ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাসটেইন্যাবিলিটি কমপ্যাক্ট বাস্তবায়নে পোশাকের দাম বাড়ানো উচিত

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

সাসটেইন্যাবিলিটি কমপ্যাক্ট বাস্তবায়নে পোশাকের দাম বাড়ানো উচিত

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পোশাক খাতে টেকসই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সরকারী-বেসরকারী খাতের বিভিন্ন পদক্ষেপে সন্তুষ্ট ক্রেতা গোষ্ঠী। তবে শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ প্রদান এবং এক্ষেত্রে শ্রমিকদের হয়রানি বন্ধ করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে রফতানি প্রক্রিয়া অঞ্চলে (ইপিজেড) ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ প্রদান করা উচিত বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল। তাদের এই প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এতদিন শ্রম আইন বাস্তবায়ন ও কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি নিয়ে সরকার-উদ্যোক্তারা বেশি মনোযোগী ছিল। এখন থেকে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়ে বেশি নজর দেয়া হবে। তবে কোনভাবেই ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দেয়া হবে না। ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ দেয়া হবে না এই শর্তেই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আনা হয়েছিল। এ ছাড়া পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, সাসটেইন্যাবিলিটি কমপ্যাক্ট বাস্তবায়নে এ মুহূর্তে পোশাকের দাম বাড়ানো উচিত। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে পোশাকের দাম নির্ধারণ করা হলে ক্রেতাদের সব শর্ত পূরণ করা সম্ভব হবে। আর শ্রমিক নেতারা বলছেন, পোশাক খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা ট্রেড ইউনিয়ন ও মজুরি। এটি করতে গেলে মালিকদের হয়রানির স্বীকার হতে হচ্ছে। এ দুটো সমস্যার সহজে সমাধান হয় মজুরি সঠিক সময়ে প্রদানের মাধ্যমে। এ জন্য পোশাকের সঠিক মূল্য নির্ধারণের সময় এসেছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে সাসটেইন্যাবিলিটি কমপ্যাক্ট মূল্যায়ন সভায় অংশগ্রহণকারীরা এসব তথ্য তুলে ধরেন। সভায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের ৫ সদস্যের বাণিজ্য প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে রয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী প্রতিনিধি মাইকেল জে ডিলেনি। তার সফরসঙ্গী রয়েছেন ইউএসটিআর এর আন্তর্জাতিক শ্রম বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি সারা ফক্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের পরিচালক মাইকেল ডোনোভান ও ব্রুস লেভিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম দফতরের সহকারী উপ-আন্ডার সেক্রেটারি এরিক রিয়েল। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদ্যু, আইএলও কান্ট্রি ডিরেক্টর শ্রীনিবাস বি রেড্রি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমিশনার এ্যানড্রেস জুলিন, আইএলওর বিশেষ উপদেষ্টা ড্যান কুনিয়া, শ্রম সচিব মিকাইল শিপার, পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহিদুল হক, বিজিএমইএ সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান, এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ, শ্রমিক নেতা নাজমা আহমেদ প্রমুখ সভায় অংশগ্রহণ করে নিজেদের অভিমত তুলে ধরেন। উল্লেখ্য, রানা প্লাজা ধসের তিন বছর পর এবার পোশাক খাতের সাসটেইন্যাবিলিটি কমপ্যাক্ট মূল্যায়ন করতেই এ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। রানা প্লাজার মতো বড় এই দুর্ঘটনার পর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল পোশাক শিল্প খাত। সেই সময় পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের অধিকার, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশের উন্নতির ইস্যুগুলো অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাসটেইন্যাবিলিটি কমপ্যাক্ট গঠন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রেতা জোটের পরামর্শে বাংলাদেশ এ্যাকশন প্লান-২০১৩, সাসটেইন্যাবিলিটি কম্প্যাক্ট এবং জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্ম-পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। বলা হয়েছিলÑ এই তিনটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠার পাবে। একই সঙ্গে শ্রমিক যে কারখানায় কাজ করেন তা হবে শতভাগ নিরাপদ কর্মপরিবেশ। তিন বছর পর এবার সাসটেইন্যাবিলিটি কম্প্যাক্ট মূল্যায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জিএসপি পুনর্বহাল এবং পোশাক খাতের শ্রম অধিকার বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ এ্যাকশন প্লান নামে একটি পরিকল্পনা দেয়া হয়। এই মূল্যায়ন সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-ক্রেতাদেশগুলোর সব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে পোশাক খাত। জিএসপি পুনর্বহাল না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি বেড়েছে। কেটে যাচ্ছে ইমেজ সঙ্কট। ইতোপূর্বে আন্তর্জাতিক ক্রেতা জোট এ্যাকোর্ড এবং এ্যালায়েন্স কয়েকটি বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে পোশাক খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে আরও মনিটরিং প্রয়োজন বলেও বলে মনে করছে ক্রেতা জোট। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী শ্রম সচিব মিকাইল শিপার বলেন, সরকার এখন ট্রেড ইউনিয়নের বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতোমধ্যে ৩৩৬টি ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। এ বিষয়ে ক্রেতা গোষ্ঠী তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। তিনি বলেন, তাদের দাবি অনুযায়ী ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দেয়া হবে না। এতে করে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। তবে পোশাকের দাম বাড়ানোর বিষয়টি ক্রেতা ও বিক্রেতার দরকষাকষির ওপর নির্ভর করে। এখানে সরকারের তেমন কিছু করার নেই বলে তিনি জানান। বিজিএমইএ সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, তাদের দেয়া সব শর্তপূরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকিগুলো পূরণ করতে আরও সময়ের প্রয়োজন। এ ছাড়া শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে বিনিয়োগের প্রয়োজন। এ জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পোশাকের দাম সমন্বয় করতে হবে। ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন নয় ॥ রফতানি প্রক্রিয়া অঞ্চল (ইপিজেডে) ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে সরকার কঠোর সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। যদিও ক্রেতা জোটের পক্ষ থেকে ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছেন, বাংলাদেশে ইপিজেডগুলোতে আর কোন ট্রেড ইউনিয়ন করা হবে না। ইপিজেডে ২১৭টি কারখানায় ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন সিবিএ হিসেবে কাজ করছে। এ জন্য আলাদা ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধসের পরে যে ইমেজ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল, তা কেটে যাচ্ছে। শ্রম আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে। পোশাক কারখানায় অভিযান অব্যাহত ॥ রানা প্লাজা ধসের পর এ পর্যন্ত কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর ১৪৭৫টি তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করেছে। রানা প্লাজা ধসে ১২শ’র বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কারখানার নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকারের বিষয়টিতে বহির্বিশ্বের নজরে পড়ে এবং রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাত পর্যবেক্ষণের আওতায় আসে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ফ্যাশন চেইন ইনডিটেক্স ও এইচএ্যান্ডএমসহ ১৮০টির বেশি ব্র্যান্ড ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ্যাকর্ড গঠন করে, যারা ১৩৫৬টি কারখানা পরিদর্শনের পর নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাবে ছাড়পত্র না পাওয়ায় ২৬টি কারখানা বন্ধ হয়। এ ছাড়া ওয়ালমার্ট ও গ্যাপসহ উত্তর আমেরিকার কোম্পানিগুলোর সমন্বয়ে বাংলাদেশের শ্রমিক নিরাপত্তা জোট তৈরি করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী প্রতিনিধি মাইকেল জে ডিলেনি বৈঠকে জানান, শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার-বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তাদের কিছু পদক্ষেপে সন্তুষ্ট ক্রেতা গোষ্ঠী। তবে আরও অগ্রগতি প্রয়োজন। ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ দেয়া উচিত। এ ছাড়া ইপিজেডের বাইরে যেসব কারখানা রয়েছে সেখানেও ট্রেড ইউনিয়নের ব্যাপারে বাধা আছে। ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এগুলো বন্ধ করতে হবে। আইএলও কান্ট্রি ডিরেক্টর শ্রীনিবাস বি রেড্রি বলেন, শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ভাল কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি বলেন, শ্রম আইন সংশোধন এবং সেটির বিধিমালা করা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন জরুরী হয়ে পড়ছে।
×