ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কড়া নাড়ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা

আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও, আনন্দের জাগরণী ছুঁই’য়ে দাও

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৩১ জানুয়ারি ২০১৬

আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও, আনন্দের জাগরণী ছুঁই’য়ে দাও

মোরসালিন মিজান ॥ শুরুর আগেই দারুণ একটা শুরু। জমজমাট বাংলা একাডেমি। প্রকাশকরা সকাল-সন্ধ্যা সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে। ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন লেখকরা। পাঠকরাও বসে নেই। এরই মাঝে চিত্ত চঞ্চল। সময় সুযোগ করে ঢুঁ মারছেন প্রিয় প্রাঙ্গণে। এভাবে একটু একটু করে প্রাণ পাচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। যেন সুগন্ধী ফুল, ফুটতে শুরু করেছে। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর ফোয়ারা হবে বই। তাই আহ্বান- আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও/ ...আনন্দের এই জাগরণী ছুঁই’য়ে দাও...। বরাবরের মতোই সুন্দর এ আহ্বানে আগামীকাল সোমবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলার। গোটা ফেব্রুয়ারিই চলবে। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত বইমেলা থেকে ছড়িয়ে দেয়া হবে প্রগতির বাণী। সবই চূড়ান্ত। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও আবেগের বর্ণাঢ্য প্রকাশ। মাসব্যাপী আয়োজনে বিপুল পরিমাণ নতুন বই প্রকাশিত হয়। সারা বছরের সবচেয়ে বেশি বই বিক্রি হয় মেলা থেকে। আড্ডায় মাতেন লেখক-পাঠক-প্রকাশকরা। প্রবাসীরাও যোগ দেন। এভাবে উৎসবের চেহারা পায় গোটা এলাকা। তবে, একুশের চেতনাকে ধারণ ও ছড়িয়ে দেয়াই আয়োজনের মূল লক্ষ্য। গত মেলায় চেতনার এ জায়গাটিতেই আঘাত হেনেছে মৌলবাদী চক্র। বর্বর জঙ্গীরা বইমেলার রাস্তায় নির্মমভাবে হত্যা করে লেখক অভিজিৎ রায়কে। কয়েক মাস আগে আক্রান্ত হন প্রকাশক। সৃজনশীল বইয়ের মেধাবী প্রকাশক দীপনকে তাঁর অফিস কক্ষে মেরে ফেলে রেখে যায় অন্ধকারের শক্তি। এবারের মেলা তাই বড় এক চ্যালেঞ্জ। কতটা প্রস্তুত সংশ্লিষ্টরা? প্রশ্ন উঠছিল। শুরুর প্রাক্কালে আবারও যেন সামনে এসেছে প্রশ্নটি। শনিবার বিষয়গুলো নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে মেলার সর্বশেষ প্রস্তুতি সম্পর্কে জানান তিনি। বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালীর প্রাণের মেলা। এর সঙ্গে প্রতিটি বাঙালীর আত্মার সম্পর্ক। তাই প্রতিবারই মেলাকে সফল করতে কাজ করে বাংলা একাডেমি। তবে, এবারের মেলা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছর বড় দুটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। একজন লেখক ও একজন প্রকাশককে হত্যা করা হয়েছে। এই অবস্থায় সবদিক বিবেচনায় রেখে প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। অবশ্য তিনি লেখকদেরও দোষ ত্রুটি খোঁজার চেষ্টা করেন। কী লেখা উচিত এবং কী লেখা উচিত নয় সে বিষয়ে সাবধান করে দেন। বলেন, কাউকে, কোন ধর্ম বা সম্প্রদায়কে আঘাত করে এমন উস্কানিমূলক কিছু লেখা উচিত নয়। লেখকদের সাবধান হতে হবে। অভিজিৎ কিংবা দীপনের মৃত্যুতে বাংলা একাডেমি একদমই নীরব। আনুষ্ঠানিক বলার দিনও নিহত দু’জনের সম্পর্কে তেমন কিছু তিনি বলেননি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেছেন প্রায়শই। মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হত্যাকা-ের শিকার লেখক ও প্রকাশকের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে কোন কর্মসূচী রাখা যায় কিনা- এমন প্রশ্নেও সাড়া মেলেনি। অবশ্য মেলা নিয়ে খুবই আশাবাদী মহাপরিচালক বলেন, এবার আরও বৃহৎ পরিসরে মেলা আয়োজন করা হচ্ছে। জায়গা বেড়েছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এসবের বাইরেও অনেক নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিস্তারিত তুলে ধরে মহাপরিচালকের দাবি- এবারের আয়োজন হবে শ্রেষ্ঠ। লিখিত বক্তব্যে মেলার স্বরূপ কী হবে তার একটি বর্ণনা তুলে ধরেন সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। তিনি জানান, এবারও ১ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঞ্চে থাকবেন বিদেশী অতিথি ব্রিটিশি কবি জীবনানন্দ অনুবাদক জো উইন্টার ও চেক প্রজাতন্ত্রের লেখক গবেষক রিবেক মার্টিন। উপস্থিত থাকবেন আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সমিতির সভাপতি রিচার্ড ডেনিস পল শার্কিন ও সাধারণ সম্পাদক জোসেফ ফেলিক্স বুরঘিনো। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর ওই দিন সন্ধ্যায় সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে মেলার দুই ভেন্যু। তিনি জানান, এরই মাঝে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্টল সাজানোর কাজ শেষ হয়ে এসেছে। একাডেমি চত্বরও মোটামুটি প্রস্তুত। বাকি কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হবে। মেলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের চেষ্টা করা হবে বলেও জানান তিনি। বিকেলে দুই ভেন্যু ঘুরে দেখা যায়, মেলার চেহারা মোটামুটি স্পষ্ট। বাংলা একাডেমি চত্বরে এবারও থাকছে সরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বিভিন্ন সংগঠন এবং গণমাধ্যমের স্টল। লিটলম্যাগ চত্বর এখানে থাকছে। মেলার মূল ভেন্যু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এলাকাটি ঘুরে মনে হয়, মেলা যেন শুরু হয়ে গেছে! যেদিকে চোখ যায়, সাজ সজ্জার কাজ। স্টলগুলো নানা রঙে রূপে দৃশ্যমান হচ্ছে। এখন শুধু বই তোলার বাকি। মৃত্যুকে পেছনে ফেলে মেলায় অংশ নিচ্ছে জাগৃতি প্রকাশনী। প্রকাশক দীপনকে হত্যা করা হলেও ছবি হয়ে তিনি আছেন স্টলে। মিষ্টি মুখের নিচে লিখে রাখা হয়েছেÑ অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ...। জীবনানন্দের এই বলাটি যেন দীপনের হয়ে রোদন করছে বইমেলার বাতাসে! প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ও সেই কালো স্মৃতি তাড়া করে। আক্রান্ত প্রকাশক মেলায় থাকছেন না। তাঁর প্রকাশিত বই কথা বলবে তাঁর হয়ে। এ প্রসঙ্গে প্রকাশক নেতা ও উৎস প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী মোস্তফা সেলিম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা বই প্রকাশ করি। যার যা মত, তুলে ধরি। পাঠকের গ্রহণ ও বর্জনের অধিকার আছে। কিন্তু এ অজুহাতে প্রকাশক হত্যা বড় অন্যায় কাজ। নিষ্ঠুর কাজ। কোন কোন প্রকাশক হুমকির মধ্যে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এর পরও বইমেলা সফল করতে সবাই মিলে কাজ করছি আমরা। প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের স্টল সাজানোর মূল কাজ শেষ। বাকি কাজ আগামীকালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। বইয়ের প্রকাশনা চলবে মেলার শেষ দিন পর্যন্ত। প্রতিদিনই নতুন নতুন বই আসবে। প্রাণের মেলায় সকলকে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
×