকৃত পোল্যান্ডের নাগরিকের ছবি দেয়া হয়। এছাড়া পল্লবী থানায় সিটি ব্যাংকের তরফ থেকে এমন অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের হয়। এরপর আস্তে আস্তে সব ব্যাংক বিষয়টিকে জনসম্মুখে নিয়ে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ইউসিবিএল ছাড়াও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও সিটি ব্যাংকের ছয়টি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে তথ্য চুরি করে একইভাবে কার্ড বানিয়ে প্রায় ২১ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্কিমিং ডিভাইজটি অন্তত ১২শ’ এটিএম কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এরমধ্যে ৪০টি কার্ড তৈরি করে টাকা তুলে নিয়েছে চক্রটি। বাকি ১১শ’৬০টি কার্ড বানিয়ে টাকা তুলে নেয়ার প্রস্তুতি চলছিল। মামলাগুলো তদন্ত করার দায়িত্ব পেয়ে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট গত ২১ ফেব্রুয়ারি পোল্যান্ডের নাগরিক পিওটর স্কেজেফান মাজুরেক (৫০), সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা মোকসেদ আলী মাকসুদ (৪৫), রেজাউল করিম শাহীন (৪০) ও রেফাত আহমেদ রনিকে (৪২) গ্রেফতার করে। তাদের ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, শুধু এটিএম কার্ড নয়, প্রতারণার কবলে পড়েছে অনেক চেইন সপও। পুরো এই প্রতারণার সঙ্গে ট্রাভেল এজেন্সি, হুন্ডি ও ঢাকার বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ীও জড়িত। চক্রটি গত এক বছরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৬শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ থেকেই অন্তত শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। পুরো জালিয়াতি চক্রটির সঙ্গে লন্ডন প্রবাসী পলাতক দুই বাংলাদেশী ছাড়াও অন্তত চারজন বিদেশী জড়িত। পলাতকদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা। তাদের গ্রেফতার করতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। শনাক্ত হওয়া বিদেশীরা রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিক। গ্রেফতারকৃত বিদেশী বিশ্বের ৩-৪টি দেশে মোস্টওয়ান্টেড। ডিবির একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃতদের বিলাসবহুল আয়েশি জীবন ছিল। সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা অফিসের কাজ শেষ করেই চলে যেত গুলশানে। সেখানকার সব দামী দামী হোটেলে স্ফুর্তি করত। হোটেলগুলোতে বসেই নানা প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল আঁটত। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সবচেয়ে বিলাসী জীবন ছিল বিদেশীর। সে মাসে ৫ লাখ টাকা খরচ করত। পরের টাকা বলে কথা! বছরখানেক আগে বাংলাদেশে আসে ওই বিদেশী। অনেক গাইড হিসেবেই তার সঙ্গে পরিচিত হয় গুলশানের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর। ওই ছাত্রী বিবাহিত। তার ঘরে একটি সন্তানও রয়েছে। বিদেশীর সঙ্গে থাকতে থাকতে এবং টাকা পয়সার কারণে এক সময় বিদেশীকে পছন্দ করেন। পরবর্তীতে বিয়েও করেন। এ ঘরে ১৫ দিন বয়সী এক সন্তান রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী বসবাস শুরু করে গুলশানের একটি আলিশান ফ্ল্যাটে। যার ভাড়া প্রায় একলাখ টাকা। ডিবির এই কর্মকর্তা বলছেন, এবার গ্রেফতারকৃতদের নিয়ে সরেজমিনে অভিযান চলবে। মূলত কবে, কোথায়, কাদের মাধ্যমে এবং কতদিন যাবত বাংলাদেশ থেকে এভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে তা জানার চেষ্টা চলছে। এমনকি পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে কারা কারা, কিভাবে জড়িত তাও জানা যাবে। তাদের নিয়ে পুরো চক্রের সদস্যকে গ্রেফতার করতেই অভিযান চালানো হবে। ইতোমধ্যেই রিমান্ডে তথ্য মোতাবেক দেশী-বিদেশীসহ সংশ্লিষ্টদের একটি তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা মোতাবেক অভিযান চলবে।
×