সমুদ্র হক ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের পালায় ঋতুচক্র এতটাই ঘূর্ণিপাকের ফেরে পড়েছে যে কখন কোন্ কাল তা বোঝাই যাচ্ছে না। সাধারণত উত্তরাঞ্চলে ফাল্গুনের অর্ধেকেরও বেশি সময় নাতিশীতোষ্ণ থাকে। খুব সকালে ও বিকেলের পর শীতের কাপড় গায়ে চড়াতেই হয়। এবার মাঘের শেষ প্রহরেই প্রকৃতি কালের বিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে গরমকে টেনে এনেছে। বৃক্ষের পাতা ঝরার দিন আগাম এসেছে। এখন এই ঝরা পাতা ঝড়কে না ডাকলেই হয়।
ফাল্গুনে শীতের রেশটুকুও নেই। নানা ধরনের ব্যামো দূর করতে ও শরীর ঠিক রাখতে যারা সকালে হাঁটাহাঁটি (মর্নিং ওয়াক) করেন কয়েকদিন আগেও তাদের গায়ে অন্তত সোয়েটার দেখা গেছে। আর এখন স্যান্ডো গেঞ্জি পরেই দ্রুতলয়ে হাঁটেন। বেলা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে গরমে অস্বস্তি শুরু হয়। দুপুর না গড়াতেই শহরকে মনে হয় গ্রীষ্মের ভরদুপুর। পথে জনচলাচল কমে যায়। গোধূলি লগনে কিছুটা ফুরফুরে হাওয়া অনুভূত হয় ঠিকই পরক্ষণই ঘাম ঝরিয়ে জানান দেয় এটা প্রকৃতির খেয়ালী দুষ্টুমি। সন্ধ্যার পর পার্কে ও শহরতলির ফাঁকা পথে মানুষ স্বস্তির হাওয়া পেতে যায়। কোন লাভ হয় না। ছেলেবেলার পদ্য ‘আর ক’টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি’র মতো মনে হবে জলবায়ু সাফ জানিয়ে দিচ্ছে, আর কয়েকদিন পর দেখ গরমের কি অবস্থা করি!
আর কয়েকদিন লাগবে না, রাজধানী ঢাকাবাসী এখনই গ্রীষ্মের আঁচ পেতে শুরু করেছে। উত্তরাঞ্চলের মধ্য নগরী বগুড়ায় উচ্চবিত্তরা এয়ার কন্ডিশনার (এসি) চালু করেছেন। উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যাদের ঘরে এসি আছে তারা বিদ্যুত সাশ্রয়ী হতে থেমে থেমে চালাচ্ছেন। আর বৈদ্যুতিক পাখা সর্বজনীন হয়ে পূর্ণ গতিতে ঘুরতে শুরু করেছে। দম ফেলার ফুরসত নেই। যারা স্যুটেড বুটেড হয়ে স্টাইল করে ঘুরতেন তাদের সেই শখ চুলায় গেছে। এখন ফুলশার্টের বদলে গেঞ্জি ও হাফ শার্ট চড়িয়েছেন।
গ্রামের পথে পা বাড়ালে চোখে পড়ে কৃষক খালি গায়ে ফসলের পরিচর্যা করছেন। ভর দুপুরকে চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদ মনে হবে। এর মধ্যে একটু ছায়া পেতে বড় গাছের নিচে ক্ষণিকের আশ্রয় নিচ্ছে। হালে গ্রামেও হকারদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। এমন অবস্থায় তারা হাঁক দেয় আইসক্রিম। শরবতের দোকানও বসেছে রাস্তার মোড়ে। বর্তমানে গ্রামে পাকা সড়ক হওয়ায় রাস্তার মোড়গুলোতে দোকানপাট বসে কেনাকাটার সেন্টার হয়েছে। ফাল্গুনের এই গরমেই তৃষ্ণাকাতর মানুষ একদ- দাঁড়িয়ে বরফ দেয়া শরবত পান করছে। হাঁসফাঁসে কাহিল হয়ে পড়ছে তারা। বগুড়ার সোনাতলার রানীরপাড়া গ্রামে ফসলের জমি পরিচর্যারত কৃষক আফসার বললেন ‘ দেকতো বাপুরে ফাল্গুন মাসত এঙ্কা (এ রকম) গরম পড়ল ক্যা! জানডা তো আর বাঁচে না। একনি (এখনই) ইঙ্কে গরম বোশেখ জ্যষ্ঠিত না জানি কি হয়।’ বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের দেখে তারা বলে ‘দেখ তো তোমাগেরে দামি মবাইল ফোনত ইন্টারনেট কি কয়!’ বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তি এতটাই ব্যাপ্তি পেয়েছে যে গাঁয়ের কৃষক ও গাঁয়ের বধূ ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচিত। দিন দিন মানুষ সচেতন হওয়ায় ফাল্গুনে আবহাওয়ার এমন বৈপরীত্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া পড়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়টি তারা জানে গ্রামে টেলিভিশনের সংখ্যা এবং খবরের কাগজের পাঠক বেড়ে যাওয়ার কারণে। এমন উল্টো আবহাওয়ায় ভূমিকম্পের শঙ্কার কথাও বলাবলি হয়। এদিকে রাত ছোট ও দিন বড় হচ্ছে। এই সময়ের বিকেল ও সন্ধ্যাকে মনে হবে গ্রীষ্মের দিন। দুপুরের পর অনেকেরই তন্দ্রাভাব আসছে। একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে ভাল হতো এমনটি মনে করে যারা গা এলিয়ে দিয়েছেন তখনই ঘুমপরী এসে জাপটে ধরছে। যাদের নাসিকা গর্জনের অভ্যাস আছে তারা তো ঘরর ঘরর শব্দে পাশে থাকা কাউকে বিরক্তির পথে ঠেলে দিচ্ছেন। আবার এমনই দিনে কেউ দিবাস্বপ্ন দেখছে; কাউকে মনে করে, যেখানে বয়স কোন বাঁধা নয়। সব মিলিয়ে ফাগুনেই গরমের পরশে বলাবলি হয় শীত এবার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য এসেছিল। আবহাওয়া বিভাগেরও কথা, এবার আগেভাগেই গরম পড়বে। পড়বে আর কি গরম পড়েই গেল...।