ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একজন মুক্তিকামী

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২৮ জানুয়ারি ২০১৬

একজন মুক্তিকামী

সুখের আশায়, উন্নত জীবনের আশায় প্রতিবছর দেশ ছাড়ে অসংখ্য মানুষ। কিন্তু সবার স্বপ্ন কি ধরা দেয় হাতের মুঠোয়? প্রতারিত হয়, কাটায় মানবেতর জীবন। এই সব অভিবাসীকে নিয়েই কাজ করেন আহমেদ আবিদ। লিখেছেনÑ তাবাসসুম নাফিসা ‘নৃশংস, ভয়াবহ, অমানবিক!’ শীতের সন্ধ্যা গাঢ় হতে হতে গভীর রাতের দিকে চলেছে। রাজধানীর শাহবাগ আজিজ মার্কেটে বসে আহমেদ আবিদ যে গল্প শোনালেন খুব ঠান্ডা স্বরে, থেমে থেমে; গল্প শুনে প্রতিক্রিয়া হিসেবে এ তিনটি শব্দই বলা চলে কেবল। আহমেদ আবিদকে যারা চেনেন তারা মানেন ত্রাণকর্তা হিসেবে, আর যাদের এখনও সৌভাগ্য মেলেনি এই মানুষটি সম্পর্কে জানার, তারা এই লেখা পড়ার পর শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে ফেলবেন নিশ্চিত। তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে, বলে নেয়া যাক প্রেক্ষাপট। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার আশায় প্রতি বছর বিদেশে পাড়ি জমায় অসংখ্য মানুষ। আশা- একটুখানি সুখ, একটুখানি সমৃদ্ধি। কিন্তু বেশিরভাগই পড়ে মানবপাচারকারীর খপ্পরে। জমি, বসতভিটা বিক্রি করে, ঋণী হয়ে শেষ সম্বলটুকু তুলে দেয় তাদের হাতে। প্রতারিত হয়। তাদেরকে তুলে দেয়া হয় লঞ্চে, অনেক সময় বিদেশের মাটিতে পা রাখতে পারলেও কাজ আর মেলে না। পালিয়ে, অনাহারে কাটাতে হয় জীবন। তারা না পারে দেশে ফিরতে, না পারে বিদেশের মাটিতে টিকতে। এই সব অভিবাসীদের নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন আহমেদ আবিদ। তিনি ছুটে চলেন। দেশ থেকে বিদেশ। শহর থেকে গ্রাম। তুলে আনতে চান তাদের করুণ কাহিনী। দেখাতে চান সবাইকে। সচেতন করতে চান। বাস্তব ঘটনা দেখাতে চান কর্তৃপক্ষকে। বলতে চান, ‘এরা এই পরিস্থিতিতে আছে। দয়া করে কিছু করেন।’ তার চেষ্টায় অনেকেই ফিরতে পারেন দেশে, নিজের পরিবারের কাছে। এমনই দুইজন স্বপ্নযাত্রী কামাল ও ফজলু। ২০০৭ সালে তারা পাড়ি জমিয়েছিলেন থাইল্যান্ডে। অতঃপর সেই প্রতারণা-অনিশ্চয়তার গল্প। তারা যোগাযোগ করেন আবিদের সঙ্গে, তখন তিনি থাইল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষারত। আবিদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় এ দু’জন ফিরতে পারেন মাতৃভূমিতে। ফজলু ও কামালের ওপর তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন আবিদ, ২০১০ সালে ‘...এবং স্বপ্নযাত্রী’ নামে। তথ্যচিত্রটি এরইমধ্যে বেশকিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তথ্যচিত্র উৎসব ও মানবাধিকার গবেষণা সম্মেলনে নির্বাচিত এবং প্রদর্শিত হয়েছে। এ প্রয়াসটি সতীর্থ নাট্যদল অবয়ব-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের ১২টি জেলায় তথ্যচিত্রটি প্রদর্শন করেছেন তিনি। ইচ্ছা- দেশের প্রতিটি জেলায় এটি প্রদর্শনের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় এই বার্তা পৌঁছে দেয়া যে, মানবপাচার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ! অবয়ব নাট্যদলেরই আরেকটি প্রযোজনা আছে ‘ভূমধ্যসাগর’ নামে। এটিতেও উঠে এসেছে ভয়াবহতা, নৃশংসতা। আহমেদ আবিদ নিজেকে পরিচয় দেন গবেষক হিসেবে। কিন্তু তিনি কি শুধুই একজন গবেষক! তিনি তো ত্রাণকর্তা, মুক্তিকামী। অভিবাসীদের মানবাধিকার আদায়ের জন্য কতকিছু করছেন! জানালেন, একই বিষয় নিয়ে আরেকটি তথ্যচিত্রে ডুবে আছেন তিনি। কয়েক বছর ধরে এটির কাজ চলছে। একইসঙ্গে এটাও বললেন, এ তথ্যচিত্রটি মানুষকে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। আহমেদ আবিদের এতসব পরিশ্রমের উদ্দেশ্য একটিই- বাংলাদেশের শ্রমজীবি মানুষ যারা দেশ ও দেশের বাইরে বসবাস করে, কষ্টার্জিত আয় দিয়ে সচল রাখে দেশীয় অর্থনীতির চাকা; তাদের অধিকার আদায় করা। স্বপ্নের প্রবাসের পরিবর্তে মানব পাচারের শিকার হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জীবন আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর মুখোমুখি যাতে না হয় কেউ, সে পরিবেশ তৈরি। সে লক্ষ্যেই আহমেদ আবিদ কাজ করছেন, করে যাবেন।
×